আন্তর্জাতিক বিভাগে ফিরে যান

আফগানিস্তানে তালিবানদের দখলে আসতেই গৃহবন্দি মহিলারা

August 17, 2021 | 3 min read

রান সাহারা রান! দৌড়ও। দৌড়ও। হ্যাঁ, কাবুলের রাস্তা দিয়ে দৌড়চ্ছেন চলচ্চিত্র পরিচালক।

একটু আগেই তিনি ব্যাঙ্কে ছুটেছিলেন। ক্ষমতার পালাবদল হতে চলেছে, খবর পাওয়ামাত্রই বিপদ মাথায় নিয়ে ছুটেছিলেন। যাতে জরুরি পরিস্থিতিতে কিছু টাকা অন্তত হাতে থাকে। কিন্তু ব্যাঙ্কে যখন পৌঁছলেন সাহারা করিমি, তত ক্ষণে কাবুল দখল হয়ে গিয়েছে। জলপাই রঙের জিপে চেপে মেশিনগান উঁচিয়ে শহরে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন তালিবান যোদ্ধারা। বাইরের দৃশ্য দেখেই তড়িঘড়ি শাটার নামিয়ে দেন ব্যাঙ্ককর্মীরা। কোনও রকমে হাতের ব্যাগ টেনে পিছনের রাস্তা দিয়ে বেরিয়ে পড়তে লাগলেন একে একে। ‘‘কিন্তু আমার যে টাকা লাগবে,’’ — মরিয়া হয়ে এক জনকে শুধোলেন পেশায় চলচ্চিত্র নির্মাতা সাহারা। জবাব এল, ‘‘আগে প্রাণে বাঁচুন। তার পর টাকা।’’

উপায় না দেখে অগত্যা বেরিয়ে এলেন সাহারা। কিন্তু বাইরে তখন অন্য দৃশ্য। দুরন্ত গতিতে ছুটে আসা তালিবানের জিপ দেখে যে দিকে দু’চোখ যায়, ছুটছে মানুষ। তখনই ঠাহর হল, রাস্তাঘাটে মহিলা বলতে একা তিনি। সিনেমার লোক বলে এলাকার মানুষ মান্যিগন্যি করেন, কিন্তু শিল্প-সচেতন মানুষ হিসেবে তালিবানের নজরে তিনি ঘোর শত্রু। তাই আগুপিছু না ভেবে প্রাণপণে দৌড় লাগালেন নিজেও। অভ্যাসবশত মোবাইলের ক্যামেরায় কয়েক সেকেন্ডের সেই দৃশ্য বন্দি করে নিয়েছিলেন সাহারা। সেই ভিডিয়োই তালিবানি আফগানিস্তানে মহিলাদের অবস্থার প্রতিচ্ছবি হিসেবে ছড়িয়ে পড়েছে নেট দুনিয়ায়।

শুধু তাই নয়, কাবুলের দখল নেওয়ার ঢের আগেই কন্দহরের আজিজি ব্যাঙ্কে তালিবান-তাণ্ডব চলে বলে অভিযোগ। স্থানীয় সংবাদমাধ্যম সূত্রে খবর, ওই ব্যাঙ্কে কর্মরত ৯ জন মহিলাকে কার্যত ঘাড় দিয়ে ব্যাঙ্ক থেকে বার করে বাড়িতে ঢুকিয়ে দিয়ে আসে তালিবান। ভবিষ্যতে কোনও দিন যাতে কাজে ফেরার ‘দুঃসাহস’ না দেখান, এই বলে তাঁদের হুমকিও দেওয়া হয় বলে অভিযোগ। ব্যাঙ্কের অ্যাকাউন্টস বিভাগে কর্মরত ৪৩ বছরের নুর খতেরা সংবাদ সংস্থা রয়টার্সকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘‘কাজ করতে না পারাটা সত্যিই অদ্ভুত লাগছে। কিন্তু এখন এমনই পরিস্থিতি। কিচ্ছু করার নেই।’’ শুধু তাই নয়, কর্মক্ষেত্রে শুধু পুরুষদেরই নিয়োগ করতে হবে বলে ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষকে তালিবানের তরফ থেকে সাফ নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বলেও জানান নুর।

