৩ মহামারীর সাক্ষী ১১০ বছরের প্রবীণ
বয়স তাঁর ১১০ বছর। স্মৃতির বয়সও সমান। দেখেছেন একাধিক মহামারী। পথে পড়ে থাকতে দেখেছেন মৃতদেহ। কিন্তু, কাঁকসার হারাধন সাহা করোনার মতো বিপর্যয় দেখেননি।
কাঁকসার মলানদিঘি পঞ্চায়েতের অধীন সরস্বতীগঞ্জ গ্রামের বাসিন্দা হারাধন। স্মৃতি মলিন হয়ে যায়নি তাঁর। মনে পড়ে কত কথা। তার মধ্যে রয়েছে মহামারীও। চল্লিশ থেকে পঞ্চাশের দশকে বৃদ্ধ দু’বার মহামারী দেখেছেন। এখন করোনার ভয়াবহতা দেখছেন। চারপাশের পৃথিবী হঠাৎ অনেকটা বদলে গিয়েছে। স্মৃতি হাতড়ে তিনি বলেন, ‘১৯৫০ সাল হবে সেটা। দেশ সবে স্বাধীন হয়েছে। কলেরা আর বসন্ত হয়েছিল। পরপর। সেই সময় এত ডাক্তার, হাসপাতাল ছিল না। রোগ হলে ভগবানই ভরসা ছিল। পুরোহিত ডেকে মানুষ পুজো-অর্চনা করত। এখন তো দেশে প্রচুর হাসপাতাল। তা সত্ত্বেও করোনাকে বাগে আনতে পারছে না।’
অনেক বসন্ত পার করেছেন হারাধন। নড়বড়ে হয়ে যাননি এখনও। বুধবার সকালে বাড়ির উঠোনে লাঠি হাতে ঘুরছিলেন। কানে একটু কম শোনেন বটে, কিন্তু এখনও মোটের উপর সুস্থই। গত লোকসভা ভোটের সময় নির্বাচন কমিশনের আধিকারিকরা সরস্বতীগঞ্জে এসে সবচেয়ে প্রবীণ ভোটার হিসাবে তাঁকে সংবর্ধনা দিয়ে যায়। ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার জন্য প্রশাসন থেকে গাড়ির ব্যবস্থা করা হয়েছিল। কিন্তু, হারাধন হেঁটে বুথে গিয়েছেন।
সরস্বতীগঞ্জ গ্রামেই তাঁর জন্ম। ব্রিটিশ আমলে ঠিকাদারির কাজ করতেন। পুকুর সংস্কার থেকে বন দপ্তরের কাজে ঠিকাদারি করেছেন। চাষের কাজও করতেন। জীবনে একাধিক মহামারী প্রত্যক্ষ করা বৃদ্ধ জানান, সরস্বতীগঞ্জে মহামারীর সময় ১৮ জনের মৃত্যু হয়েছিল। তাঁর ভাষায়, ‘সেই সময় গ্রামে এত বাড়িঘর ছিল না। লোকজনের সংখ্যা কম ছিল। মৃতদেহ দাহ করতে নিয়ে যাওয়ার মতো লোকজন পাওয়া যেত না। গ্রামের অদূরে জঙ্গলে মাটি খুঁড়ে দেহ পুঁতে দেওয়া হত।’ তখনও হাহাকার ছিল এখনকার মতই।
সাত মেয়ে ও চার ছেলের পিতা হারাধন। সকলেই বিবাহিত। বড় ছেলে শিবনারায়ণ দেড় বছর আগে মারা গিয়েছেন। মেজ ছেলে জয়নারায়ণ পেশায় চিকিৎসক। সেজ ছেলে রামনারায়ণ অ্যালয় স্টিল প্লান্টে চাকরি করেন। ছোট ছেলে রাজনারায়ণ দুর্গাপুর এনআইটি-তে অধ্যাপক। বড় ছেলের আগেও মৃত্যুশোক সামলাতে হয়েছে হারাধনকে। স্ত্রী তিলোত্তমা ৩৪ বছর আগে মারা গিয়েছেন। তা সত্ত্বেও জীবন থেমে থাকেনি। লকডাউনে বন্দি হয়ে যাওয়ায় একটু মনমরা। বৃদ্ধ বলেন, ‘তখন রোগের জন্য ঘরে বন্দি হয়ে থাকতে হয়নি। আমরা দেখেছি, মৃতদেহ পড়ে রয়েছে রাস্তায়। কান্নায় গ্রামের বাতাস ভারী হয়ে গিয়েছে। কিন্তু, এখন ঘর থেকেই বার হতে নিষেধ করছে। এমন মহামারী আগে দেখিনি। কলেরা, বসন্তর থেকেও ভয়ঙ্কর করোনা।’
এখন ঘরবন্দি থাকলেও যথেষ্ট সক্রিয় হারাধন। সারাদিন বাগানে গাছপালার যত্ন নেন। তবু আড্ডা, কীর্তন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় খারাপ লাগছে। কবে মন্দিরের দরজা খুলবে, লোকজনের সঙ্গে কথা বলতে পারবেন সেই অপেক্ষায় রয়েছেন তিনি। প্রশ্ন করেন, ‘বিজ্ঞান এত উন্নত হয়েছে, গবেষণা চলছে। তবু কেন মানুষ করোনা রুখতে পারছে না। কেন এখনও ওষুধ বেরোচ্ছে না।’ দীর্ঘশ্বাস ফেলেন বৃদ্ধ। ১১০ বছরের প্রবীণ এক নাগরিকের হতাশার সঙ্গে মিলে যায় বিশ্বজনীন সঙ্কটের ছবিটা।