জানুয়ারিতেই শুভেন্দুগড়ে ‘সেবাশ্রয়’ থেকে বাড়ি বাড়ি উন্নয়নের খতিয়ান, মেগা কর্মসূচি ঘোষণা অভিষেকের

December 27, 2025 | 4 min read

নিউজ ডেস্ক, দৃষ্টিভঙ্গি, ১৯:৪০: এবার ছাব্বিশের বিধানসভা নির্বাচনকে পাখির চোখ করে ময়দানে নামছে তৃণমূল কংগ্রেস (TMC)। নতুন বছরের শুরুতেই, অর্থাৎ আগামী ২ জানুয়ারি থেকে রাজ্যজুড়ে শুরু হচ্ছে শাসকদলের মেগা কর্মসূচি। শনিবার বিকেলে এক সাংবাদিক বৈঠকে এই নতুন কর্মসূচির কথা ঘোষণা করলেন তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়।

তৃণমূল সূত্রে খবর, এবারের লড়াইয়ের অভিমুখ দ্বিমুখী। একদিকে রাজ্য সরকারের উন্নয়নমূলক কাজের বিস্তারিত খতিয়ান বা ‘রিপোর্ট কার্ড’ মানুষের সামনে তুলে ধরা, আর অন্যদিকে কেন্দ্রের চাপিয়ে দেওয়া ‘এসআইআর (SIR) বা সার’-এর বিরুদ্ধে জনমত গঠন করা। এই ‘জোড়া হাতিয়ার’ নিয়েই এবার মানুষের দুয়ারে পৌঁছতে চাইছে ঘাসফুল শিবির।

এদিন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় স্পষ্ট জানান, কেন্দ্র সরকার জোর করে রাজ্যের মানুষের ওপর ‘SIR-রাজনীতি’ চাপিয়ে দিতে চাইছে। তৃণমূল কংগ্রেস এর তীব্র বিরোধিতা করছে। তাঁর কথায়, “বাংলার মানুষকে বঞ্চনা এবং বিভ্রান্ত করার যে চক্রান্ত কেন্দ্র করছে, তার বিরুদ্ধেই আমাদের এই লড়াই।”

বাড়ি বাড়ি উন্নয়নের খতিয়ান

দলীয় সূত্রে খবর, ২ জানুয়ারি থেকে শুরু হওয়া এই কর্মসূচিতে তৃণমূলের নেতা ও কর্মীরা রাজ্যের প্রতিটি বুথে সাধারণ মানুষের বাড়ি বাড়ি যাবেন। সেখানে যেমন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের বিভিন্ন জনমুখী প্রকল্প (লক্ষ্মীর ভান্ডার, দুয়ারে সরকার, স্বাস্থ্যসাথী)-এর সুফল মানুষ কতটা পাচ্ছেন তার খোঁজ নেওয়া হবে, তেমনই কেন্দ্রের ‘SIR’ নীতির কুফল সম্পর্কেও সাধারণ মানুষকে সচেতন করা হবে।

শুভেন্দুগড়ে ‘সেবাশ্রয়’

‘ডায়মন্ড হারবার মডেল’-এর সাফল্য এবার নন্দীগ্রামে। করোনা বা মহামারী আবহে ডায়মন্ড হারবারে সাধারণ মানুষের সুবিধার্থে যে ‘সেবাশ্রয়’ বা স্বাস্থ্য শিবিরের আয়োজন করা হয়েছিল, এবার সেই ধাঁচেই রাজ্যের অন্যতম হাইভোল্টেজ কেন্দ্র নন্দীগ্রামে মডেল ক্যাম্প করতে চলেছে তৃণমূল। শনিবার তৃণমূল ভবনে সাংবাদিক বৈঠকে দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেই এই ঘোষণা করেছেন।

শনিবার তিনি জানান, আগামী ১৫ জানুয়ারি নন্দীগ্রাম ১ ও নন্দীগ্রাম ২ নম্বর ব্লকে দুটি মডেল ক্যাম্পের আয়োজন করা হবে। ওই দিন কাঁথিতে জনসভা করার কথা রয়েছে তাঁর। সেই সফর চলাকালীনই তিনি নিজে নন্দীগ্রামে উপস্থিত থেকে এই ক্যাম্পগুলোর উদ্বোধন করবেন।