রবিবার তালিবানের হাতে কাবুল এসে যাওয়ার পর থেকে নেটমাধ্যমে বিশ্বের তাবড় রাষ্ট্রনেতাদের কাছে একাধিক আর্জি জানিয়েছেন আফগানিস্তানের মানবাধিকার কর্মী-সহ অনেকেই। বিশেষ করে তালিবান রাজত্বে মহিলাদের অবস্থা নিয়ে আন্তর্জাতিক সাহায্যের আর্জি জানিয়েছেন তাঁরা। কিন্তু দেশ-বিদেশের সংবাদমাধ্যমে গত ৪৮ ঘণ্টায় যত ছবি সামনে এসেছে কাবুলের, তাতে রাস্তাঘাটে মহিলাদের অনুপস্থিতি চোখে পড়ার মতো। একমাত্র ব্যতিক্রম অলিগলির বোরখার দোকানগুলি। তাদের রাজত্বে মহিলাদের কী কী শিষ্ঠাচার মেনে চলতে হবে, আগেই তার লিখিত বিজ্ঞপ্তি জারি করে দিয়েছে তালিবান। মাথার চুল থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত আবৃত রাখতে বলা হয়েছে সকলকে। তাই খোলা বাতাস ছেড়ে ঘরের কোণে ঢুকে গেলেও, বোরখার প্রয়োজনীয়তা বুঝতে পারছেন আফগান মহিলারা।

কাবুল ইউনিভার্সিটিতে পাঠরত নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক তরুণী সংবাদমাধ্যম ‘দ্য গার্ডিয়ান’-কে বলেছেন, ‘‘রবিবার সকালে ইউনিভার্সিটি যাচ্ছিলাম। গেটের কাছে পৌঁছতেই দেখলাম ডর্মিটরি থেকে ছুটে বেরিয়ে আসছে আমার সহপাঠীরা। জিজ্ঞেস করে জানলাম,, পুলিশ কলেজ খালি করে দিচ্ছে। তালিবান এসে গিয়েছে। বোরখা না পরে থাকলে মহিলাদের মারধর করবে বলে হুমকি দিয়েছে। কিন্তু পালাব কোথায়? রিকশাচালকরাও মেয়েদের দায়িত্ব নিতে রাজি হচ্ছিল না। কাবুলের বাইরে থেকে যারা পড়তে এসেছিল, তারা তো আতঙ্কে সিঁটিয়ে ছিল। কোনও রকমে হস্টেলে পৌঁছই সকলে। এত বছর ধরে অর্জিত স্কুল-কলেজের সমস্ত নথি পুড়িয়ে ফেলতে হবে ভেবেই হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসছে।’’

২০ বছর আগের তালিবানের সঙ্গে আজকের তালিবানের ফারাক রয়েছে বলে যদিও ইতিমধ্যেই নিজেদের জাহির করতে দেখা গিয়েছে সংগঠনের নেতৃত্বকে। কিন্তু তার পরেও তালিবান পুনরুত্থান-পর্বে মহিলাদের নিয়ে যে সব বিধিনিষেধ সামনে এসেছে, তাতে অশনিসঙ্কেত দেখছেন তথাকথিত তৃতীয় বিশ্বের নাগরিকরাও।

তবে ফতোয়া জারি করেই থেমে নেই তালিবান। সদ্য প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট আশরফ গনির বৈধ সরকার থাকাকালীনই গায়ে সেঁটে থাকা পোশাক পরার জন্য বালখ প্রদেশে এক মহিলাকে তালিবান গুলি করে খুন করে বলে অভিযোগ। ২০ বছর আগের তালিবান সরকার নারীশিক্ষা নিষিদ্ধ করেছিল। তার পর আমেরিকার পদার্পণের পর আফগানিস্তানের স্কুলগুলিতে মেয়েদের সংখ্যা বেড়ে ৯০ লক্ষে পৌঁছেছিল। কাবুলের দখল নেওয়ার আগেই তাদের মধ্যে ২০ লক্ষ মেয়েকে স্কুল থেকে নাম কাটিয়ে নিতে তালিবান বাধ্য করেছে বলে অভিযোগ করেছেন সাহারা।

TwitterFacebookWhatsAppEmailShare

#Women, #Taliban, #Afganistan

আরো দেখুন