সিনেমার রাজনীতি, রাজনীতির সিনেমা

১২৫ বছর আগে, ১৮৯৫ খ্রিস্টাব্দে লুমিয়ের ব্রাদার্স নামে খ্যাত নিকোলাস ও জিন লুমিয়ের প্রযোজিত ও পরিচালিত বিশ্বের প্রথম নির্বাক ছবি ‘‌দ্য অ্যারাইভাল অফ এ ট্রেন অ্যাট দ্য স্টেশন’‌ তৈরি হয়।

January 19, 2020 | 4 min read
Published by: Drishti Bhongi

১২৫ বছর আগে, ১৮৯৫ খ্রিস্টাব্দে লুমিয়ের ব্রাদার্স নামে খ্যাত নিকোলাস ও জিন লুমিয়ের প্রযোজিত ও পরিচালিত বিশ্বের প্রথম নির্বাক ছবি ‘‌দ্য অ্যারাইভাল অফ এ ট্রেন অ্যাট দ্য স্টেশন’‌ তৈরি হয়। প্রথমে শুধু বিনোদনের অন্যতম মাধ্যম হিসেবে পরিচিতি পেলেও পরবর্তী সময়ে, ১২৫ বছর পরে চলচ্চিত্র রাজনৈতিক মতাদর্শ, ভাবাদর্শ প্রচারের বিকল্প মাধ্যমে পরিণত হয়েছে।

বেশ কিছু বছর আগে ‘‌সোশ্যাল সায়েন্স’‌ ত্রৈমাসিক সাময়িকীতে একটি গবেষণাধর্মী প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। আবেগ বা ভাবালুতায় পরিপূর্ণ চলচ্চিত্র মানুষের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিকে কীভাবে প্রভাবিত করে তাই ছিল সেই গবেষণার বিষয়বস্তু। যুক্তরাষ্ট্রের ইন্ডিয়ানা অঙ্গরাজ্যের নোতরদাম বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক–শিক্ষক টড অ্যাটকিনস-এর নেতৃত্বে একদল রাজনীতিবিজ্ঞান গবেষক সেখানকার তিনশো ছাত্রছাত্রীর ওপর এই গবেষণা চালান। 

গবেষণায় তাঁরা যাচাই করে দেখার চেষ্টা করেন, রাজনৈতিক আদর্শ সংবলিত বিভিন্ন হলিউড চলচ্চিত্র মানুষের জীবনে কীরকম প্রভাব ফেলে। সমস্ত ছাত্রছাত্রীর দৃষ্টিভঙ্গি ও মানসিকতার তথ্য সংগ্রহের পর তাদের প্রত্যেককে নির্দিষ্ট কয়েকটি চলচ্চিত্র দেখানো হয়। তারপর আবার ছাত্রছাত্রীদের দৃষ্টিভঙ্গি ও মানসিকতার তথ্য সংগ্রহ করা হয়। সব কিছুর শেষে, দুই পৃথক সময়ে ছাত্রছাত্রীদের থেকে উপলব্ধ তথ্য বিশ্লেষণ করে গবেষকেরা সিদ্ধান্তে আসেন, রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করতে, নির্দিষ্ট রাজনৈতিক মতের অনুসারী করে তুলতে, নির্দিষ্ট কিছু বস্তুকে, যথা মানুষ, সম্প্রদায়, মতবাদকে ঘৃণ্য বা নিকৃষ্ট হিসেবে তুলে ধরার ক্ষেত্রে চলচ্চিত্রের ভূমিকা অত্যন্ত প্রভাবশালী।

