বিনোদন বিভাগে ফিরে যান

শ্রদ্ধায় স্মরণে সত্যজিৎ রায়

April 23, 2020 | 3 min read

২৮ বছর আগে আজকের দিনে বিকেল সাড়ে পাঁচটা নাগাদ ভারত ‘রত্নহীন’ হয়েছিল। এক দীর্ঘদেহী মানুষের মৃত্যু ভারতকে, বিশেষ করে বাঙালিকে, স্থায়ীভাবে নিঃস্ব করেছিল সেই বিকেল। যদিও দীর্ঘদিন হৃদরোগে আক্রান্ত মানুষটির মৃত্যু খুব একটা অপ্রত্যাশিত ছিল না ওই গুমোট এপ্রিলের সন্ধ্যায়, তবুও ‘সত্যজিৎ রায় নেই’, এই সংবাদটুকু যেন চুরমার করে বাঙালিকে ফিরিয়ে দিচ্ছিল ১৯৪১ সালের বৃষ্টি ভেজা এক অগাস্ট মাসের স্মৃতি, যেদিন উত্তর কলকাতার জোড়াসাঁকোর এক বাড়িতে নিভে গিয়েছিল এমনই এক প্রদীপ।
১৯৯২-এর ভারতবর্ষে ছিল না স্মার্টফোন, ফেসবুক, ইন্টারনেট, এফএম রেডিও, এমনকি সবেধন নীলমণি সরকারি চ্যানেল ছাড়া অন্য কোনও টিভি বা রেডিও। সুতরাং পরদিন যখন ছয় ফুট চার ইঞ্চির পৃথিবীখ্যাত মানুষটির মরদেহ রাখা হল নন্দন চত্বরে, সারা কলকাতা ভেঙ্গে পড়েছিল তাঁকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে। সেই দৃশ্য যদি সত্যজিতের প্রতি মানুষের শ্রদ্ধা অর্পণের এক দিক হয়, তবে অন্য দিকটি ছিল এই মহাপ্রয়াণের ফলে তৈরী হওয়া বিশাল শূন্যতাকে শব্দ আর কালির আঁচড়ে সংবাদপত্রের সম্পাদকীয় স্তম্ভে ফুটিয়ে তোলা – যা সেদিন ভারতের প্রতিটি প্রধান সংবাদপত্র করেছিল নতজানু হয়ে।

স্মরণে সত্যজিৎ রায়

শুধু বাঙলা থেকে প্রকাশিত বাঙলা বা ইংরেজি সংবাদপত্র নয়, সত্যজিতের মৃত্যু যেন সেদিন একই শোকের বেদনায় প্লাবিত করেছিল সারা ভারতবর্ষের সংবাদপত্রের পৃথিবীকে।
২৫ এপ্রিল ১৯৯২ ‘দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস’ গোষ্ঠীর বাণিজ্য দৈনিক ‘ফিনান্সিয়াল এক্সপ্রেস’ প্রকাশ করে ‘The end of a phase’ নামক এক সম্পাদকীয়, যেখানে বলা হয় সত্যজিৎ ছায়াছবির মধ্য দিয়ে যা বলতে চাইতেন, সেটা বোঝার জন্য বাঙলা ভাষা জানার প্রয়োজন নেই। সত্যজিতের মৃত্যুর সাথে সাথে সিনেমা নামক শিল্পটি হয়ত শেষ হয়ে যাবে না, তবুও সব কিছু বলা ও জানার পর এটুকু বলাই যায় যে আগামী দিনে যারা ধ্রুপদী ছবি করবেন, তাঁরা কেউ সত্যজিৎ রায় হবেন না।

