জ্বরাসুর – বাংলার এক ভয়ঙ্কর লৌকিক দেবতার অজানা কাহিনী

বাঁকুড়া, মেদিনীপুর, চব্বিশ পরগনা জেলার দক্ষিণরায়, আটেশ্বর, পাঁচুঠাকুর, বসন্ত রায় প্রভৃতি লৌকিক দেবতার বিশেষ স্থানে এই দেবতাকে দেখা যায়

June 10, 2023 | 2 min read
Published by: Drishti Bhongi

নিউজ ডেস্ক, দৃষ্টিভঙ্গি: বাংলার লৌকিক দেবতা জ্বরাসুর। জ্বররোগ নাশক রূপে পূজিত হয় জ্বরাসুর। মানুষের বিশ্বাস এই দেবতার পুজো করলে জ্বর, কলেরা, বসন্তের প্রকোপ কমেে। হিন্দু পুরাণে এই দেবতার উল্লেখ আছে। জ্বর দেবতার উল্লেখ আছে প্রাচীন বৈদিক শাস্ত্র গ্ৰন্থে ও সংস্কৃত কাব্যেও।

“ওঁ আগচ্ছ মে মহারাজ জ্বর তং শিব নির্মিতঃ তস্মাচ্ছরী বাগ্নিগত্য দূরে যাহি মহাবলা।”

জানা যায়, পাল যুগ থেকে বাংলায় মা শীতলার মূর্তির সঙ্গী হতে শুরু করে জ্বরাসুর মূর্তি পুজোর প্রচলন। মা শীতলা থানে বা মন্দিরে জ্বরাসুর নিত্য পূজিত হয়। কিন্তু শুধু শীতলার নয়, পঞ্চানন্দের মহাপাত্র ও ধর্মঠাকুরের সহচর রূপে জ্বরাসুরকে কোনও কোনও জায়গায় দেখা যায়। এছাড়া বাঁকুড়া, মেদিনীপুর, চব্বিশ পরগনা জেলার দক্ষিণরায়, আটেশ্বর, পাঁচুঠাকুর, বসন্ত রায় প্রভৃতি লৌকিক দেবতার বিশেষ স্থানে এই দেবতাকে দেখা যায়।

এক কিংবদন্তি মতে জ্বরাসুর মহাদেবের ধ্যান করার সময় কপালের ঘাম থেকে জন্মগ্রহণ করেছিলেন এবং দেবতাদের আতঙ্ক ছিলেন। একবার বিষ্ণু হয়গ্রীব অবতারে জ্বরাসুরের জ্বরে পরেন পরে তিনি জ্বরাসুরকে হত্যা করেছিলেন। তিনি সুদর্শন চক্র ব্যবহার করে জ্বরাসুরকে তিন টুকরো করেছিলেন। পরে জ্বরাসুর ব্রহ্মা দ্বারা পুনর্জীবিত হন। ব্রহ্মা তাঁর তিনটি অংশ যোগ করেন। কিন্তু ততদিনে তিনটি অংশের প্রতিটির মাথা ও অঙ্গ গজিয়ে গিয়েছিল। এতে তাঁর তিনটি মুখ, তিনটি পা এবং একযোগে সব দিক থেকে অসাধারণ ক্ষমতা পেয়েছিল। পরবর্তীতে তিনি মা শীতলার স্বামী হিসাবে নির্বাচিত হন।

জ্বরাসুরের আকৃতি সুন্দর, তবে কিন্তু বিচিত্র। জানা যায়, তাঁর দেহের রং ঘন নীল, কোন কোন স্থানে গাঢ় কালো কাজলের মত। তিন মাথা, নয়টি চোখ, ছয়টি হাত, পা তিনটি, চুল ও গোঁফ কটা রঙের। তিন মুকুট, গলায় ও হাতে নানারকম অলঙ্কার মূলত হলদে রঙের ওড়না, ধুতি ও বেনিয়ান জাতীয় ছোট জামা পরেন। এর কোনও বাহন বা প্রহরণ দেখা যায় না। সর্বত্র মূর্তি নেই, প্রতীক রূপে শিলাখন্ড। ঘট দু’এক স্থানে বেলে পাথরের কূর্ম মূর্তি পূজিত হয়। এই রূপ কূর্ম প্রতীকের চার ধারে ঘোড়া মূর্তি দেখা। ধর্ম ঠাকুরের প্রভাবে বা ইনি ধর্ম ঠাকুরের অনুচর বলে এর কূর্ম প্রতীকের প্রচলন হয়েছে।

জ্বরাসুরের পূজায় প্রায় সর্বত্র বর্ণ ব্রাহ্মণ্য পৌরাহিত্য করেন। কোনও কোনও জায়গায় শীতলার সেবায়েতরাও পুজো করে থাকেন। মূলত ব্রাহ্মণ্য বিধান অনুযায়ী এই দেবতার পুজো হয়। শুধু রাজ্যে নয়, ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে বিভিন্ন রূপে পূজিত হন জ্বরাসুর। যেমন- উড়িষ্যাতে ‘জ্বর-নারায়ন’, দক্ষিন ভারতে ‘মারীডিয়াম্মা’(নারী)।

জ্বরাসুরের আকৃতির সঙ্গে বৌদ্ধদের কয়েকটি দেবতার আকৃতিগত সাদৃশ্য দেখা যায়। ইনি আরোগ্য দেবতা বলেও বৌদ্ধ সমাজে পরিচিত। মূলত এর বিশেষ পূজা হয় ফাল্গুন চৈত্রের পূর্ণিমায়। এই পুজোয় দিনের বেলায় বাতি জ্বালিয়ে রাখা রাখতে দেখা যায়। পল্লী অঞ্চলের ওঝা ও গুণীনদের জ্বর ছাড়ানো মন্ত্রে জ্বর আসুরের নাম বা দোহাই শোনা যায়

“কেন মাতা ডাকিলে আমারে
দেবী বলে, জ্বরাসুর, আমার বয়ন ধর,
শ্রীঘ্র ডাক আপন কিঙ্করে।
দেবীর আদেশ পয়্যা , জ্বরাসুর ক্রোধ হয়্যা
ডাকে সবে আপনার দলে।”

TwitterFacebookWhatsAppEmailShare

ভিডিও

আরও পড়ুন

Decorative Ring
Maa Ashchen