কিন্তু হঠাৎ নন্দীগ্রাম কেন? এ প্রসঙ্গে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “নন্দীগ্রাম থেকে ‘এক ডাকে অভিষেক’ হেল্পলাইন নম্বরে সেবাশ্রয় নিয়ে অনেক ফোন আসছিল। আমি ওখানে আমার সহকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে ঠিক করেছি, নন্দীগ্রাম ১ আর ২ নম্বর ব্লকে দুটো মডেল ক্যাম্প হবে। আমি ওই সময় ওখানেই থাকব।”

কমিশনের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে যাওয়ার হুঁশিয়ারি

এদিনের সাংবাদিক বৈঠকে শুধুমাত্র নন্দীগ্রামের কর্মসূচীই নয়, নির্বাচন কমিশনের এসআইআর (SIR) প্রক্রিয়া নিয়েও বিস্ফোরক অভিযোগ তুলেছেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। কমিশন আধিকারিক সীমা খান্নার নাম উল্লেখ করে তিনি দাবি করেন, এসআইআর প্রক্রিয়ায় বড়সড় গরমিল রয়েছে।

অভিষেক প্রশ্ন তোলেন, “১৬ ডিসেম্বর একদিনে কীভাবে ৮০ হাজার বিএলও-কে দিয়ে ৭ কোটি ডেটা যাচাই করে অসঙ্গতির হিসাব দেওয়া সম্ভব? এতই যদি দক্ষতা থাকে, তবে উত্তরপ্রদেশ বা ছত্তিশগড়ে মেয়াদ বাড়াতে হয় কেন?” তিনি হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, ভোটার তালিকায় তথ্যের গরমিল নিয়ে প্রমাণস্বরূপ ‘স্ক্রিনশট’ তাঁর কাছে আছে এবং প্রয়োজনে তিনি তা নিয়ে সুপ্রিম কোর্টে যাবেন।

তৃণমূল সেনাপতি আরও জানিয়েছেন, আগামী ৩১ ডিসেম্বর তিনি দিল্লি যাবেন এবং নির্বাচন কমিশনের দপ্তরে গিয়ে তালিকা চাইবেন। কমিশন যদি সেই তালিকা দিতে ব্যর্থ হয়, তবে কমিশন দপ্তর ঘেরাও করা হবে বলেও কড়া বার্তা দিয়েছেন তিনি।

কমিশনকে কটাক্ষ করে অভিষেক বলেন, ‘‘কোনও অফিসিয়াল প্রেস রিলিজ ছাড়াই হোয়াটসঅ্যাপে ‘লজিক্যাল ডিসক্রিমেন্সি’র তালিকা ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে। এটা এখন হোয়াট্‌সঅ্যাপ কমিশন।’’ তাঁর দাবি, গুজরাত, উত্তরপ্রদেশ বা তামিলনাড়ুতে বিশাল সংখ্যক ভোটারের নাম বাদ গেলেও সেখানে কোনও কেন্দ্রীয় দল পাঠানো হয় না, অথচ বাংলাকে টার্গেট করা হচ্ছে।

বিজেপিকে আক্রমণ

পুলওয়ামা হোক বা বাংলাদেশ, বিজেপি মৃতদেহ নিয়ে রাজনীতি করে এমন ভাষাতেই শনিবার কেন্দ্র ও বিজেপিকে (BJP) তীব্র আক্রমণ শানালেন তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক। একইসঙ্গে ভোটার তালিকা সংশোধন এবং নাম বাদ দেওয়া নিয়ে নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলে কমিশনকে ‘হোয়াট্‌সঅ্যাপ কমিশন’ বলে কটাক্ষ করেন তিনি।

অভিষেক অভিযোগ করেন, বিজেপি এবং মোদী সরকার এমন এক পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে যেখানে সরকারই ঠিক করে দিচ্ছে কে ভোট দেবে। তাঁর দাবি, এক বিশেষ চক্রান্তের মাধ্যমে ভোটার তালিকা থেকে নাম বাদ দেওয়া হচ্ছে। এই প্রসঙ্গে কমিশনের ডিজি (আইটি) সীমা খন্নার ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন তিনি। অভিষেকের অভিযোগ, ‘‘ইআরও-দের তথ্য ছাড়াই ব্যাকঅ্যান্ড থেকে নাম বাদ দিয়ে দেওয়া হচ্ছে। সীমা খন্না কার অঙ্গুলিহেলনে কাজ করছেন? তাঁর চ্যাটের স্ক্রিনশট আমাদের কাছে আছে, যা সুপ্রিম কোর্টে জমা দেব।’’

