প্রয়াত জাগলার অভয় মিত্র,সত্যজিৎ রায়ের জয় বাবা ফেলুনাথ ছবিতে ছুরি ছোঁড়ার জন্য খ্যাত তিনি!

হুগলির উত্তর পাড়ার বাসিন্দা সেই জাগলার অভয় মিত্র করোনা আতঙ্কের আবহের জেড়ে প্রায় অজান্তেই চলে গেলেন। ৮৬ বছর বয়সে নিজের বাড়িতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন তিনি। এলাকায় গেলেই একডাকে লোকে চিনতো লাঠিদা বলে। লাঠীদা ডাকনামেই খ্যাত ছিলেন তিনি। বাবা কালোসোনা মিত্রের কাছ থেকে ছোট থেকে জাগলিংয়ের শিক্ষা নেওয়া। অসম্ভব ভালোবাসা আর নিষ্ঠা তাকে দ্রুত আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন জাগলিং এর জাদুকর করে তোলে।

April 12, 2020 | 3 min read
Published by: Drishti Bhongi

‘এক মিনিট, শরবত খেয়ে নিই।’ জটায়ু রূপে অভিনেতা সন্তোষ দত্তের অমোঘ উক্তি। সত্যজিৎ রায়ের জয় বাবা ফেলুনাথ ছবির দৃশ্য দেখেননি এমন বাঙালি খুঁজে পাওয়া ভার। এই উক্তি বলার পরই দেওয়ালে দাঁড় করানো একটা বোর্ড যাতে বীভৎস একটি ছবি আঁকা উল্টোদিক থেকে সাদা ধুতি পাঞ্জাবি পরা উৎপল দত্তের চিত্রিত মগনলাল মেঘরাজের আদেশ, ‘ খিলা দিখানো হবে। দিখাবে অর্জুন।’এরপর শিল্প উঠে দাঁড়াতেই একের পর এক ছুরি উড়ে আসছে জটায়ুর দিকে। হাড় হিম করা এই দৃশ্যে রোমকূপ খাঁড়া হয়ে গেছিল প্রত্যেকের। একটু এদিক-ওদিক হলেই ছুরি সরাসরি বিদ্ধ করবে জটায়ুর শরীর। না একটুও এধার, ওধার হয়নি। অর্জুন রুপী কামু মুখোপাধ্যায়ের ছুরি জটায়ু শরীরে লাগেনি। কারণ প্রত্যেকটা ছুরিই পেছন থেকে ছুঁড়েছিল জাগলার অভয় মিত্র। সত্যজিৎ রায়, সৌমিত্র চ্যাটার্জী, সন্তোষ দত্ত,কামু মুখোপাধ্যায় কেউই হয়তো পারতেন না,অক্ষত অমোঘ এই দৃশ্যের অবতারণাই হতো না, অভয় মিত্র না থাকলে।

হুগলির উত্তর পাড়ার বাসিন্দা সেই জাগলার অভয় মিত্র করোনা আতঙ্কের আবহের জেড়ে প্রায় অজান্তেই চলে গেলেন। ৮৬ বছর বয়সে নিজের বাড়িতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন তিনি। এলাকায় গেলেই একডাকে লোকে চিনতো লাঠিদা বলে। লাঠীদা ডাকনামেই খ্যাত ছিলেন তিনি। বাবা কালোসোনা মিত্রের কাছ থেকে ছোট থেকে জাগলিংয়ের শিক্ষা নেওয়া। অসম্ভব ভালোবাসা আর নিষ্ঠা তাকে দ্রুত আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন জাগলিং এর জাদুকর করে তোলে।

https://www.facebook.com/114621203314233/posts/213387073437645/

দেওয়ালে দাঁড় করানো একটা বোর্ড। ভয়াল দর্শন ছবি আঁকা সেখানে। উল্টোদিকে সাদা পাঞ্জাবী-ধুতি পরা মগনলাল মেঘরাজের হুকুম, ‘খিলা দিখানো হবে’। দেখাবে অর্জুন। ‘এক মিনিট, শরবতটা খেয়ে নিই’— জটায়ুর সেই কালজয়ী ডায়লগ। বোর্ডে হেলান দিতেই একের পর এক ছুরি ধেয়ে আসছে তাঁর দিকে। ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’-এর এই দৃশ্য প্রত্যেক বাঙালির একান্ত আপন। কিন্তু সত্যজিৎ রায়, সন্তোষ দত্ত ছাড়াও এই পুরো দৃশ্যের মূল কাণ্ডারি বা ভরকেন্দ্র ছিলেন আরও একজন। যিনি না থাকলে, এই দৃশ্য অক্ষত অবস্থায় শেষ হতই না। তিনি, অভয় মিত্র। উত্তরপাড়ার বাসিন্দা এই আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন, কিংবদন্তি জাগলার নিজের বাড়িতেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে বয়স হয়েছিল ৮৬ বছর।

