সৃজিত-অভিষেকদের হাত ধরে নতুন আঙ্গিকে সত্যজিতের গপ্পো
সত্যজিৎ রায়। গোটা দুনিয়া যার বানানো ছবির গুণমুগ্ধ ভক্ত, তিনি যে বহুমুখী প্রতিভা ছিলেন, তা কারোরই অজানা নয়। বিশেষ করে ওনার লেখা ছোটগল্পগুলি আজও পাঠককূলে বহুলচর্চিত, এবং লালমোহনবাবুর কথা ধার করলে, ‘সেলিং লাইক হট কচুরি’। তাই তো, মানিকবাবুর জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে যখন নেটফ্লিক্স ‘রায় বাহাদুরের’ লেখা গল্প নিয়ে নতুন একটি ওয়েব সিরিজ ঘোষণা করল উন্মাদনার পারদ তখনই চড়তে শুরু করেছিল। ‘রে’ কতটা জাস্টিস করল সত্যজিতের গপ্পের সাথে? এটাই ছিল দর্শকদের প্রধান কৌতূহল। আর সত্যজিতের ভক্ত হিসেবে স্বীকার করাই যায়, লেটার পেয়ে পাশ করেছে নেটফ্লিক্স।
‘রে’ (Ray) ওয়েবসিরিজে মোট চারটি এপিসোড আছে। ‘বিপিন চৌধুরীর স্মৃতিভ্রম’ অবলম্বনে সৃজিত মুখোপাধ্যায় (Srijit Mukherji) পরিচালিত ‘ফরগেট মি নট’, ‘বহুরূপী’ অবলম্বনে ‘বহুরূপিয়া’; পরিচালনায় আবার সৃজিত মুখোপাধ্যায়। বাকি দুটি এপিসোড যথাক্রমে ‘বারীন ভৌমিকের ব্যারাম’ অবলম্বনে অভিষেক চৌবের ‘হাঙ্গামা কিউ হ্যায় বরপা’ এবং ‘স্পটলাইট’ অবলম্বনে ভাসান বালার একই নামের ছবি। তুলনামূলকভাবে ভাসান বালা অন্য দুই পরিচালকের তুলনায় দুর্বল কাজ করেছেন। ‘ফরগেট মি নট’ এবং ‘হাঙ্গামা কিউ হ্যায় বরপা’ এই সিরিজের সেরা দুই কাজ।
প্রথমেই আসি ‘ফরগেট মি নট’ এর প্রসঙ্গে। বিপিন চৌধুরী এখানে ইপ্সিত রামা নায়ার। মুম্বইয়ের কর্পোরেট দুনিয়ার এক উঠতি নাম। কম্পিউটারের মত তাঁর স্মৃতিশক্তি। কিন্তু, হঠাৎ এক রহস্যময়ী নারীর আগমনে ওনার সাজানো বাগান তছনছ হয়ে যায়। অতীতের কর্মফল ভোগ করতে হয় তাঁকে। সাজিদের চিত্রনাট্য এবং সৃজিতের পরিচালনা সত্যজিতের এই কালজয়ী ছোটগল্পকে চিরকালীন করে তুলেছে। তাঁর সাবলীল ছোঁয়ায় মানুষের মনের অন্ধকার জগৎটা ফুটে উঠেছে অসামান্য রূপে। বিশেষ করে ক্লাইম্যাক্সে নিজের স্বকীয়তার ছাপ রেখেছেন পরিচালক। অভিনয়ে আলি ফজল মন কেড়ে নেবেন দর্শকের। আনুসাঙ্গিক আলোকসজ্জা এবং আবহ সঙ্গীত আরও মনোগ্রাহী করে তুলেছে ছবিটিকে।
