দিলীপের নেতৃত্বকে খোঁচা দিয়ে যাত্রা শুর বিজেপির নতুন রাজ্য সভাপতির
সরাসরি না বললেও কার্যত বিদায়ী নেতৃত্বকে কিঞ্চিৎ খোঁচা দিলেন বিজেপির নতুন রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার। বিধানসভা ভোটে বিজেপির পরাজয় এবং অধুনা দল ছেড়ে তৃণমূলে যোগদানের একাধিক ঘটনায় গেরুয়া শিবিরের কর্মীদের মনোবলে ধাক্কা লেগেছে বলে অনেকে মনে করেন। দলের সেনাপতি হয়ে তিনি কী ভাবে কর্মীদের মনোবল বাড়াবেন? সুকান্ত মঙ্গলবার বলেন, ‘‘বিজেপি কর্মীদের মনোবল অতটা তলানিতে ঠেকেনি। এক বার দলের ঝান্ডা নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে ভারতমাতা কি জয় বললেই তাঁদের আত্মবিশ্বাস ১০০ শতাংশ ফিরে আসবে।’’ রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের অনেকের মতে, এই মন্তব্যের মধ্য দিয়ে সুকান্ত বলতে চেয়েছেন, সদ্য প্রাক্তন রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষের নেতৃত্বে দল চলাকালীন ওই কর্মীদের খুব একটা ঝান্ডা হাতে রাস্তায় নামানো হয়নি। সুকান্ত অবশ্য দিলীপ সম্পর্কে বলেন, ‘‘দিলীপ ঘোষ পশ্চিমবঙ্গ বিজেপির সফলতম রাজ্য সভাপতি। তিনি যে অবস্থায় দলের দায়িত্ব নিয়েছিলেন, সেখান থেকে দলকে কোথায় টেনে নিয়ে গিয়েছেন, তা কেউ অস্বীকার করতে পারবেন না। আমি দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকে অনুরোধ করব, দিলীপদা যেন এ রাজ্যেই বেশি সময় দিতে পারেন।’’
এ দিনই সকালে ট্রেনে কলকাতা পৌঁছন সুকান্ত। স্টেশনে তাঁকে স্বাগত জানাতে ভিড় করেছিলেন বহু কর্মী-সমর্থক। উপস্থিত ছিলেন অনেক নেতা। গাদা গাদা মালা এবং উত্তরীয় গলায় নিয়ে স্টেশন থেকে বেরোন বিজেপির নয়া রাজ্য সভাপতি। রাজ্য দফতরের সামনে শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের মূর্তিতে মালা দিয়ে দিনের কর্মসূচি শুরু করেন সুকান্ত। পরে দলের হেস্টিংস কার্যালয়ে তাঁকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। সেখানে দলের প্রাক্তন চার রাজ্য সভাপতি অসীম ঘোষ, তথাগত রায়, রাহুল সিংহ এবং দিলীপ বক্তৃতায় সুকান্তকে অভিনন্দন জানান। দলের রাজ্য নেতৃত্ব এবং বিধায়ক, সাংসদদের অনেকে সেই অনুষ্ঠানে যোগ দিলেও বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীকে সেখানে দেখা যায়নি। বিজেপির বক্তব্য, তিনি এ দিন জঙ্গিপুরে দলীয় প্রার্থীর সমর্থনে নির্বাচনী প্রচারে ছিলেন। শুভেন্দুর অনুপস্থিতি নিয়ে প্রশ্নে সুকান্ত বলেন, ‘‘শুভেন্দুদা জঙ্গিপুরে আছেন। সেখানে তাঁর সঙ্গে আমারও থাকার কথা ছিল। কিন্তু আমার নতুন দায়িত্ব ঘোষণা হওয়ায় আমাকে কলকাতায় আসতে হয়েছে। শুভেন্দুদার সঙ্গে শীঘ্রই দেখা হয়ে যাবে।’’ তাঁর তাৎপর্যপূর্ণ সংযোজন, ‘‘বিজেপিতে ব্যক্তির জায়গা নেই। আমরা টিম হিসাবে কাজ করি। আমি ব্যক্তিটিকে রাজ্য সভাপতির পদ দেওয়া হলেও কাজ হবে টিমের সকলের সঙ্গে আলোচনা করে। দিলীপদা, শুভেন্দুদা সকলের পরামর্শ নিয়ে এগোব।’’
