বিবিধ বিভাগে ফিরে যান

শ্রমিকের ক্ষতে বেআব্রু উপেক্ষা

May 1, 2020 | 3 min read

অনিশ্চয়তায় ভরা নেই-রাজ্যের বাসিন্দা ওঁরা। অথচ বাড়ির নিত্যকর্ম থেকে শহরের আকাশছোঁয়া ইমারত গড়া, সেই ইমারত পাহারা থেকে রেললাইন পাতা বা রাস্তা তৈরি-শীর্ণ চেহারার দেহাতি নারী-পুরুষের শ্রমশক্তি নিংড়েও আমরা ওঁদের এত দিন না-দেখারই ভান করে এসেছি। করোনা-লকডাউন এই উদাসীন সমাজকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে আয়নার সামনে।

কাজের খোঁজে, একটু বেশী রোজগারের আশায় দেশের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা পরিযায়ী শ্রমিকদের নিয়ে ভাবনায় খামতি নিদারুণ ভাবে প্রকট হয়েছে এই সময়ে। কেন্দ্র হোক বা রাজ্য, কোনও সরকারের কাছে ন্যূনতম তথ্যটুকুও নেই এঁদের ব্যাপারে। আবার তথ্যের এই আকালে পরিযায়ী শ্রমিকদের নিয়ে গবেষণা, সমীক্ষাতেও খামতি তৈরি করেছে।

কিছুটা তথ্যভাণ্ডার থাকায় করোনা-পর্বে তো বটেই, আগেও নানা সঙ্কটের মুহূর্তে কেরালা, বিহার এবং খানিকটা দিল্লি উপকৃত হয়েছে। কেরালায় কাজের খোঁজে ভিন রাজ্যে যাওয়ার প্রবণতা কম থাকলেও অনেকেই পশ্চিম এশিয়ায় কাজে যান। সে রাজ্যে এই সংক্রান্ত তথ্য ও কাজের সমন্বয়ের জন্য রয়েছে আলাদা দপ্তরও। কিন্তু বাকি দেশের সঙ্গে বাংলার ছবিটাও সন্তোষজনক নয়। অথচ পরিযায়ী শ্রমিক সরবরাহে বিহার, ছত্তিসগড়, ঝাড়খণ্ডের পরেই রয়েছে পশ্চিমবঙ্গ।

ইনস্টিটিউট অফ ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ, কলকাতার অধিকর্তার মতে, ‘কিছু বিক্ষিপ্ত কাজ ছাড়া পরিযায়ী শ্রমিকদের নিয়ে তেমন কোনও গবেষণা, সমীক্ষার কাজ এ রাজ্যে নেই। উৎসাহী কিছু গবেষক, এমফিল স্কলার কিছু কাজ করেছেন হয়তো। কিন্তু তা সামান্যই।’ 

বছরখানেক আগে রাজ্য শ্রম দপ্তর ঠিক করেছিল কেরালা, বিহারের মতো এ রাজ্য থেকে ভিন রাজ্যে যাওয়া পরিযায়ী শ্রমিকদেরও তথ্যভাণ্ডার গড়ে তোলা হবে। হবে রাজ্যব্যাপী সমীক্ষা। ম্যাপিং করা হবে কোন জেলা থেকে কারা কোথায় কাজের খোঁজে পা দিচ্ছেন। কিন্তু সেই পরিকল্পনা আর এগোয়নি। 

খামতির কথা স্বীকার করেই শ্রমমন্ত্রী মলয় ঘটক বলেন, ‘কেন্দ্র বা রাজ্য, কারও কাছেই পরিযায়ী শ্রমিকদের নিয়ে কোনও তথ্যভাণ্ডার সে ভাবে নেই। তবে করোনার সময় সারা দেশে যে ভাবে আটকে পড়া পরিযায়ী শ্রমিকদের কথা উঠে এল, তাতে আগামী দিনে এই কাজে উদ্যোগ নিশ্চয়ই বাড়বে।’

কেন্দ্র বা রাজ্য, কারও কাছেই পরিযায়ী শ্রমিকদের নিয়ে কোনও তথ্যভাণ্ডার সে ভাবে নেই

