দাদাসাহেব ফালকে – সত্য়িই ভারতীয় সিনেমার জনক?
কী করে সিনেমা এল, সেটার ইতিহাস পৃথিবীর সব দেশেই একটু গোলমেলে। কারণ, সিনেমা তো শিল্প হিসেবে পৃথিবীতে আবির্ভূত হয়নি, এসেছিল নিতান্ত বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে। সত্যি বলতে কী, প্রথমযুগে শ্রমজীবী তথাকথিত নিম্নবর্গীয় মানুষদের চিত্তহরণের কৌশল ছিল সিনেমা। উনিশ শতকের শেষের দিকে মানে ১৮৯৫ সালের ২৮ ডিসেম্বর ফরাসি দেশে প্রথম চলচ্ছবি এল।
লুমিয়ের ভ্রাতৃদ্বয়ের সৌজন্যে যে চলমান ছবি দেখানো হল, আজকের যুগে কাহিনীচিত্র বলতে যা বোঝায় সেই চিত্রমালা কিন্তু সেটা ছিল না। সেখানে কিছু খণ্ডদৃশ্য ছিল। শব্দ ছিল না। মানুষ মোহিত হয়েছিল এটা ভেবেই যে, ছবি চলতে পারছে, কিছু বোঝাতে পারছে। তখন সিনেমা ছিল সার্কাস বা ভানুমতীর খেলার মতো তাৎক্ষণিক মজার বিষয়।
ভারতে ছবি কবে এল? ইতিহাস আমাদের বলে, ১৮৯৬ সালের ৭ জুলাই বোম্বে শহরের অধুনালুপ্ত ওয়াটসন হোটেলে লুমিয়ের ভাইদের ছবি দেখানো হয়। ছবির দাম চড়া (তখনকার যুগে এক টাকা) থাকায় কিছু ইংরেজ অফিসার ও উচ্চপদস্থ ভারতীয় ছাড়া সেই অনুষ্ঠান কেউ দেখতে পারেননি। রহস্যজনক কারণে সেই ছবি কলকাতায় আসেনি। এই শহরে ছবি আসতে আরও একটা বছর অপেক্ষা করতে হল।
১৮৯৭ সালের ২০ জানুয়ারি চৌরঙ্গীর অধুনালুপ্ত রয়্যাল থিয়েটারে কলকাতায় প্রথম চলচ্চিত্র প্রদর্শিত হয়। খবরের কাগজের বিজ্ঞাপন থেকে এই তথ্য মেলে। বিংশ শতাব্দীর শুরু থেকেই কলকাতায় ছবি তৈরি শুরু হয়ে যায় এবং তা শুরু করেন হীরালাল সেন। সেই ছবিগুলি ছিল দলিলচিত্র বা বিজ্ঞাপনচিত্র। এই রকম কাজ মহারাষ্ট্রে হরিশ্চন্দ্র ভাতভদেকরও করেছিলেন। জুহু সাগরতটের বক্সিংয়ের কিছু ছবি তিনি তুলে ছিলেন।
সিনেমাকে কাহিনী হয়ে উঠতে আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হয়েছিল। সেই অপেক্ষা করার ইতিহাসে আমাদের প্রথম মাইল স্টোন দাদাসাহেব ধুন্দিরাজ ফালকে। এই প্রসঙ্গে একটা বিতর্ক অবশ্যই থাকবে যে, প্রথম ছবি কে তৈরি করেছিলেন? দাদাসাহেব ফালকে না হীরালাল সেন? হীরালাল প্রসঙ্গে আমরা যা তথ্য পাই, তাতে ক্ষীরোদপ্রসাদ বিদ্যাবিনোদের নাটকগুলি (ভ্রমর, আলিবাবা) যখন কলকাতার ক্লাসিক থিয়েটারে অভিনীত হয়েছিল, তখন ক্যামেরা বসিয়ে এর কিছু অংশ রেকর্ড করেছিলেন তিনি। সেগুলিকে এক অর্থে কাহিনীচিত্র বলা গেলেও যেতে পারে।
সেদিক থেকে দেখলে দাদাসাহেব ফালকের ‘রাজা হরিশ্চন্দ্র’কে প্রথম আখ্যানচিত্র বলার যথেষ্ট যুক্তি রয়েছে। যে বছর রবীন্দ্রনাথ নোবেল পুরস্কার পেলেন, সে বছরই এই ছবি জনসাধারণের সামনে প্রদর্শিত হয়। এটাকেই ঐতিহাসিকরা মোটামুটি ভারতীয় ছবির প্রদর্শনের জন্মক্ষণ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন। এটাই আমাদের প্রথম কাহিনীচিত্রে পদাতিক হওয়া।
এ ক্ষেত্রে আর একটা প্রসঙ্গ চলেই আসে, দাদাসাহেব ফালকে সত্যিই ভারতে প্রথম কাহিনীচিত্র তৈরি করেছিলেন কি না? এ বিষয়েও যথেষ্ট বিতর্কের অবকাশ রয়েছে। কেন না তথ্য আমাদের জানাচ্ছে যে, ‘রাজা হরিশ্চন্দ্র’ মুক্তি পাওয়ার অন্তত এক বছর আগে ১৯১২ সালের ১৮ মে মুক্তি পেয়েছিল শ্রীরামচন্দ্র গোপাল তোরণের তত্ত্বাবধানে তৈরি ২২ মিনিটের ছবি ‘শ্রীপুণ্ডলিক’। অর্থাৎ এই ছবিটিই ভারতের প্রথম চলচ্চিত্র। যদিও মনে করা হয়, এটা একটা নাটকেরই অংশ। অর্থাৎ এর এক বছর পর প্রদর্শিত ফালকের ‘রাজা হরিশ্চন্দ্র’ ভারতের প্রথম পূর্ণাঙ্গ কাহিনীচিত্র।
সম্প্রতি ভারতীয় চলচ্চিত্র তথা বাংলার চলচ্চিত্রের জন্মমুহূর্ত নিয়ে অনেক বিতর্ক হয়েছে। কিন্তু, শুধু ভারতীয় সিনেমাই নয়, ভারতীয় জাতীয়তাবাদের সঙ্গে দাদাসাহেবের নাম অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িয়ে গিয়েছে। তাই ফালকের নাম ইতিহাসে উৎকীর্ণ থাকবে।