রক্ত পরীক্ষাতেই ধরা পড়বে সর্পদংশন, যুগান্তকারী আবিষ্কারী দলে দুই বঙ্গসন্তান
যদি দুশমনকে চিহ্নিত করা যায়, বধ করার হাতিয়ার বাছতে কতক্ষণ? প্রয়োগ করে শত্রুকে পেড়ে ফেলা তো শুধু সময়ের অপেক্ষা! বিশেষত পাল্লা যেখানে ঘড়ির কাঁটার সঙ্গে, সেই সর্পাঘাতের ক্ষেত্রে এমনটা হওয়া মানে আকাশের চাঁদ হাতে পাওয়া। বাস্তবে তেমনটাই হবে। সাপে কাটা রোগীর এক ফোঁটা রক্ত পেপার স্ট্রিপে ফেলেই চিহ্নিত হয়ে যাবে বিষের চরিত্র, প্রয়োগেও দেরি হবে না।
কার্যত যুগান্তকারী এহেন আবিষ্কারের মাধ্যমে সর্পাঘাতের (Snake Bite) চিকিৎসায় বিপ্লব এনে দিলেন একদল ভারতীয় বিজ্ঞানী। তৈরি করলেন নতুন ইতিহাস। বাস্তবিকই আকাশের চাঁদ পেড়ে এনে দিলেন চিকিৎসকদের হাতে। গ্রামেগঞ্জে কালাচ সাপের রহস্য-দংশনের জাল কেটে রোগীর প্রাণ বাঁচানো যাঁদের সামনে হামেশা মস্ত চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। হ্যাঁ, কালাচ। কামড়ালে জ্বালা-যন্ত্রণার বালাই নেই, শুধু কয়েক ঘণ্টা বাদে কথা জড়িয়ে যায়, চোখ ঢুলুঢুলু। কখনও পেটে সামান্য ব্যথা। এই সব উপসর্গ অনেক সময় চোখ এড়িয়ে যায়। এমনকী, ডাক্তারদের অভিজ্ঞ চোখও ধোঁকা খায়। বারবার এর প্রমাণ মিলেছে। কালাচ দংশনের এই জবরদস্ত রহস্যময়তাই চিকিৎসায় সবচেয়ে বড় সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধক। কালাচের ছোবল দেরিতে মালুম হওয়ায় বহু ক্ষেত্রেই রোগী হাসপাতালে যাওয়ার আগেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। এই বর্ষাতেও বহু মানুষের প্রাণ কেড়েছে কালাচ।
এই সমস্যারই সুরাহা হতে চলেছে। এবার আর চোখে দেখা উপসর্গের উপর ভরসা করতে হবে না, রক্তপরীক্ষাতেই জেনে নেওয়া যাবে, রোগীর শরীরে কালাচের বিষ মজুত রয়েছে কি না। সিস্টেম্যাটিক ইভোল্যুশন অফ লিগান্ডস বাই এক্সপোনেন্সিয়াল এনরিচমেন্ট (সেলেক্স) প্রযুক্তি ব্যবহার করে এই অসাধ্যসাধন করেছেন একদল ভারতীয় বিজ্ঞানী-গবেষক। যাঁদের মধ্যে রয়েছেন দু’জন বঙ্গসন্তান- বিশাল সাঁতরা ও বন্ধন চট্টোপাধ্যায়। ভারতের পাঁচটি অঞ্চল থেকে কালাচের বিষ সংগ্রহ করে টানা দু’বছর ধরে ওঁরা গবেষণা চালিয়েছেন। অবশেষে মিলেছে সাফল্য। গবেষণাপত্রটি বিশ্ববন্দিত এলসিভিয়ার প্রকাশনা সংস্থার ‘বায়োসেন্সরস অ্যান্ড বায়ো ইলেকট্রনিক্স’ জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। তারপরই গোটা বিশ্ব জুড়ে হইচই। ম্যাজিক ফর্মুলাটা কী?