পাড়ায় গেলে অভয় মিত্র বললেই লোকে চিনিয়ে দেবে বাড়ি। আরও ভালো হয়, ‘লাঠি দা’ বলে ডাকলে। এটাই তাঁর ‘ডাকনাম’। বাবা কালোসোনা মিত্রের কাছ থেকেই ছোটো বয়সে জাগলিংয়ের পাঠ নেওয়া। কিন্তু বাবাকে বেশিদিন কাছে পাননি। তবে চর্চা থামেনি, বরং বেড়েই গেছে প্রতিটা দিন। আর কে না জানে, প্র্যাকটিস মেকস পারফেক্ট! নিজের খেলায় অভয় মিত্র ছিলেন জাদুকর। জাগলিংয়ের সমস্ত কিছু নখদর্পণে ছিল তাঁর। সেইসঙ্গে ছিল এই শিল্পটার প্রতি প্রগাঢ় ভালোবাসা।জাদুকর পি সি সরকার জুনিয়রের সঙ্গে অভিন্ন হৃদয়ের বন্ধুত্বের সম্পর্ক ছিল তাঁর অভয় মিত্রকে সাথে নিয়ে একদিন পি সি সরকার বিশপ লেফ্রয় রোডে সত্যজিত রায়ের বাড়িতে যান । সেই সময় সত্যজিৎ রায় জয় বাবা ফেলুনাথ ছবিটি তৈরি করার পরিকল্পনা করছেন। সত্যজিতের একজন নিখুঁত জাগলারের দরকার ছিল, যে ক্যামেরার পিছনে অব্যর্থ নিশানায় দর্শকদের শিউরে তুলবে।বাড়িতেই স্ত্রী বিজয় রায় ও পুত্র সন্দীপ রায় সামনে অভয় মিত্র জাগলিং এর বিভিন্ন খেলা দেখান। মুগ্ধ হয়ে ওঠেন গোটা পরিবার।

প্রয়াত জাগলার অভয় মিত্র

খুব ভালো সম্পর্ক ছিল। বন্ধুত্বও ছিল অভিন্ন হৃদয়ের। দুজনেই যে সম্মোহন জানতেন, মাধ্যমটা নেহাত একটু আলাদা ছিল। স্টেজে উঠলে মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাকিয়ে থাকতেন সবাই। সেই একই অবস্থা হয় সত্যজিৎ রায়েরও। একদিন অভয় মিত্রকে নিয়ে সোজা বিশপ লেফ্রয় রোডের বাড়িতে চলে যান পি সি সরকার জুনিয়র। তখন ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’ ছবিটির তিকল্পনা চলছে। আর তার জন্য একজন জাগলারের প্রয়োজন,যে থাকবে ক্যামেরার পেছনে, কিন্তু যার অব্যর্থ নিশানা দর্শকদের মাতিয়ে রাখবে। সত্যজিতের প্রশ্ন ছিল ঠিক তিনটি— ছোরা ছোঁড়ার খেলা দেখাতে পারবে কিনা; জাগলিং করতে পারবে কিনা; ওই মুহূর্তে সত্যজিৎকে এই সবটা করে দেখাতে পারবে কিনা। প্রতিটা প্রশ্নের উত্তর একই ছিল, ‘হ্যাঁ’।এরপর সোজা ইন্দ্রপুরী স্টুডিও সেখানেই বোর্ডের সামনে স্বয়ং সত্যজিৎ রায় নিজে দাঁড়িয়ে যান। দাঁড়িয়ে তিনি অভয় মিত্র কে বলেন ছোরা ছুঁড়ে দেখাও। গোটা স্টুডিও তখন বিস্ময়ে হতবাক। নির্লিপ্তভাবে অভয় মিত্র অবলীলায় তার কাজ করলেন। সত্যজিৎ রায় সহ গোটা স্টুডিও হাততালিতে ফেটে পরলো। এরপর বাকিটা ইতিহাস।বাংলা সিনেমা অমর দৃশ্যের অমর দৃশ্যের অবতারণা হয়েছিল এরপর।

অভয় মিত্রর জীবনে একটাই লক্ষ্য ছিল, এই মাদারির খেলা যেন তার মৃত্যুর পরও টিকে থাকে। পরবর্তীকালে সত্যজিৎ রায়ের ফটিকচাঁদ সন্দীপ রায়ের গুপি বাঘা ফিরে এলো তেও অসামান্য জাগলিংয়ে র খেলা দেখান তিনি। সন্তানদের, নাতি-নাতনি প্রত্যেককে এই খেলা তিনি শিখিয়ে যান।জাগলিং একাডেমী তৈরি করেছিলেন কিন্তু তা খুব একটা সাড়া পায় নি,সেটাই আমৃত্যু তাঁর বেদনার ছিল। নতুন প্রজন্ম এই জাগলিং বা মাদারীর খেলায় উৎসাহ দেখায় না, এই আক্ষেপ নিয়েই কিংবদন্তি শিল্পী অভয় মিত্র চলে গেলেন।

TwitterFacebookWhatsAppEmailShare

ভিডিও

আরও পড়ুন

Decorative Ring
Maa Ashchen