পেগাসাসের তালিকায় নাম ছিল অনিল আম্বানি ও প্রাক্তন সিবিআই অধিকর্তার
রাহুল গাঁধীর অভিযোগ ছিল, ‘মিত্র’ শিল্পপতি অনিল অম্বানীকে রাফাল চুক্তিতে বরাত পাইয়ে দিয়েছেন নরেন্দ্র মোদী। পেগাসাস-কাণ্ডের (Pegasus) নতুন তদন্ত রিপোর্ট জানাল, কংগ্রেস নেতা রাহুলের ফোন যেমন হ্যাকিংয়ের জন্য নিশানা করা হয়েছিল, একই ভাবে আড়ি পাতার চেষ্টা হয়েছিল রিলায়্যান্স এডিএ গোষ্ঠীর কর্ণধার অনিল অম্বানীর (Anil Ambani) ফোনেও। রিলায়্যান্স গোষ্ঠীর অন্যতম কর্তা টোনি জেসুদাসন, রাফাল-নির্মাতা ফরাসি সংস্থা দাসোর ভারতীয় কর্তা বেঙ্কট রাও পোসিনা ও বোয়িংয়ের মতো আরও কয়েকটি প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম নির্মাতার প্রধানদের ফোনও নিশানা করা হয়েছিল।
এখানেই শেষ নয়। তিন বছর আগে তৎকালীন সিবিআই ডিরেক্টর অলোক বর্মার ফোন পেগাসাস স্পাইওয়্যায়ের মাধ্যমে হ্যাক করার তালিকায় এসেছিল। তাৎপর্যপূর্ণ হল, বর্মা রাফাল চুক্তিতে তদন্তের নির্দেশ দিতে পারেন বলে মোদী সরকারের অন্দরমহলে আশঙ্কা তৈরি হয়েছিল। বর্মাকে সরিয়ে প্রধানমন্ত্রীর আস্থাভাজন বলে পরিচিত রাকেশ আস্থানাকে সিবিআই শীর্ষ পদে বসানোর চেষ্টা হয়েছিল। বর্মা-আস্থানা সংঘাত চরমে ওঠায় ২০১৮ সালের ২৩ অক্টোবর রাতে বর্মা ও আস্থানা, দু’জনকেই ছুটিতে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয় মোদী সরকার। তারপরেই বর্মা, তাঁর স্ত্রী, মেয়ে, জামাইয়ের ফোন-নম্বর হ্যাকিংয়ের জন্য তৈরি তালিকায় উঠে যায়। বাদ যায়নি আস্থানার নম্বরও।
বৃহস্পতিবার আরও জানা গিয়েছে, তিব্বতি ধর্মগুরু দলাই লামার ঘনিষ্ঠ বৃত্তের একাধিক ব্যক্তির ফোনও নিশানায় ছিল। এর মধ্যে সপ্তদশ কর্মপা ওগিয়েন ট্রিনলে দোর্জি, দিল্লিতে দলাই লামার দীর্ঘদিনের দূত টেমপা সেরিং, পরবর্তী দলাই লামা (Dalai Lama) খোঁজার দায়িত্বপ্রাপ্ত ট্রাস্টের প্রধান সমধং রিনপোচে, তিব্বতি সরকারের প্রাক্তন প্রধান লোবসাং সাংগে-সহ দলাই লামার বেশ কয়েক জন ঘনিষ্ঠ রয়েছেন।
সিবিআইয়ের কাছে সরকারের অনুমতি সাপেক্ষে ফোনে আড়ি পাতার ক্ষমতা রয়েছে। এত দিন বিরোধীরা অভিযোগ তুলেছেন, ওই কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থাকে মোদী সরকার বিরোধীদের বিপাকে ফেলতে কাজে লাগাচ্ছে। সেই সিবিআইয়েরই ডিরেক্টরের ফোনে কারা আড়ি পাতার চেষ্টা করেছিল? ইজরায়েলি সংস্থা এনএসও জানিয়েছে, তারা ফোনে আড়ি পাতার পেগাসাস স্পাইওয়্যার শুধুমাত্র বিভিন্ন দেশের সরকারকে বেচেছিল। ফলে প্রশ্ন, সিবিআই প্রধানের ফোনে আড়ি পাততে কি আর একটি কেন্দ্রীয় সংস্থাকে কাজে লাগানো হয়েছিল? এর আগে জানা গিয়েছিল, সাংবাদিক সুশান্ত সিংহ যখন রাফাল-চুক্তি নিয়ে খোঁজখবর করছিলেন, সেই সময়ে তাঁর ফোনও পেগাসাসে হ্যাক করার চেষ্টা হয়েছিল।
