রাজ্যের জনহিতকর প্রকল্পে দিশাহারা সিপিএম, বাম বিমুখ জনতা

বলাইবাহুল্য যে সিপিএম বরাবর প্রকাশ্যে সরকারের প্রকল্পগুলোকে সমালোচনায় বিদ্ধ করে এসেছে, আজ নিজেদের দলের আত্মসমীক্ষামূলক বিশ্লেষণে সেই জনমোহনী প্রকল্পকেই গুরুত্ব দিয়ে; সিপিএম কার্যত প্রমান করে দিল তাদের রাজনৈতিক দূরদর্শীতার অভাব রয়েছে।

March 15, 2022 | 3 min read
Published by: Drishti Bhongi

রাজ্যবাসীর জন্য একাধিক জনহিতকর প্রকল্পের সম্ভার রয়েছে বাংলায়। জন্ম থেকে মৃত্যু, শিক্ষা থেকে বিয়ে, বাড়ি থেকে গাড়ি সব কিছুর জন্যই সরকারি প্রকল্পের পরিষেবা মেলে বাংলায়। এই সব প্রকল্পের সুবিধা পেতে দুয়ারে সরকারের মতো কর্মসূচিও নিয়েছে পশ্চিমবঙ্গ সরকার। এক কথায় জনহিতকর প্রকল্পে মন্ত্রমুগ্ধ হয়েছে বঙ্গবাসী।

রাজ্যের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ সরকারের বিভিন্ন প্রকল্পের সুবিধা পাচ্ছেন। অনেকের মতে, তাঁদের কাছে ভবিষ্যত চিন্তা বা অন্য কোন যুক্তি এই মুহূর্তে গ্রহণযোগ্যতা পাচ্ছে না। সেই কারণেই রাজ্য রাজনীতিতে বিরোধিতাও ক্রমশ কঠিন হয়ে যাচ্ছে। রাজ্য সম্মেলনের মঞ্চে বর্তমান পরিস্থিতিতে রাজ্য রাজনীতির এই বাস্তবতা কার্যত মেনে নিচ্ছে সিপিএম।

রাজ্যে গত বিধানসভা নির্বাচনে রাজ্যের শাসক দল বিপুল সাফল্য পায়, যার নেপথ্যে ছিল জনভিত্তি। জনহিতকর প্রকল্পগুলোই তা এনে দিয়েছিল। তৃতীয়বার সরকারে আসার পর থেকেই, দুয়ারে সরকার বা লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের মতো প্রকল্পের জেরে জনমানসে ব্যাপক সাড়া মিলেছে। যদিও রাজ্য রাজনীতির বিরোধীরা এই সব প্রকল্পের উপভোক্তাদের সুবিধাভোগী শ্রেণি বলেই কটাক্ষ করেন। তাদের মনোভাব নিয়ে নানান চর্চা চলছে রাজ্য রাজনীতিতে। বিরোধী দলের পক্ষে সরকারের এই জনমোহিনী নীতির সঙ্গে পেরে ওঠা কঠিন, দলগুলোর নির্বাচন পরবর্তী পর্যালোচনাতেও তা উঠে এসেছে। এবার সিপিএমের ২৬তম রাজ্য সম্মেলনের রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক প্রতিবেদনে সেই বিষয়টিকেই তুলে ধরে আনুষ্ঠানিকভাবে সেই বিষয়ে শীলমোহর দিল সিপিএম।

ইতিহাস বলে, প্রান্তিক, নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত মানুষদের কথা বলতে, সমাজের প্রান্তিকস্তরের মানুষদেরকে সঙ্গে নিয়েই গড়ে উঠেছে বামপন্থী আন্দোলন। ভোট বাক্সেও তার ফল মিলেছে। কিন্তু বর্তমানে দিন বদলেছে, প্রান্তিক মানুষের হৃদয়ে পৌঁছে, রাজ্যের অধিকাংশ মানুষের হাতে পশ্চিমবঙ্গ সরকার পৌঁছে দিয়েছে সরকারি সাহায্য, নানা প্রকল্পের আওতায় এসে পড়েছেন তারা। নানা প্রকল্পের বাঁধনে বেঁধে থাকা সাধারণ মানুষ, সরকারের কাছ থেকে সুবিধা পাওয়ায় বিরোধীদের কোন কথাই মানুষ আপাতত শুনতে চাইছেন না, এমটাই দাবি বামেদের। বামেদের মতে, রাজ্যের শাসক দলের সঙ্গে রাজনৈতিক লড়াই কঠিন হয়ে যাচ্ছে।