সেলেক্স প্রযুক্তির দৌলতে হাই-এফিনিটিযুক্ত কতগুলো বিশেষ ছোট কৃত্রিম একতন্ত্রী ডিএনএ-কে (DNA) (এপ্টামার) চিহ্নিত করা হয়েছে, যাদের কাজে লাগিয়ে আক্রান্তের রক্তে ২ ন্যানো গ্রাম পর্যন্ত কালাচের বিষ নির্ভুলভাবে শনাক্ত করা যাবে। এই গবেষণার সবচেয়ে ইতিবাচক দিক হল, বিষ শনাক্ত তথা চিহ্নিতকরণের জন্য দামী সরঞ্জামের বদলে ব্যবহার করা হয়েছে সুলভ নাইট্রোসেলুলোজ পেপার-স্ট্রিপ ভিত্তিক প্রযুক্তি, যা কিনা ভারতের মত উন্নয়নশীল দেশের পক্ষে খুবই উপযোগী। গবেষক দলের বাকি সদস্যরা হলেন অঞ্জলি আনন্দ, অভিজিৎ ধীমান, রেনু গোয়েল, ঈশান খান, অনীতা মালহোত্রা, নীতিন সালভি, এম ভি খাদিলকর, ইরা ভাটনগর, অমিত কুমার, অমিত আস্থানা ও ডা. তরুণকুমার শর্মা। তরুণবাবু ‘সংবাদ প্রতিদিন’কে জানিয়েছেন, “সর্প বিষের চরিত্র নির্ণয় করতে এখন আমাদের ঘণ্টা দু’য়েক সময় লাগছে। এটা কমিয়ে দু’ মিনিট করার চেষ্টা চলছে। তবে, আমাদের গবেষণা তখনই পুরোপুরি সফল হবে, যখন হাসপাতালে আসা সর্পদ্রষ্ট রোগীর উপর এই স্ট্রিপ প্রয়োগ করা যাবে।”
চন্দ্রবোড়া, গোখরো, কেউটে কামড়ালে স্পষ্ট বোঝা যায়। প্রবল জ্বালা-যন্ত্রণার পাশাপাশি দংশনস্থল ফুলে যায়। ফলে এই তিন প্রজাতির বিষধরের দংশনের চিকিৎসায় সমস্যা নেই, যা পুরোমাত্রায় আছে কালাচের ক্ষেত্রে। কীরকম? সাপে কাটা রোগীর চিকিৎসা বিষয়ক প্রশিক্ষক ডা. দয়ালবন্ধু মজুমদার জানিয়েছেন, কালাচ খুবই রহস্যময় সাপ। বেশিরভাগ সময়ে রাতের অন্ধকারে বিছানায় উঠে কামড়ায়। কোনও জ্বালা-যন্ত্রণা হয় না, ফুলেও যায় না। ফলে অনেক সময় রোগী বুঝতেই পারেনা যে, সাপে কেটেছে। তার চিকিৎসায় একমাত্র ভরসা উপসর্গ, যা দেখা দিতে পারে একঘণ্টার মধ্যে, কখনও বা চব্বিশ ঘণ্টা পর। যতক্ষণে বোঝা যায়, ততক্ষণে হয়তো বিষজর্জর শরীর থেকে প্রাণ বেরতে দেরি নেই।
এবার আর উপসর্গের জন্য বসে থাকতে হবে না। ব্লাড টেস্ট করেই রোগীর চিকিৎসা শুরু করে দেওয়া যাবে। দয়ালবাবুর দাবি, এই আবিষ্কার চিকিৎসকদের অসহায়তা অনেকটাই কমিয়ে দেবে। সর্পদ্রষ্ট রোগীর মৃত্যুহার কমাবে। একই বক্তব্য প্রাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডা. সিদ্ধার্থ জোয়ারদারের। তাঁর মত, রক্তে কালাচের বিষের উপস্থিতি নিশ্চিতভাবে নির্ণয় করা গেলে রোগীকে দ্রুত অ্যান্টি স্নেক ভেনাম দিয়ে চিকিৎসা শুরু করা যাবে। বহু প্রাণ বাঁচানো সম্ভব হবে। তাই এই গবেষণালব্ধ ফল সমাজ জীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও সুদূরপ্রসারী। ওঁদের আবিষ্কৃত ডায়াগনস্টিক কিট বাজারে কবে পাওয়া যাবে, সেটাই এখন দেখার।