সুকান্ত এবং দিলীপ দু’জনেই এ দিন স্বীকার করেন, রণকৌশলে ভুলের জন্য বিধানসভা ভোটে বিজেপি প্রত্যাশিত জয় পায়নি। রাজ্য সভাপতি হিসাবে তিনি কী ভাবে দলকে এই অবস্থা থেকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন? সুকান্ত বলেন, ‘‘কৌশলগত ভুল তো ছিলই। না হলে সাফল্য আসত। দিলীপদা যেখানে ছাড়ছেন, আমি সেখান থেকেই এগোব। আলাদা করে পদক্ষেপের কিছু নেই। ভোটের ফল বিশ্লেষণ করে যা সিদ্ধান্ত নেওয়ার, নেওয়া হবে।’’ নতুন রাজ্য সভাপতি হিসাবে সুকান্ত এ দিন তিনটি লক্ষ্যের কথা জানিয়েছেন। তাঁর কথায়, ‘‘ভবানীপুরে আমরা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ফের পরাজয়ের স্বাদ দিতে উদগ্রীব। যত কঠিন লড়াইই হোক, ২০২৬ সালে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারকে আমরা উৎখাত করে ছাড়ব। আর পরের লোকসভা ভোটে ১৮-র চেয়ে বেশি আসন আমরা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে উপহার দেব।’’
বিজেপির একাংশ অবশ্য মনে করে, জনপ্রতিনিধি ও নেতাদের দলত্যাগ এবং দলের চিরাচরিত গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব সুকান্তর লক্ষ্যভেদের পথে অন্তরায় হতে পারে। সুকান্ত অবশ্য সিপিএম নেতা প্রয়াত হরেকৃষ্ণ কোঙারের একটি মন্তব্যকে উদ্ধৃত করে দলত্যাগীদের কার্যত মল-মূত্রের সঙ্গে তুলনা করেন। দলত্যাগ প্রসঙ্গে তাঁর বক্তব্য, ‘‘যাঁরা রাজ্যপাটের লোভে বা সামান্য ভয়ে দল ছেড়ে যাচ্ছেন, তাঁদের বলব, বিজেপির নীতি-আদর্শে বিশ্বাস থাকলে চলে যাবেন না। আমরা একসঙ্গে লড়ব। যাঁরা চলে গিয়েছেন, তাঁরাও না গেলেই ভাল হত। কিন্তু যাঁরা দলের নীতি-আদর্শে বিশ্বাস করেননি, তাঁরা চলে গেলেই ভাল।’’ তাঁর সংযোজন, ‘‘দলের কর্মীরাই সম্পদ। তাঁরা যত ক্ষণ আছেন, আমি দল ছেড়ে গেলেও কিছু হবে না।’’ আর দলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব নিয়ে তাঁর বক্তব্য, ‘‘বিজেপিতে আন্তরিক গণতন্ত্র আছে। সংসারে স্বামী-স্ত্রীরও মতভেদ হয়। এত বড় সংসারে মতভেদ হওয়া স্বাভাবিক। তবে মতান্তর থাকলেও মনান্তর নেই।’’
বিজেপির রাজ্য সভাপতি হিসাবে সুকান্তর প্রথম দিনের ভাষণ দিলীপের ঘরানার মধ্যেই থেকেছে। যেমন দিলীপের মতোই সুকান্তও এ দিন অভিযোগ করেন, রাজ্যে ভোট পরবর্তী হিংসার ঘটনাগুলিতে একটি বিশেষ সম্প্রদায়কে লেলিয়ে দেওয়া হয়েছে। আগে এ রাজ্যে রাজনৈতিক সংঘর্ষ হলেও তার সঙ্গে ধর্মের সম্পর্ক থাকত না। কিন্তু এখন তা থাকে না বললে ভাবের ঘরে চুরি করা হবে। তবে আমাদের সংখ্যালঘু কর্মীরাও তৃণমূলের আক্রমণের শিকার হয়েছেন।’’
তৃণমূলের বিরুদ্ধে অগণতন্ত্রের অভিযোগ তুলে তাদের ক্ষমতাচ্যুত করার আহ্বান প্রসঙ্গে তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘‘পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি কখনওই ক্ষমতায় আসতে পারবে না। বাহুবলী এবং অর্থবলীদের উপর ভরসা করে লাভ নেই। পশ্চিমবঙ্গের মানুষ বুঝিয়ে দিয়েছেন, তাঁরা ওই পন্থা পছন্দ করেন না। আর বিজেপি কখনওই মানুষের স্বার্থ নিয়ে কাজ করে না।’’