কেন টেড অ্যাটকিনস-এর গবেষণার কথা এখানে উল্লেখ করা হল? কারণ, একটা সময় পর্যন্ত মনে করা হতো, ‘‌সাহিত্যই সবচেয়ে মননশীল শিল্পরূপ’‌; এমনটা বিশ্বাস করতেন জেমস জয়েসও। কিন্তু সাহিত্য যে কেবল মননশীল বক্তব্যের একমাত্র স্থায়ী বাহন হতে পারে না, তা চলচ্চিত্র নিজেই বুঝিয়ে দিয়েছে। সাহিত্যের থেকে চলচ্চিত্র অনেক বেশি শক্তিশালী মাধ্যম বলে নয়, স্থান থেকে কাল, কাল থেকে কালান্তরে চলচ্চিত্রের অনায়াস গতায়াত। সিনেমার দৃশ্য ও শব্দের ধারাবাহিক মূর্ত থেকে আমরা ভেসে যাই বিমূর্ত চেতনায়। আর এই কারণেই রাজনীতি সরাসরি ঢুকে পড়ে চলচ্চিত্রের আঙিনায়। নিয়ন্ত্রণ করতে, প্রভাবিত করতে শুরু করে আমাদের চেতনাকে। 

এ কথা ঠিক যে, সমকালীন সময়ের রাজনীতিকে চলচ্চিত্র মাধ্যম প্রায়ই ফ্রেমবন্দি করে আমাদের সামনে এনে হাজির করে। আমাদের দেশের কথাতেই আলোচনা সীমাবদ্ধ রাখার তাগিদে দেশীয় কিছু চলচ্চিত্রের কথা এখানে উল্লেখ করব। স্বাধীনোত্তর ভারতে নেহরু জমানায় সমাজতান্ত্রিক ছোঁয়া আমরা চলচ্চিত্রের মধ্যে ফুটে উঠতে দেখেছি। ‘‌দো বিঘা জমিন’‌, ‘জিস দেশ মে গঙ্গা বহতি হ্যায়’‌ ইত্যাদি এই ধরনের চলচ্চিত্রের প্রকৃষ্ট উদাহরণ। কিন্তু এই সমস্ত চলচ্চিত্র কখনওই উগ্রতাকে, ইতিহাসবিকৃতিকে প্রশ্রয় দেয়নি। দেশপ্রেম বহু সিনেমার মূল প্রতিপাদ্য হলেও বর্তমানের উগ্রতার কোনও ঠাঁই তখন ছিল না। 

কিন্তু নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন সরকার কেন্দ্রে আসীন হওয়ার পর বহু সিনেমায় উগ্র জাতীয়তাবাদী চিন্তাভাবনার প্রভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। উগ্রপন্থার বিরুদ্ধে লড়াইকে সামনে রেখে তৈরি ‘‌উরি: দ্য সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’‌ এবং ‘‌বেবি’‌— এই ধরনের সিনেমার উদাহরণ, যেখানে ভারতকে ‘‌রাষ্ট্র’‌ হিসেবে মহিমান্বিত করা হয়েছে। তবে সব কিছু ছাড়িয়ে কিছু সিনেমা, যার বেশিরভাগ মধ্যযুগের ইতিহাসকেন্দ্রিক, হিন্দু জাতীয়তাবাদী বক্তব্য নিয়ে দর্শকের সামনে হাজির হচ্ছে। যার মধ্যে ‘‌পদ্মাবত’‌ (২০১৮), ‘‌বাজিরাও মস্তানি’‌ (২০১৫) এবং সম্প্রতি মুক্তিপ্রাপ্ত ‘‌পানিপথ: দ্য গ্রেট বিট্রেয়াল’‌ ও ‘‌তানাজি: দি আনসাং হিরো’‌ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। 

অতি সূক্ষ্মভাবে হিন্দুত্বের শ্রেষ্ঠত্বের ধারণা, দেশের নাগরিকদের মধ্যে একটা বড় অংশ, মুসলিমদের বিরুদ্ধে ঘৃণার আবহ তৈরি করে দিচ্ছে চলচ্চিত্রের এই ধারাটি। ১৯ নভেম্বর ‘‌তানাজি’‌ চলচ্চিত্রটির ট্রেলার মুক্তি পাওয়ার সময়ই সিনেমাটির অভিনেতা অজয় দেবগণ বলেন, ছবিটি যে বিষয় নিয়ে নির্মিত হয়েছে সেটি ছিল একটি সার্জিক্যাল স্ট্রাইক, যা মুঘল সাম্রাজ্যকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল। এটির বিজ্ঞাপনী ট্যাগলাইনেও ‘‌সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’‌ শব্দটি জ্বলজ্বল করছে। কারণ আমাদের বুঝতে অসুবিধা হয় না। 

