বিস্মৃত বৈজ্ঞানিক – টেস্ট টিউব বেবির জনক
১৬১৬ সাল….পাদুয়া, ইতালী।
গুটি গুটি পায়ে প্রবেশ করলেন এক প্রৌঢ়, বিশাল কক্ষটিতে তখন বিচারকদের আসনে বসে আছেন ধর্মীয় যাজকরা । শুরু হলো বিচার …… প্রধান ধর্মযাজক চেয়ারে বসেই প্রৌঢ়ের দিকে আঙ্গুল তাক করে জিজ্ঞেস করলেন- “এই মহাবিশ্বের কেন্দ্র হলো পৃথিবী, সকল গ্রহ-নক্ষত্র এমনকি সূর্যও একে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়। আপনি কি বাইবেলের এই মহাসত্যকে অস্বীকার করছেন?” অভিযুক্ত তার মাথাটা উঁচু করলেন, শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ প্রধান যাজকের দিকে। তারপর মাথাটা নীচের দিকে নামিয়ে কাঁপা কাঁপা ঠোঁটে আস্তে আস্তে বলে উঠলেন, ‘না’। যাজকদের মুখে ফুটে উঠলো বিজয়ের ক্রুর হাসি , দশর্কদের মধ্যে উঠলো মৃদু গুজন। কেউ একজন চীৎকার করে উঠল, ‘সত্যকে আজ হত্যা করা হলো’………।
একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটেছিল কলকাতায়, ১৯৭৮ সালের ১৮ ই নভেম্বর। রাজ্যের বাম সরকার মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের অধীনে গঠিত একটি ‘বিশেষজ্ঞ কমিটি’কে নিযুক্ত করলেন ডাঃ সুভাষ মুখোপাধ্যায় নামক এক অভিযুক্তের ভাগ্য নির্ধারণের জন্য। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি নিজেকে দাবি করেছেন দূর্গা নামে এক টেস্টটিউব বেবির স্থপতি রূপে। দ্বিতীয় অভিযোগ এই গবেষণার কথা দপ্তরের আমলাদেরকে না জানিয়ে মিডিয়াকে জানিয়েছেন !
কীভাবে তিনি তার সার্দান অ্যাভিনিউর ছোট ফ্ল্যাটে সামান্য কিছু উপকরণ আর একটা ছোট ফ্রিজ ব্যবহার করে এমন একটি অসম্ভব কাজকে সম্ভব করলেন যেখানে অন্যরা গবেষণার সকল উন্নত সুযোগ-সুবিধা পেয়েও সে চিন্তা করতে পারছে না? আর সবচেয়ে বড় অভিযোগ এই যে, তিনি কারো কাছে মাথা নোয়াতেন না। এই বিশেষজ্ঞ কমিটির সভাপতি ছিলেন একজন রেডিওফিজিসিস্ট। কমিটির সদস্যদের মধ্যে একজন গাইনোকলোজিস্ট, একজন ফিজিওলজিস্ট আর একজন নিউরোফিজিওলজিস্ট ছিলেন।
মজার বিষয় হলো এদের কারোরই আধুনিক প্রজনন পদ্ধতি (আইভিএফ-ইন ভিট্রো ফার্টিলাইজেশন) সম্পর্কে কোনো ধারণা ছিল না। একজন বিশেষজ্ঞ প্রশ্ন করলেন, ‘আপনি ওই ভ্রূণগুলো কোথায় রেখেছিলেন?’ ডাঃ মুখোপাধ্যায় জবাব দিলেন, ‘সীল করা অ্যাম্পুলের মধ্যে’। ফের প্রশ্ন করা হলো, ‘অ্যাম্পুলটাকে সীল করেছেন কীভাবে?’ জবাব এলো, ‘সাধারণভাবে যেভাবে করে, তাপ দিয়ে।’ এভাবেই শুরু হলো জেরা-পাল্টা জেরা। কিছু অবান্তর ভিত্তিহীন, গবেষণার সাথে সম্পর্কহীন প্রশ্ন করে তাকে অপমানের চুড়ান্ত করা হলো। বলা হলো, ‘ওহ-তার মানে আপনি বলতে চাইছেন তাপের কারণে ভ্রূণগুলো নষ্ট হয়ে যায়নি?
কমিটি কী রায় দেবে তা যখন পূর্বনির্ধারিতই তখন এটা আর বলার প্রয়োজন নেই যে এর সব কিছুই আমলাতান্ত্রিক চালের কারণে হচ্ছে। রায় বেরুলো “Everything that Dr. Mukhopadhyay claims is bogus.”