রাজ্যের দুই অধ্যাপক-গবেষক তুষার নন্দী, শৈবাল কর অনেক কষ্ট করে তথ্য সংগ্রহ করে পরিযায়ী শ্রমিকদের নিয়ে সম্প্রতি গবেষণা শেষ করেছেন। লকডাউনে আটকে পড়া দুর্দশাগ্রস্ত পরিযায়ী শ্রমিকদের খবর সামনে আসতেই জরুরি ভিত্তিতে একটি ইবুক প্রকাশ করেছে ক্যালকাটা রিসার্চ গ্রুপ (সিআরজি)। এই সময়ে দেখা গেল, এক দিকে ভাইরাসের আতঙ্ক, অন্য দিকে খিদে-এই দুইয়ের শিকার লক্ষ লক্ষ মানুষ। তাঁদের নিয়ে স্পষ্ট নীতি কোথায়-প্রশ্ন তোলা হয়েছে সিআরজি-র বইতেও।

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির প্রবীণ অধ্যাপক অজিতাভ রায়চৌধুরীর কথায়, ‘আজ থেকে ২০-২৫ বছর আগেও পরিযায়ী শ্রমিকদের নিয়ে সিরিয়াস কাজ হত। পরে সেই গবেষণার খাতে অর্থ আসা ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যাওয়ায় উৎসাহ কমেছে।’ 

অজিতাভর আক্ষেপ, ‘আমরা জানতেই পারলাম না গত দু’দশকে পরিযায়ী শ্রমিকদের অবস্থা কেমন, তাঁরা কোথায় কাজ করেন, কেমন আছেন। এই বাংলার গ্রামীণ অর্থনীতিতে তাঁদের ভূমিকাই বা কতটা।’ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের প্রধান অরিজিতা দত্ত এর জন্য সরকারি তথ্য না পাওয়াকেই কাঠগড়ায় তুলেছেন। তাঁরা জানাচ্ছেন, পরিযায়ী শ্রমিকদের নিয়ে গত জনগণনার (২০১১) সম্পূর্ণ তথ্যও এখনও প্রকাশিত হয়নি।

সংবাদমাধ্যমেও সাধারণ ভাবে আলোচনার বাইরেই থেকে গিয়েছে ওঁদের জীবন। চলতি লকডাউনের সময়েও যতক্ষণ না পর্যন্ত নিরন্ন পরিযায়ী শ্রমিকরা পায়ে হেঁটে বাড়ির দিকে রওনা দিলেন বা খাবারের জন্য বিক্ষোভ দেখালেন, ততক্ষণ সংবাদমাধ্যমের ভাবনাতেও ঠাঁই পাননি ওঁরা। 

বর্ষীয়ান সাংবাদিক রজত রায়ের বক্তব্য, ‘নব্বই দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত সংবাদমাধ্যমে লেবার বিট বলে একটি বিষয় ছিল। একাধিক সংবাদদাতা শ্রমজীবীদের নিয়ে খবর পরিবেশন করতেন। যা পরে উঠে যায়। কারণ সংবাদমাধ্যম লেবার বলতে বুঝত কেবল সংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকদের। বিশ্বায়নের পর শ্রমের যে সংজ্ঞাটাই গেল বদলে!’ নির্মাণশিল্প, নানা কলকারখানা, ছোট-মাঝারি শিল্প, বাজারহাটে কাজ করা অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকদের সংবাদ কোনও দিনই সে ভাবে উঠে আসেনি গণমাধ্যমে।

তবে বর্তমান পরিস্থিতি অনেককেই ভাবাতে শুরু করেছে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগ যেমন পশ্চিমবঙ্গ, বিহারের পরিযায়ী শ্রমিকদের ব্যাপারে গবেষণা শুরু করতে চলেছে। অর্থনীতিবিদ সুগত মারজিৎ মনে করেন, ‘এই সঙ্কটের সময় জানিয়ে দিল, সারা দেশে ছড়িয়ে থাকা এই মানুষগুলোর জন্য আপৎকালীন ব্যবস্থা প্রায় কিছু নেই বললেই চলে। সেই ব্যবস্থার রূপরেখা কী হতে পারে, এখন সেটাই সব চেয়ে বড় বিচার্য হওয়া উচিত।’ 

তাঁর বক্তব্য, ‘করোনা এই সংক্রান্ত গবেষণার ভাবনায় রসদ জুগিয়ে দিল।’

TwitterFacebookWhatsAppEmailShare

#migrant workers, #future, #no record

আরো দেখুন