ভারত–পাকিস্তান, আরও পরিষ্কার করে বললে হিন্দু–মুসলিম সম্পর্ক আজ রাষ্ট্রীয় মদতে যে অবস্থায় দাঁড়িয়েছে তাতে সার্জিক্যাল স্ট্রাইক শব্দটি অতিরিক্ত মাত্রা যোগ করবেই। কিন্তু ১৬৭০ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি মহারাষ্ট্রের পুণের কাছে সিংগড়–এ ছত্রপতি শিবাজির অনুগত মারাঠা সেনানায়ক তানাজি মালুসারে ও মুঘল সেনাপতি প্রথম জয় সিংহের অনুগত উদয়ভানের মধ্যে যে যুদ্ধ হয়েছিল, তাতে হিন্দু–মুসলিম বিষয়টি ছিল না। ইতিহাস বলছে, রাজপুতরা তখন মুঘলদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে সাম্রাজ্য বিস্তারে মনোনিবেশ করেছিল। মারাঠারা এই যুদ্ধে জয়লাভ করলেও তানাজি মৃত্যুবরণ করেন।

সম্পূর্ণ সিনেমাটিতে গেরুয়া পতাকাকে মহিমান্বিত করার একটা প্রয়াস পরিলক্ষিত হয়। তানাজির মা বলছেন, ‘‌যব তক কোন্দহানা মে ফির সে ভগওয়া নেহি লহরতা, হাম জুতে নেহি পেহনেঙ্গে’‌ (যতক্ষণ পর্যন্ত দুর্গের চূড়ায় গেরুয়া ধ্বজা না উড়ছে ততক্ষণ আমি জুতো পরব না)। আবার এক জায়গায় উদয়ভানের উদ্দেশে তানাজি বলছেন, ‘‌হর মারাঠা পাগল হ্যায় স্বরাজ কা, শিবাজি রাজে কা, ভগওয়ে কা’‌ (প্রতিটি মারাঠা স্বরাজ, শিবাজি রাজা আর গেরুয়া ধ্বজার জন্য পাগল)। আর সিনেমার শেষটি আরও আকর্ষণীয়। সেখানে মারাঠা ধ্বজা শুধু গেরুয়া থেকে পরিবর্তিত হয়ে যায় ‘‌ওম’‌ লেখা ধ্বজায়; আর তখনই পরিষ্কার হয়ে যায় সিনেমার ‘‌লুকোনো উদ্দেশ্য’‌।

৬ ডিসেম্বর মুক্তি পাওয়া ‘‌পানিপথ’‌ ছবিটির ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। ইতিহাস–বিকৃতি এখানেও ছত্রে ছত্রে। সিনেমায় আহমেদ শা আবদালিকে (অভিনয় করেছেন সঞ্জয় দত্ত) দেখানো হয়েছে বয়স্ক হিসেবে। কিন্তু ইতিহাস বলছে, পানিপথের সেই যুদ্ধের সময়ে আবদালির বয়স ছিল ৩৯ বছর; যিনি সদাশিব রাওয়ের (অভিনয় করেছেন অর্জুন কাপুর) থেকে ৮ বছরের বড় এবং নানাসাহেব পেশোয়ার (অভিনয় করেছেন মণীশ বেহেল) থেকে ২ বছরের ছোট। ‘‌তানাজি’‌র উদয়ভানের থেকে ‘‌পানিপথ’‌ সিনেমায় আবদালির ভূমিকাকে উল্লেখযোগ্য হিসেবে দেখানো হয়েছে, কারণ আবদালি মুসলমান। পানিপথ ছবিতে বিভিন্ন সংলাপে ইতিহাসকে বিকৃত করে যা তুলে ধরা হয়েছে, তাতে ভারতীয় জাতীয়তাবাদের মানসিকতা প্রকাশ পেয়েছে। অথচ তখন সে অর্থে ভারত রাষ্ট্রেরই কোনও অস্তিত্ব ছিল না। 

