বঙ্গ মৎস্যজীবীদের প্রাচীন দেবতা মাকাল ঠাকুর
সুন্দরবনের কাছে উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনায় এই ঠাকুরের নামের সাথে যুক্ত দু’একটা গ্রাম রয়েছে। যেমন- মাকালতলা, মাকালপুর ইত্যাদি।

নিউজ ডেস্ক, দৃষ্টিভঙ্গি: বঙ্গের লৌকিক দেবতা মাকাল/মাখাল ঠাকুর। মৎস্যজীবীদের ধারণা মাকাল হলেন পুরুষ। সুন্দরবনের মৎস্যজীবী সম্প্রদায়ের উপাস্য দেবতা মাকাল ঠাকুর। যাঁর কোনও মানবসদৃশ মূর্তি নেই। বরং, একসঙ্গে দু’টি ছোটো স্তূপ বা বেদীতে তাঁর পুজো করা হয়। কথিত আছে, মহাকালের অপভ্রংশ থেকে এই শব্দটি এসেছে। পাশে জুড়ে দেওয়া হয়েছে ‘ঠাকুর’ শব্দটি। কিন্তু প্রাচীন গ্রন্থমতে মাকাল সম্পূর্ণ ভিন্ন দেবতা। মহাকালের সাথে যার কোনও সম্পর্কই নেই।
প্রাচীন ও মধ্যযুগের কয়েকটি কাব্যে মাকাল ঠাকুরের উল্লেখ পাওয়া যায়।
প্রায় দুশো বছরের বেশি প্রাচীন ‘তারকেশ্বর শিবতত্ব’ গ্রন্থে বলা হয়েছে –
‘ক্ষেত্রপাল মহাকাল প্রভৃতি দেবতা।
যাহার যেরূপ ভক্তি সেরূপ গঠিতা।।
কোথায় ওলাইচণ্ডী মাখাল জলাশয়।
বৃক্ষতলে মহাপ্রভু স্থান দৃশ্যপ্রায়।।’
সমসাময়িক কালে বলরাম কবিশেখরের লেখা ‘কালিকামঙ্গল’ কাব্যের ‘দিগবন্দনা’তে মাকাল/ মাখাল ঠাকুরের উল্লেখ পাওয়া যায়-
‘দাধার চণ্ডিকা বন্দো যোড় করি পাণি।
বালিয়ায় বন্দিলাম জয়-সিংহ-বাহিনী।।
ঘুরালো মাখাল বন্দো পুরাণের ঘাটু।
তালপুরে ষষ্ঠী বন্দো হাসনানের বটু।।
কালিঘাটে বন্দিলাম দেবী ভদ্রাকালি।
ব্রহ্মা স্থাপিয়া যথা দিল অঙ্গ বলি।।’
মাকাল পুজোর নির্দিষ্ট কোনও স্থান নেই। জোড়া বেদী বা থানেতে করা হয় এই আরাধ্য দেবতার পুজো। উপরে টাঙানো হয় লাল চাঁদোয়া। বেদীর উপর পোঁতা হয় তির-কাঠি। রাখা হয় সিঁদুর মাখানো ফুল, বেলপাতা ও তুলসিপাতা, ঘুনসি, ধান, দূর্বা। সামনে পাতা হয় একটি ঘট। পুজোর সময় জ্বালানো হয় একটি প্রদীপ। নৈবেদ্য হিসেবে লাগে আতপ চাল, পাকা কলা ও কয়েকটি বাতাসা। চকোলেট, চুষিকাঠি, লাট্টুর মতো জিনিসও দেওয়া হয় এই পুজোয়। এছাড়াও কলকে ও গাঁজা দেওয়া হয়। ভক্তদের বিশ্বাস, ‘ফুল চাপানো’র পর আপনা আপানি ফুল মাটিতে পড়ে গেলে প্রচুর মাছ উঠবে জালে।
কোনও কোনও জেলায় দেয়াসি শ্রেণির ব্রাহ্মণ পুরোহিতরা এই পুজো করে থাকেন। এই পুজোয় বাজনা বা বলিদানের কোনও রীতি নেই। বাংলার কিছু জেলা বিশেষত হাওড়া জেলার গ্রামাঞ্চলের মৎস্যজীবীরা মাকাল ঠাকুরকে মাকালচণ্ডী নামে অভিহিত করেন। এই পুজোতেও কোনও মন্ত্র ব্যবহার করা হয় না। কোনও কোনও গ্রামে অন্য কোনও দেবতার লৌকিক সহচর রূপে তাঁর বেদী দেখা যায়। বেলেঘাটা খালের পূর্বতীরে নাওয়াবাদ-গোলাবাড়ির এক জায়গায় দক্ষিণরায়, পঞ্চানন্দ (পঞ্চানন) প্রভৃতি দেবতার ‘থানে’-র সঙ্গে মাকাল দেবতাকেও দেখা যায়। সুন্দরবনের কাছে উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনায় এই ঠাকুরের নামের সাথে যুক্ত দু’একটা গ্রাম রয়েছে। যেমন- মাকালতলা, মাকালপুর ইত্যাদি। সুন্দরবন অঞ্চলে বহু মৎস্যজীবীর পদবি ‘মাকাল’।