বিরোধীদের মতে, প্রাক্তন সিবিআই ডিরেক্টর বর্মাকে নিয়ে মোদী সরকারের মধ্যে আশঙ্কা থাকতে পারে। ভারতের সঙ্গে ফ্রান্সের ৩৬টি রাফাল যুদ্ধবিমান কেনার চুক্তির পরেই অভিযোগ ওঠে, চুক্তির অংশ হিসেবে মোদী সরকার রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা হ্যাল-এর বদলে অনিল অম্বানীর সংস্থাকে বরাত পাইয়ে দিয়েছে। বর্মার কাছে রাফাল চুক্তিতে দুর্নীতির অভিযোগ জানিয়ে বাজপেয়ী সরকারের মন্ত্রী অরুণ শৌরি সমস্ত নথি জমা দিয়েছিলেন। মোদী সরকার রাফাল চুক্তিতে দুর্নীতি হয়নি বলে দাবি করলেও, বর্মা তদন্তের দাবি খারিজ করে দেননি। কিন্তু দলাই লামার ঘনিষ্ঠদের উপরে নজরদারির কী কারণ? চিনকে চাপে রাখতে দলাই লামা ভারতের কাছে ‘কূটনৈতিক সম্পদ’। তবে কি প্রধানমন্ত্রী মোদী কি কাউকেই বিশ্বাস করতে পারেন না?
এনএসও বহু দেশকে ফোন হ্যাক করার সরঞ্জাম বেচেছিল। সেই তথ্যভাণ্ডার থেকে সম্প্রতি ৫০ হাজার ফোন নম্বরের তালিকা ফাঁস হয়েছে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, ভারত-সহ বিভিন্ন দেশের সংবাদমাধ্যম তার তদন্তে নামায় দেখা গিয়েছে, ওই তালিকায় কেন্দ্রীয় মন্ত্রী থেকে বিরোধী দলনেতা, সাংবাদিক থেকে নির্বাচন কমিশনারের নাম রয়েছে।
পেগাসাস নিয়ে আজও সংসদ অচল ছিল। কংগ্রেস সুপ্রিম কোর্টের নজরদারিতে বিচারবিভাগীয় তদন্ত দাবি করেছে। একই দাবি নিয়ে সুপ্রিম কোর্টে এ দিন এক আইনজীবী মামলা দায়েরও করেছেন। কংগ্রেস স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের ইস্তফা দাবি করেছে। প্রধানমন্ত্রী আজ সংসদে প্রবীণ মন্ত্রীদের সঙ্গে বৈঠক করেন। সূত্রের দাবি, সেখানে পেগাসাস-কাণ্ডে সংসদের অচলাবস্থার প্রসঙ্গ ওঠে। লোকসভায় হট্টগোলের মধ্যে প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে কর্মীদের ধর্মঘট রুখতে যে অধ্যাদেশ জারি হয়েছিল, তাকে আইনের চেহারা দেওয়ার বিল পেশ হয়।
পেগাসাস-কাণ্ডে জল ঢালতে বিজেপি প্রচার করেছে, এই তদন্তের সঙ্গে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের কোনও যোগ নেই। নতুন বিদেশ প্রতিমন্ত্রী মীনাক্ষি লেখি বলেন, অ্যামনেস্টি নিজেই এ কথা জানিয়েছে। কিন্তু এর পরেই একে ‘মিথ্যে প্রচার’ আখ্যা দিয়ে অ্যামনেস্টি জানায়, তারা পেগাসাসের তদন্তের সঙ্গেই রয়েছে।