অধুনা লুপ্ত বিখ্যাত ইংরেজি সংবাদপত্র ‘দ্য ইন্ডিপেন্ডেন্ট’ একই দিনে একটি আবেগঘন সম্পাদকীয় প্রকাশ করে, যার শীর্ষক ছিল ‘Remembering Ray’। সত্যজিতের মণীষাকে ‘cross fertilization of culture বলে চিহ্নিত করে ‘দ্য ইন্ডিপেন্ডেন্ট’ লেখে যে তাঁর সমতুল্য সমসাময়িক মহীরুহ, যেমন কুরোসোওয়া, বার্গম্যান বা ফেলিনির সঙ্গে মূল্যায়িত হয়ে সত্যজিৎ পেয়েছিলেন আরও উচ্চতায় পৌঁছানোর এক অনুপ্রেরণা, যা শুধু তাঁকেই নয়, বরং সারা পৃথিবীর সিনেমা শিল্প, যা জাপান থেকে শুরু করে ভারত ছুঁয়ে ছড়িয়ে পড়েছিল ইয়োরোপ ও আমেরিকায়, সমৃৃৃদ্ধ করেছিল।
‘India’s Satyajit Ray’, এই ছিল সেদিন বোম্বাইয়ের ‘দ্য টাইমস অফ ইন্ডিয়ার’ সম্পাদকীয় স্তম্ভের শীর্ষক। সত্যজিৎ রায়ের মৃত্যুর শূন্যতাকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মৃত্যুর শূন্যতার সঙ্গে তুলনা করে এই সংবাদপত্র উল্লেখ করেছিল পরিচালনা ছাড়াও চিত্রনাট্য রচনা, সেট পরিকল্পনা, আবহ সঙ্গীত ও সম্পাদনার মতন অন্য বিষয়গুলিতে সত্যজিৎ রায়ের স্বর্ণ স্বাক্ষরের। সত্যজিতের ছবিতে “robust touch of authenticity”, যা ভারতীয় সিনেমায় সত্যজিৎ পূর্ববর্তী যুগে ছিল অনুপস্থিত, সে কথা উল্লেখ করা হয় এই সম্পাদকীয়তে।
দিল্লি আর লখনউ থেকে প্রকাশিত ‘দ্য পাইওনিয়ার’-এর  সম্পাদকীয় শীর্ষকের নাম ছিল “A world without Ray”। এই পত্রিকা উল্লেখ করে যে সত্যজিৎ রায়ের মৃত্যু শুধুমাত্র বাঙলা বা ভারতবর্ষকে রিক্ত করে না – এই মৃত্যু দেশের সীমানা মুছে রিক্ত করে গোটা বিশ্বকে। সত্যজিৎ শুধুমাত্র যে সিনেমার নন, তিনি যে কলম, কালি, রঙ, তুলি ও সংগীতেরও মহা সাধক তার উল্লেখ রয়েছে এই অনবদ্য সম্পাদকীয়তে।
চেন্নাই থেকে প্রকাশিত একই দিনের ‘দ্য হিন্দু’ পত্রিকার সম্পাদকীয়টি ছিল অন্যরকম এবং অসাধারণ। সত্যজিতের মৃত্যুকে এমন একটা সিনেমা যুগের অবসান বলে বর্ণনা করা হয় যা শুরু হয়েছিল ১৯৩৯ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ছায়ায় তৈরী হওয়া ছবি জাঁ রেনোয়ার ‘দ্য রুলস অফ দ্য গেম’-এর সঙ্গে। ‘The irresistible appeal of Satyajit ray’ শীর্ষক ‘দ্য হিন্দু’-র এই সম্পাদকীয়ের শেষ অনুচ্ছেদে লেখা হয়েছিল, “It may not be an exaggeration to say that nobody else in our country has been able to weave this kind of magic on the screen and so consistently too”।
“Satyajit Ray” এই ছিল ২৪ এপ্রিলের ‘দ্য স্টেটসম্যান’-এর  সম্পাদকীয় শীর্ষক। সত্যজিতের ভারতরত্ন প্রাপ্তির অতি বিলম্বতাকে আঘাত করে স্টেটসম্যান লেখে, “Coloured visions and a preponderance of political or perhaps petty calculations might have kept Bharatratna from him”, কিন্তু যে সময়ে পুরস্কারটি বিতর্কে জর্জরিত, সেই সময়ে “the genius had risen well above it all”।
২৪ এপ্রিলের ‘দ্য টেলিগ্রাফ’ তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা অর্পন করে ‘The Tall Man’ শীর্ষক  সম্পাদকীয়তে। সত্যজিতের নিজের ভাষায় তিনি ছিলেন “committed to human beings”, কিন্তু এটা তাঁকে “social realist”-এ পরিণত করেনি। তাঁর কোনও ছবির শেষে তাৎক্ষণিক বা স্থায়ী সমাধানের ইঙ্গিত নেই, কিন্তু সত্যজিৎ সেই মানুষ যিনি ভারতীয় সিনেমাকে তার বস্তাপচা পলায়নমুখী দিক থেকে ফিরিয়ে এনে দিয়েছিলেন এক স্বতন্ত্র বাগধারা।
যে যুগে লাইক আর শেয়ার করে সাধারণ তথ্যকে অসাধারণ করা যেত না, সেই নব্বইয়ের দশকের শুরুতে ভারতের বিভিন্ন ইংরেজি সংবাদপত্রের সম্পাদকীয় কলমে সত্যজিৎ রায়ের প্রতি এই বিনম্র নতমস্তকতা প্রমাণ করে, ‘the tall man’ সত্যিই তাঁর শারীরিক উচ্চতার থেকেও অনেক বেশী tall ছিলেন।

TwitterFacebookWhatsAppEmailShare

#Bengali Movies, #Satyajit Ray, #Bengali film industry, #OSCAR, #Indian Cinema

আরো দেখুন