‘হাঙ্গাবা হ্যায় কিউ বরপা’র (Hungama Hai Kyon Barpa) তে সত্যজিতের অনুপ্রেরণা স্পষ্ট। চিত্রনাট্যের পরতে পরতে মূল গল্পের উইট আর হিউমারকে নতুন আঙ্গিকে মেলে ধরেছেন পরিচালক। দুই ক্লিপ্টোম্যানিয়্যাকের গল্পের সঙ্গে সাসপেন্স জড়িয়ে রাখাটা কম কঠিন কাজ নয়। সেই কঠিন কাজটি অভিষেক নিপুণভাবে করেছেন, একদম মানিকিবাবুর স্টাইলেই। শেষের চমকটিও বেশ অভাবনীয়। পাশাপাশি, দুই অভিনেতা মনোজ বাজপেয়ী এবং গজরাজ রাওয়ের কমিক টাইমিংয়ের প্রশংসা না করলেই নয়। সাথে, ছবিতে ব্যবহৃত উর্দূ গজল ও শেরের নিপুণ ব্যবহার। সত্যজিৎ যে স্থান, কাল, ভাষার চেয়েও বড় ছিলেন, তাঁর প্রমাণ এই ছবি।
‘বহুরূপী’ অবলম্বনে তৈরি সৃজিতের দ্বিতীয় ছবি ‘বহুরূপিয়া’ (Bahrupiya)। প্রথমটির তুলনায় এটি আরও বেশি অন্ধকারময়। একজন সাধারণ ছাপোষা কেরানি, যিনি আবার মেকআপ আর্টিস্টের কাজও করেন, কিছুটা আত্মশ্লাঘার বশে অন্ধকার পথে চালিত হন। অফিস বসের বাজে ব্যবহারের প্রতিশোধ নিতে প্রস্থেটিক মেকআপ ব্যবহার করে গর্হিত অপরাধ করে বসেন তিনি। আর শেষ পর্যন্ত নিজেরই সর্বনাশ ডেকে আনেন। ‘বহুরূপী’ ইন্দ্রশীষের ভূমিকায় কে কে মেনন অনবদ্য। চরিত্রের মস্তিষ্কের অন্ধকার দিকটা অক্লেশে ফুটিয়ে তুলেছেন তিনি। কিন্তু এই গল্পের সমস্যা হল এর দৈর্ঘ্য। কিছুটা মেদ কমালে হয়তো জমে যেত পুরো। আর, সত্যজিতের এই গল্পে ভিঞ্চিদার ছায়াটা যেন অত্যাধিক বেশি মনে হল। মোটের ওপর ভালো।
সিরিজের শেষ এপিসোড ‘স্পটলাইট’-এ মূল গল্প থেকে অনেকটাই সরে এসেছেন পরিচালক ভাসান বালা। একজন উঠতি ফিল্ম স্টারের ক্যারিশমার সঙ্গে সংঘাত এক ধর্মীয় গুরুর। একই হোটেলে উঠেছেন দু’জনে। এবং এই অভিনেতার স্পটলাইটটা যেন হঠাৎ হাইজ্যাক করে ফেলেছেন গুরু ‘দিদি’। একজন শিল্পীর আবেগ, নাকি একজন ধর্মীয় গুরুর প্রভাব – কোনটা বেশি শক্তিধর, সেটা নিয়ে দুর্দান্ত স্যাটায়ার তৈরি করেছিলেন সত্যজিৎ রায়। কিন্তু পরিচালক হাসান বালা অন্তর্নিহিত আর্থটাকেই হয়তো অনুধাবন করতে পারেননি। ফলে, ছবিটি এক ধরনের খিচুড়ি হয়েছে। আর ছবি জুড়ে একগুচ্ছ রেফারেন্স। এমনকি একটি দৃশ্যে ভূতের রাজার মত এক ‘দেবী’ রুপী মহিলা আবির্ভূতা হয়ে অনর্গল মানিকবাবুর ছবির নাম মুখস্ত বলে গেলেন। খুব দরকার ছিল কি? এই ছবির চরিত্রের সংলাপ ধার করলে, সত্যিই “কাফকেস্ক”ই বটে!
মন্দের ভালো এই যে ‘রে’ সিরিজের দৌলতে সত্যজিৎ রায়ের ছোটগল্প বাংলার গণ্ডি পেরিয়ে সারা বিশ্বের দর্শকের কাছে পৌঁছে যাবে। এটাই পাওনা।