লকডাউন: টেলিভিশনের পৌষ মাস, সিঙ্গল স্ক্রিনের সর্বনাশ
সল্টলেকের বাড়ি থেকে শিয়ালদহে তাঁর সিনেমা হলে যাচ্ছিলেন মিনার-বিজলী-ছবিঘরের কর্ণধার সুরঞ্জন পাল। আটকে দিয়েছে পুলিশ। ঘরে ফিরে তাঁর গলায় চিন্তার সুর, ‘তিন-চার মাস বা ছ’ মাস সিনেমা হল বন্ধ থাকার পরও আমরা দর্শক টানতে পারব। তবে এখন প্রধান সমস্যা সিনেমা হলগুলোর যত্ন করা। আমাদের টু-কে প্রোজেকশন ঠিক রাখতে হবে। কিছু ক্ষেত্রে চার্জ দেওয়ার প্রয়োজন রয়েছে। কিন্তু রাজ্য সরকারের তরফে কোনও পাস না থাকায় আমরা সেই কাজে আটকে যাচ্ছি।’
হল মালিকদের তরফে রাজ্য সরকারের কাছে তাঁর অনুরোধ, হলের প্রয়োজনীয় যত্নের জন্য সেখানে এক-দু’দিন যেতে দিলে ভালো। একই ভাবনা অনেকের। ব্যারাকপুরের ‘অতীন্দ্র’-র মালিক অচিন্ত্য সিংহ রায় বলেই ফেললেন, ‘আমরা যে করোনার পর কী করে আর সিনেমা হল চালাব বুঝতে পারছি না। আপনারা যে খোঁজ করছেন, এই অনেক!’
উত্তরবঙ্গে যাওয়া যাক। কোচবিহারের ‘ভবানী’, শিলিগুড়ির ‘নিউ সিনেমা’-র মালিক গণেশ বাগারিয়ার এক চিন্তা। বললেন, ‘কোচবিহারের হলে নিয়মিত দর্শক আসেন ছবি দেখতে। হলের অবস্থা যথেষ্ট ভালো। কিন্তু করোনার পর এই সিনেমা হল খুললে, কতজন দর্শক পাব, বুঝতে পারছি না’।
লকডাউন উঠে গেলেও সিঙ্গল স্ক্রিনের দরজা খুলতে বেশ কিছুটা সময় অপেক্ষা করতে হবে, সেটা বুঝে গিয়েছেন হল মালিকরা। কিন্তু তারপরও প্রতিনিয়ত কিছু সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন তাঁরা।
মিনারের মতো ‘প্রিয়া’, ‘নবীনা’ বা শেওড়াফুলির ‘উদয়ন’ বেশ পরিচিত সিঙ্গল স্ক্রিন। এই পরিস্থিতিতে কর্মচারীদের পুরো মাসের বেতন দিচ্ছেন মালিক। উদয়নের কর্মচারীদের জন্য চাল-ডালের মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসেরও ব্যবস্থা করে দিয়েছেন মালিক পার্থ সারথি দাঁ। করোনার পর মগরার সিঙ্গল স্ক্রিন আর বোলপুরের ‘গীতাঞ্জলি’-র অবস্থার অবনতি হবে না, কারণ টলিউডের নামী প্রযোজনা সংস্থা দেখভাল করে। কিন্তু এমন সিঙ্গল স্ক্রিনের সংখ্যা হাতে গোনা। ২০২০-র গোড়ায় রাজ্যে ১৫০টির মতো হলে সিনেমা দেখার পরিবেশ রয়েছে। তার মধ্যে ৭০টির মতো সিঙ্গল স্ক্রিন গত ছ’ মাস কোনও লাভের মুখ দেখেনি । এ বার আশঙ্কা, অতি রুগ্ন এই সিঙ্গল স্ক্রিনগুলোর দরজা আর খুলবে না!
মার্চে শেষ শো হয়েছে ধর্মতলা চত্বরের রক্সি সিনেমা হলে। ঢিল ছোঁড়া দূরত্বে প্যারাডাইস সিনেমাহলের কর্তাব্যক্তি সুনীত সিংয়ের গলায় আশঙ্কা, ‘লকডাউন যদি উঠেও যায়, সিঙ্গল স্ক্রিনে আর কি দর্শক আসবেন? প্যারাডাইস ছ’ মাসের আগে খোলার কোনও প্রশ্নই নেই। বিভিন্ন জেলা থেকে যা খবর আসছে, ৫০ শতাংশ সিঙ্গল স্ক্রিন আর কোনওদিনই খুলবে না’।
‘নবীনা’র কর্ণধার নবীন চৌখানি মনে করছেন, লকডাউন উঠে যাওয়ার পরও চট করে সিঙ্গল স্ক্রিনের দরজা খুলে দেওয়া ঠিক হবে না। নবীনার দরজা খোলার পর প্রথমে কিছুদিন ১০০ শতাংশ টিকিট বিক্রি করা হবে না, এমন সিদ্ধান্তও নিয়েছেন।
টিমটিম করে হলেও চলছিল নিউ মার্কেটের ‘সোসাইটি’। খবর হল, লকডাউন শেষ হলেও এই হল খোলার সম্ভাবনা এক শতাংশ। যেমন উত্তর কলকাতায় ধুঁকে-ধুঁকে চলা ‘দর্পণা’র ঝাঁপ এ বার পড়েছে বরাবরের মতো। খড়গপুরের ‘অরোরা’ আর রিষড়ার ‘জয়ন্তী’ সিনেমাহল খোলার পরও কোনওরকম লাভ করতে পারবে কি না, তা নিয়ে আশঙ্কায় মালিক। এমনকী গ্লোব বা মেট্রো, যেখানে নতুন করে সিনেমা দেখানোর প্রস্তুতি চলছিল, সেই উদ্যোগেও জল পড়েছে।
টলিউডের জুনিয়র টেকনিশিয়ান থেকে জুনিয়র আর্টিস্টদের জন্য একটি বিশেষ তহবিলের ব্যবস্থা হয়েছে। কিন্তু অখ্যাত সিঙ্গল স্ক্রিনগুলোর লাইটম্যান থেকে কর্মচারী, তাঁদের সকলের ঘরে কি হাঁড়ি চড়ছে? এপ্রিল থেকেই মাস মাইনেতে টান পড়েছে কর্মচারীদের, খবর এল হাবরা, বারুইপুর, ডানলপ চত্বরের তিন সিনেমাহল থেকে। শহরতলির সিঙ্গল স্ক্রিনের যদি এই অবস্থা হয়, গ্রামের গুলোর কী অবস্থা, আঁচ করা সহজ। তা হলে উপায়? রাজ্য সরকারের সহায়তা ছাড়া কোনও উপায় দেখছেন না অধিকাংশ সিঙ্গল স্ক্রিন মালিক। কথা বলে বোঝা গেল, দুর্গাপুজোর মরসুমকে পাখির চোখ করে আশায় বাঁচছেন সিঙ্গল স্ক্রিন মালিকরা। তার আগে আশা দেখছেন না।
লেখনী: ভাস্বতী ঘোষ
তথ্যসূত্র: অন্য সময়