অবশ্য এর আগেই সঞ্জয় লীলা বনশালি তাঁর ‘‌বাজিরাও মস্তানি’‌তে এই সমস্ত চলচ্চিত্র তৈরির মূল উদ্দেশ্য শিবাজির মুখ দিয়ে বলিয়ে দিয়েছেন, ‘‌আপনি ধরতি আপনি রাজ, ছত্রপতি শিবাজিকা এক হি স্বপ্না— হিন্দু স্বরাজ’‌। শুধুই হিন্দুত্ব? মোটেই না। উচ্চবর্ণের হিন্দুত্বের প্রচারই এই সিনেমাগুলোর মূল উদ্দেশ্য, যার সঙ্গে বিজেপি–র রাজনৈতিক মতাদর্শ অদ্ভুতভাবে মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে। ‘‌তানাজি’‌তে কাজল যে চরিত্রটিতে অভিনয় করেছেন, সে বলছে, ‘‌যব শিবাজি রাজে কি তলোয়ার চলতি হ্যায়, তব আউরতও কা ঘুংঘট আউর ব্রাহ্মণও কা জনেউ সলামত রহতা হ্যায়’‌। শিবাজি রক্ষা করছেন ব্রাহ্মণকে, তানাজিকে নয় (তানাজি কুলি সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি)। 

এ প্রসঙ্গে গত বছর সেপ্টেম্বরে লোকসভার স্পিকার ওম বিড়লার বক্তব্য স্মরণীয়। রাজস্থানের কোটায় এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, ‘‌ব্রাহ্মণরা সবসময় নেতৃত্ব দেয়। অন্যদের দিশা দেখায়। অবদান, আত্মত্যাগ ও নিষ্ঠার জন্য সমাজ তাঁদের শ্রদ্ধা করে।’‌ সেই একই বিষয় তিনি ট্যুইটেও লিখেছিলেন। ব্রাহ্মণদের প্রশংসা করে ফেসবুক পোস্টও করেছিলেন তিনি। লোকসভা স্পিকারের মতানুযায়ী সমাজের বাকি শ্রেণিগুলিকে দিশা দেখানোর কাজ করে ব্রাহ্মণরা। শুভক্ষণে জন্মের কারণেই সমাজের চোখে বিরাট শ্রদ্ধা পান তাঁরা। পাঠক–পাঠিকা একটু মিলিয়ে দেখুন— ‘‌তানাজি’‌র রঙিন জগৎ কীভাবে বাস্তবের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়।

আরও অনেক অনেক উদাহরণ এখনকার বহু সিনেমায় ছড়িয়ে আছে, যা আমাদের দেশে বহু মানুষের মস্তিষ্কে ‘‌স্লো পয়জনিং’‌ করে হিন্দুত্ব, উচ্চবর্গের হিন্দুত্ব ও ইতিহাস বিকৃতি ঢুকিয়ে দিচ্ছে। আর তার প্রভাব এখনকার রাষ্ট্রের নীতি নির্ধারণ, সংবিধান সংশোধন, শিক্ষানীতি থেকে শুরু করে রাজনীতি–সমাজনীতি–অর্থনীতি— প্রতিটি ক্ষেত্রেই পরিলক্ষিত হচ্ছে। সেই কারণেই এই ফ্যাসিস্ট প্রবণতার বিরুদ্ধে লড়াই অনেক অনেক শক্ত।‌‌

লেখক: সুদীপ্ত চক্রবর্তী। এই প্রতিবেদনটি আজকাল পত্রিকায় গত ১৬ই জানুয়ারি প্রকাশিত হয়েছে।

TwitterFacebookWhatsAppEmailShare

ভিডিও

আরও পড়ুন

Decorative Ring
Maa Ashchen