SIR এবং NRC আতঙ্কে প্রাণহানি প্রসঙ্গ

এসআইআর (SIR) এবং এনআরসি-র (NRC) আতঙ্কে রাজ্যে প্রাণহানির পরিসংখ্যান তুলে ধরে অভিষেক দাবি করেন, ‘‘এই আতঙ্কে ৫১ জন সাধারণ মানুষ আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন, যার মধ্যে ৪৫ জন প্রাণ হারিয়েছেন। এমনকি ২৯ জন বিএলও (BLO) আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন।’’ বিজেপির বিরুদ্ধে তোপ দেগে তিনি বলেন, ‘‘ওরা শুধু বোনাস, ধর্ম আর বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভাঙার রাজনীতি করে। বাংলার মানুষের কাছে কান ধরে ক্ষমা না চাইলে আমরা তালিকা প্রকাশ করতে বাধ্য করব।’’

আগামী কর্মসূচির কথা ঘোষণা করে অভিষেক জানান, ২ জানুয়ারি থেকে ‘যতই করো হামলা, আবার জিতবে বাংলা’ স্লোগান নিয়ে তিনি রাস্তায় নামবেন। পাশাপাশি, নন্দীগ্রামের মানুষের অনুরোধে সেখানে ‘সেবাশ্রয়’-এর দুটি মডেল ক্যাম্প করা হবে। এই ক্যাম্প উদ্বোধন করতে আগামী ১৫ জানুয়ারি পূর্ব মেদিনীপুর সফরে গিয়ে তিনি নন্দীগ্রামেও যাবেন।

বিজেপি সাংসদ ও বিধায়কদের সমালোচনা করে তিনি বলেন, ‘‘বাংলার মানুষ যাদের ভোট দিয়ে জিতিয়েছে, তারা কেন্দ্রের বঞ্চনা নিয়ে একটাও কথা বলে না। তবে আমরা বিজেপির (BJP) কাছে মাথানত করব না, আমাদের জবাবদিহি শুধু রাজ্যের মানুষের কাছে।’’

বাংলাদেশের দীপু খুন প্রসঙ্গে

দীপু দাস খুনের বিচার চেয়ে বাংলাদেশ সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছে ভারত। পাশাপাশি সংখ্যালঘুদের উপর হামলার ঘটনা নিয়েও ঢাকাকে বার্তা দিয়েছে নয়াদিল্লি। তবে এই বিষয়ে আলাদা করে প্রধানমন্ত্রী বা বিদেশমন্ত্রী এস জয়শংকরের কোনও প্রকাশ্য বিবৃতি সামনে আসেনি। এই প্রসঙ্গ টেনেই অভিষেক মন্তব্য করেন, “দীপু দাস নিয়ে প্রধানমন্ত্রী এবং বিদেশমন্ত্রীর কোনও বিবৃতি বা একটা টুইটও নেই। এঁরা আবার নিজেদের হিন্দুদের রক্ষাকর্তা বলেন। ওঁদের হিন্দু প্রেম নিয়েই তো প্রশ্ন ওঠে। দু’মাস আগেই প্রধানমন্ত্রী মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে হাত মিলিয়ে এসেছিলেন। উনি এখন চুপ কেন?” তিনি আরও বলেন, ‘আমরা শকুন নই। মৃত্যু নিয়ে আমরা রাজনীতি করি না। বিজেপি পুলওয়ামা, ময়মনসিংহের মতো ঘটনা নিয়ে রাজনীতি করে।”

এদিন রাজ্যের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীকেও আক্রমণ করেন অভিষেক। তাঁর বক্তব্য, “শুভেন্দু অধিকারী বলেছিল, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের থেকে ইউনূসের সরকার ভালো। আপনিই সার্টিফিকেট দিয়েছেন। তা হলে ওখানেই এখন হিন্দুদের মারা হচ্ছে!”

TwitterFacebookWhatsAppEmailShare

ভিডিও

আরও পড়ুন

Decorative Ring
Maa Ashchen