ভুল থেকে শিক্ষা নেয়নি সিপিএম, পর্যালোচনার ভার্চুয়াল বৈঠকে অকপট সীতারাম
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের (Mamata Banerjee) নেতৃত্বে রাজ্য সরকারের বিভিন্ন জনকল্যাণমূলক প্রকল্পের জেরেই রাজ্যে প্রতিষ্ঠান-বিরোধী মনোভাব কাটিয়ে উঠে নির্বাচনী সাফল্য পেয়েছে তৃণমূল, এমনটাই মনে করছেন সিপিএম-এর সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি (Sitaram Yechury)। বিধানসভা নির্বাচনে সংযুক্ত মোর্চার ভরাডুবি নিয়ে কাটাছেঁড়া করতে গিয়ে সীতারামের ব্যাখ্যা, বিজেপির হিন্দুত্বের মোকাবিলায় বাঙালি অস্মিতাকে কাজে লাগাতে পেরেছে রাজ্যের শাসকদল। উল্টো দিকে, আলিমুদ্দিন স্ট্রিট অতীতের ভুলগুলিকে উপলব্ধি না করতে পেরে আরও বড় ভুলের জন্ম দিয়েছে।
নির্বাচনী ফলাফল নিয়ে বিশদে পর্যালোচনা করতে শনিবার থেকে শুরু হয়েছিল সিপিএম-এর রাজ্য কমিটির দু’দিনের ভার্চুয়াল বৈঠক। সেই বৈঠকে ফলাফল নিয়ে নিজের জবাবি ভাষণে সীতারাম তৃণমূলের প্রত্যাবর্তনের নেপথ্যে মমতার বিভিন্ন জনমুখী প্রকল্প এবং নির্বাচনী প্রচারে বাঙালি জাত্যাভিমানকে সুকৌশলে ব্যবহার করার কথা বলেছেন। অন্য দিকে তৃণমূল অথবা বিজেপির কোনও বিকল্প হিসেবে সংযুক্ত মোর্চা আমজনতার সামনে উঠে আসেনি। সিপিএম সাধারণ সম্পাদক রবিবার তাঁর জবাবি ভাষণে বলেন, ‘রাজ্যে প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা ছিল। যার ফলে ২০১৯ সালে বিজেপি-র লাভ হয়েছিল। কিন্তু পরে তৃণমূল এই অসন্তোষ কমাতে বিভিন্ন জনকল্যাণমূলক প্রকল্পকে ব্যবহার করে। বিজেপির হিন্দুত্বের বিরুদ্ধে বাঙালি জাত্যাভিমানকেও তারা ব্যবহার করেছে।’
বিধানসভা নির্বাচনে (West Bengal Election 2021) তৃণমূলের বড় হাতিয়ার ছিল মমতার কন্যাশ্রী, স্বাস্থ্যসাথী, দুয়ারে সরকার, খাদ্যসাথী, চা-সুন্দরী সহ একগুচ্ছ জনমুখী প্রকল্প। একই সঙ্গে ক্ষমতায় ফিরলে মহিলাদের মাসে হাত খরচ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি, ছাত্র-ছাত্রীদের ক্রেডিট কার্ড, কৃষকবন্ধু প্রকল্পে বরাদ্দ বাড়ানোর আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল। সীতারামের বিশ্লেষণ অনুযায়ী, দশ বছরে তৃণমূল সরকারের বিরুদ্ধে যে প্রতিষ্ঠান-বিরোধী মনোভাব তৈরি হয়েছিল, তা এই জনমুখী প্রকল্প অনেকাংশে প্রশমিত করতে পেরেছে। একই সঙ্গে বিজেপি এই রাজ্যে হিন্দুত্বের লাইনে প্রচার করলেও তৃণমূলের বাঙালি অস্মিতার প্রচারের সামনে গেরুয়া শিবিরের এই কৌশল ভোঁতা হয়েছে বলে মনে করছেন ইয়েচুরি। নির্বাচনী প্রচারে নরেন্দ্র মোদী, অমিত শাহ, জেপি নাড্ডা, যোগী আদিত্যনাথ-সহ ভিন রাজ্যের বিজেপি নেতৃত্ব যত বেশি করে এসেছেন, তৃণমূল পাল্টা আরও জোরালো ভাবে এঁদের ‘বহিরাগত’ হিসেবে চিহ্নিত করে প্রচার করেছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নির্বাচনী প্রচারে বারবার বলেছেন, গুজরাট কোনও অবস্থায় বাংলা শাসন করবে না।’ সীতারাম মনে করছেন তৃণমূলের এই কৌশল ভোটবাক্সে ডিভিডেন্ড দিয়েছে।
তৃণমূলের এই সাফল্যের পাশে বামেদের গণভিত্তিতে আরও ক্ষয় হয়েছে। এই ক্ষয় রোধ করতে যে পদক্ষেপ করার কথা ছিল, তা বাস্তবায়িত হয়নি বলেই মনে করছেন ইয়েচুরি। তাঁর কথায়, ‘নির্বাচনী পরাজয়ের অন্যতম কারণ হলো পার্টির গণভিত্তি হ্রাস। যে ভুলগুলি আগেই পার্টিতে আলোচিত হয়েছে, তা অতিক্রম করা যায়নি। ভুলকে উপলব্ধি করার ব্যর্থতা আরও বড় ভুলের জন্ম দেয়।’ এই পরিস্থিতিতে নবীন প্রজন্মের হাতে দায়িত্ব তুলে দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন সিপিএম সাধারণ সম্পাদক। তিনি বলেন, ‘যে তরুণরা আমাদের চারপাশে এসেছেন তাঁরা আমাদের সম্পদ। এঁদের যত্ন করতে হবে। পার্টি কাঠামোর মধ্যে নিয়ে আসতে হবে। তাঁদের দায়িত্ব দিতে হবে।’
নির্বাচনের ফলে রাজ্যে বামেরা মুছে গেলেও এই অতিমারীর মধ্যে একদল তরুণ মুখ রেড ভলান্টিয়ার (Red Volunteer) হয়ে দৌড়ে বেড়াচ্ছেন। সীতারাম ইয়েচুরি এবং সূর্যকান্ত মিশ্র এই তরুণদের দ্রুত দায়িত্বে নিয়ে যাওয়ার পক্ষে সওয়াল করেছেন। ‘পরিচিতি’র প্রশ্নেও দলকে সক্রিয় হওয়ার দাওয়াই দিয়েছেন সীতারাম। বিজেপিকে ঠেকাতে সংযুক্ত জোট অব্যাহত রাখার পক্ষেও সওয়াল করেছেন সীতারাম। তিনি বলেছেন, ‘পার্টির ২২তম কংগ্রেসে বলা হয়েছে, বিজেপিকে পরাস্ত করাই মূল লক্ষ্য। সেই লক্ষ্যে ধর্মনিরপেক্ষ শক্তির ঐক্য গড়ে তুলতে হবে। রাজ্যেও এই ঐক্যের চেষ্টা অব্যাহত রাখা উচিত। কিন্তু কী ভাবে, তা নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে আলোচনা করতে হবে।’