ডাঃ মুখোপাধ্যায়ের অধীনে টেস্টটিউব বেবির জন্মের মাত্র ৬৭ দিন আগে ১৯৭৮ সালের ২৫ জুলাই রাত ১১ টা ৪৫ মিনিটে ইংল্যান্ডের ওল্ডহ্যাম জেনারেল হাসপাতালে পৃথিবীর প্রথম টেস্টটিউব বেবী লুইস ব্রাউন জন্ম নেয়। স্থপতি ছিলেন রবার্ট এডওয়ার্ডস এবং প্যাট্রিক স্টেপটো। এ প্রক্রিয়ায় তারা ল্যাপোরোস্কোপি যন্ত্রের সাহায্যে ডিম্বাণু সংগ্রহ করেন। এর আগে দীর্ঘ সময় নিয়ে ডিম্বাণুর বিভাজন ও পরিস্ফুটন পর্যবেক্ষণ করেন। তারপর কর্তন প্রক্রিয়ায় ডিম্বাণু সংগ্রহ করে একটা ডিস্কে শুক্রাণুর সাহায্যে সেটাকে নিষিক্ত করেন। এরপর এ থেকে ভ্রূণ উৎপন্ন হলে সেটাকে আবার জরায়ুতে প্রতিস্থাপন করেন।
কিন্তু ডাঃ মুখোপাধ্যায় এক্ষেত্রে ল্যাপোরোস্কোপি যন্ত্রের সাহায্য ছাড়াই ডিম্বাণু সংগ্রহ করেন। এজন্য তিনি এক প্রকার হরমোনের সাহায্যে ডিম্বাণুর সংখ্যাবৃদ্ধি ঘটান এবং ওখানেই এর বিকাশ সাধন করেন। এরপর ছোট একটা অপারেশনের সাহায্য নিয়ে ডিম্বাণু সংগ্রহ করেন। আর একারণে গর্ভধারণের সম্ভাবনাও অনেকাংশে বেড়ে যায়।
কিন্তু সহকর্মী এবং সরকারের রোষানলে পড়ে তাকে বরণ করে নিতে হলো করুণ পরিণতি।
প্রথমে তাকে বদলী করে দেয়া হলো কলকাতা থেকে বাঁকুড়ার একটি হাসপাতালের চক্ষু বিভাগে। যাতে তিনি পরবর্তীতে তার গবেষণা চালিয়ে যেতে না পারেন। এরপর তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হলেন। ফের চলে এলেন কলকাতায়। চারতলার সিঁড়ি বেয়ে তাকে রোজ কাজ করতে যেতে হতো। জাপান থেকে তার কাজের উপর একটা সেমিনারে বক্তৃতা করার আমন্ত্রণও পেয়েছিলেন। কিন্তু তাকে যেতে দেয়া হয়নি। চুড়ান্ত অপমান, উপহাস আর লাঞ্ছনা-গঞ্জনা সহ্য করার পর ১৯৮২ সালে ১৯ শে জুন আজকের দিনেই প্রতিভাবান মানুষটি নিজের বাড়িতেই আত্মহত্যা করেন।
আরো একবার যেন সত্যকে হত্যা করা হলো। ভারতের সরকার স্বীকৃত প্রথম টেস্টটিউব বেবীর স্থপতি হলেন ডা. টি এস আনন্দ কুমার যিনি ছিলেন ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব মেডিক্যাল রিচার্সের ডিরেক্টর। ১৯৮৬ সালের ১৬ ই আগস্ট তার অধীনে জন্ম নেয় ভারতের প্রথম (আসলে দ্বিতীয়) টেস্টটিউব বেবী হর্ষ।
১৯৯৭ সালে ডা. আনন্দ একটা বিজ্ঞান সম্মেলনে যোগ দিতে কলকাতায় আসেন। তখন ডাঃ মুখোপাধ্যায়ের গবেষণার সকল কাগজপত্র তার হাতে তুলে দেয়া হয়। নিখুঁতভাবে যাচাই-বাছাই করে এবং সেই টেস্টটিউব বেবী যার জন্ম হয়েছিল ডাঃ সুভাষের অধীনে-দূর্গা সেই শিশুটির মা-বাবার সাথে আলাপ-আলোচনা করে তিনি নিশ্চিত হন যে, ডাঃ সুভাষ মুখোপাধ্যায় ছিলেন ভারতের প্রথম এবং পৃথিবীর দ্বিতীয় টেস্টটিউব বেবীর স্থপতি। ভাগ্যের কি নিষ্ঠুর পরিহাস, ডাঃ টি সি আনন্দ কুমারের উদ্যোগেই তিনি পরে এদেশে স্বীকৃতি পান।
যুগে যুগে কাজের স্বীকৃতি পেতে মানুষকে অনেক লড়াই করতে হয়েছে, বরণ করে নিতে হয়েছে লাঞ্ছনা, অপমান আর উপহাস-ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ। আর আমরা বাঙালীরা এই দিক দিয়ে অনেকটাই এগিয়ে। কি সাহিত্য কি বিজ্ঞান সবক্ষেত্রেই আমরা জীবদ্দশায় কৃতী ব্যক্তির সম্মান দিতে অপারগ থেকেছি। ডা. সুভাষের বেলায়ও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। সাধে কি আর বলে, বাঙালী কাঁকড়ার জাত !
লেখক: স্বপন সেন
তথ্যসূত্র: Subhash Mukhopadhyay – the unlucky doctor behind India’s first Test-tube baby