কলকাতার প্রমোদ দাশগুপ্ত ভবনে আজ থেকে শুরু হচ্ছে সিপিএমের ২৬তম রাজ্য সম্মেলন। সম্মলনে ১০৯ পাতার যে রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক রিপোর্ট পেশ হতে চলেছে, সেই রিপোর্টেই বিশ্লেষণ উঠে এসেছে— সরকারের নানা বিধ প্রকল্পের সুবিধা পাচ্ছেন সাধারণ মানুষ। এমন অনুদানমূলক প্রকল্প যে দীর্ঘস্থায়ী কোনও সমাধান নয়, বরং রাজ্যে শিক্ষা, শিল্প বা কর্মসংস্থানের চেহারা আশাপ্রদ নয়, এই যুক্তি মানুষ এখন কানে তুলছেন না। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘আমাদের রাজনীতিবোধে আমরা বুঝতে পারছি, কেমন ভাবে সাধারণ মানুষ অধিকার আদায়ের পথ থেকে সরে গিয়ে সরকারি দান-নির্ভর গ্রহীতায় পরিণত হয়ে পড়েছেন। কিন্তু সেই বোধ আমরা জনচেতনায় প্রতিষ্ঠা করতে পারিনি। আমাদের রাজনৈতিক বোধ থেকে অনেক ক্ষেত্রে এই প্রকল্পগুলির সীমাবদ্ধ চরিত্র প্রচার করেছি অথচ মানুষের বড় অংশ মানসিক ভাবে এগুলিকেই গ্রহণ করেছেন। ফলে, ভবিষ্যতের নিরিখে আমাদের বক্তব্য সঠিক হলেও মানুষ তা গ্রহণ করেননি’। মানুষের কাছে আগামীদিনের যুক্তি এখন গ্রহণযোগ্যতা পাচ্ছে না, তাই আপাতত ‘দুয়ারে সরকার’ বা ‘ই-শ্রম’ কার্ডের জন্য ফর্ম পূরণের কাজে সাধারণ মানুষকে সহায়তা করার জন্য দলীয় কর্মীদের পরামর্শ দিচ্ছে সিপিএম। পাশাপাশিই রিপোর্টে বলা হয়েছে, বামেদের হাতে এখন কোনও পঞ্চায়েত বা পুরসভা নেই বলেই কাজেরও কোনও সুযোগ নেই, এমন ভেবে নিলে ভুল হবে। সরকারি প্রকল্প বা প্রতিশ্রুতি পূরণে ব্যর্থতাকে হাতিয়ার করেও আন্দোলন গড়ে তোলার পথ খুঁজছে বামেরা।

বামেদের জনসমর্থন তলানিতে এসে ঠেকেছে, রাজ্য বিধানসভা নির্বাচনের তার প্রতিফলন দেখা গিয়েছে। তাই বাস্তব সত্য স্বীকার করে, আত্মসমীক্ষার কথা উঠে এসেছে সম্মেলনের রিপোর্টে। বামেদের সভা-মিছিলে এখনও ভিড় হয় কিন্তু ভোট আসে না— এই বহুচর্চিত ঘটনার কারণ অনুসন্ধানের কথাও বলা হয়েছে ওই রিপোর্টে। জানা যাচ্ছে, রিপোর্টে ‘আটটি বিষয় যা বিশেষ নজর দাবি করে’ শীর্ষক অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘মিছিল সমাবেশগুলিতে উৎসাহব্যঞ্জক উপস্থিতির প্রতিফলন ভোটের ফলে পড়ছে না। এটার কী কারণ, লাগাতার মানুষের সঙ্গে থেকে তাঁদের সমর্থন আদায় করার ব্যর্থতা অথবা মানুষের ভোটের অধিকার প্রয়োগকে জোর করে কেড়ে নেওয়ার বিরুদ্ধে আমাদের বলিষ্ঠ প্রতিরোধী ভূমিকার অভাব; নির্দিষ্ট পরিস্থিতি অনুযায়ী কারণ চিহ্নিত করে আমাদের অগ্রসর হতে হবে’। রিপোর্টে বলা হয়েছে, শাসক দলের বিরুদ্ধে সন্ত্রাস বা পেশিশক্তি প্রদর্শন, বলপূর্বক নির্বাচন করানো ইত্যাদি অভিযোগ করে ক্ষান্ত থাকলেই যে চলবে না, প্রতিরোধে এগোতে হবে। বুথ কমিটি তৈরির কাজ শুধু ভোটের সময়ের জন্য রেখে না দিয়ে সারা বছর বুথ স্তরে সক্রিয়তার ডাক দেওয়া হয়েছে অর্থাৎ ফের সংগঠন তৈরির কাজে নামতে চাইছে বামেরা।

বলাইবাহুল্য যে সিপিএম বরাবর প্রকাশ্যে সরকারের প্রকল্পগুলোকে সমালোচনায় বিদ্ধ করে এসেছে, আজ নিজেদের দলের আত্মসমীক্ষামূলক বিশ্লেষণে সেই জনমোহনী প্রকল্পকেই গুরুত্ব দিয়ে; সিপিএম কার্যত প্রমান করে দিল তাদের রাজনৈতিক দূরদর্শীতার অভাব রয়েছে।

TwitterFacebookWhatsAppEmailShare

ভিডিও

আরও পড়ুন

Decorative Ring
Maa Ashchen