Durga Puja 2025: যে বাড়িতে মা এসে গয়না পরেন, শিবকৃষ্ণ দাঁ-র বাড়ির দুর্গাপুজো কাহিনি জানেন?

নিউজ ডেস্ক, দৃষ্টিভঙ্গি, ১৪:৫০: জোড়াসাঁকোর শিবকৃষ্ণ দাঁ-র বাড়ির দুর্গাপুজো কলকাতার অন্যতম সেরা বনেদি বাড়ির পুজো। উনবিংশ শতকের শেষ ভাগ, বাংলার নানা প্রান্ত থেকে ব্যবসায়ীরা কলকাতায় আসতে শুরু করলেন। বর্ধমানের সাতগাছিয়া থেকে কলকাতায় আসলেন দাঁ পরিবারের প্রাণপুরুষ গোকুলচন্দ্র দাঁ। প্রচুর টাকা উপার্জন করে জোড়াসাঁকো অঞ্চলে ঠাকুরদালান সহ বসত বাড়ি নির্মাণ করলেন তিনি। ১৮৪০ থেকে সেখানেই দুর্গাপুজোর শুরু। ওই বছরই গোকুলচন্দ্র, এক আত্মীয়ের চার বছরের পুত্র শিবকৃষ্ণকে দত্তক নেন। সেই অর্থে এই বছর দাঁ বাড়ির পুজো ১৮২ বছরে পা দিতে চলেছে। বর্তমান এই বাড়ির ঠিকানা ১২, শিবকৃষ্ণ দাঁ লেন। গোকুলচন্দ্রের দত্তকপুত্র শিবকৃষ্ণ পারিবারিক ব্যবসাকে আরও বড় করে তোলেন। শিবকৃষ্ণের আমলেই এই বাড়ির দুর্গাপুজোর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে।
শিবকৃষ্ণ দাঁ-র সময়কাল ছিল জোড়াসাঁকো দাঁ পরিবারের স্বর্ণযুগ। সেকালের কলকাতায় প্রবাদ ছিল, দেবী মর্ত্যে এসে গয়না পরেন জোড়াসাঁকোর শিবকৃষ্ণ দাঁয়ের বাড়িতে। দাঁ বাড়ির প্রতিমার সুখ্যাতি ছিল অলঙ্কারের জন্যে। একদা নাকি দুর্গাপ্রতিমাকে সাজানোর জন্য প্যারিস আর জার্মানি থেকে হিরে আর চুনী বসানো গয়না আমদানি করতেন শিবকৃষ্ণ। আগের মতো না হলেও এখনও দাঁ-বাড়ির পুজোয় মাকে বহুমূল্য অলঙ্কার পরানো হয়। শিবকৃষ্ণের স্বর্ণালঙ্কারের প্রতি আকর্ষণ ছিল। শিবকৃষ্ণ দাঁ সাজগোজ করতে বড় ভালবাসতেন। সারাক্ষণ তিনি কয়েক ভরি সোনার গয়না পরে থাকতেন। একদিন ভাবলেন দেবী দুর্গাকেও মনের মতো করে একইভাবেই অলংকারে সাজাবেন। যেই ভাবা সেই কাজ। শোনা যায়, সম্ভবত জার্মানি স্বর্ণ-মানিক্য খচিত ভেলভেটের মেরুন শাড়ী আনা হয়েছিল। আনুমানিক ১৫০ বছরেরও অধিক সময় ধরে প্রতিবার পুজোর সময় এই একই ভেলভেটের শাড়ীতে সেজে ওঠেন দাঁ বাড়ির ‘কন্যা’ দুর্গা। আর এ শুধু মায়ের জন্য নয়, তার চার ছেলে, মহিসাসুর এমনকি দেবীবাহন সিংহের জন্যও একই ব্যবস্থা।
এছাড়াও সেই সময় দেবীর চালচিত্রের কিছু অংশ জার্মানি থেকে নিয়ে আসা হয়েছিল বলে জানা যায়। চালচিত্র উজ্জ্বল এবং ঝকঝকে করার জন্য তামা ও পিতল দিয়ে তৈরি একরকম ধাতুর পাত শিবকৃষ্ণ আনিয়েছিলেন। প্রতিমার চালচিত্রে আজও এই পাত ব্যবহৃত হয়। এই পরিবারে ঠাকুরের জন্য যে ছাতা ব্যবহার করা হয় সেটি মোলায়েম ভেলভেটের কাপড়ের তৈরি, সেই সঙ্গে সোনা এবং রূপোর জরির কাজে ঠাসা। এই ছাতাটি কলা বউ স্নান করানোর জন্য নিয়ে যাওয়া হয়।
রথযাত্রার দিন কাঠামো পুজো করা হয়। আগে এক সময় শাল কাঠ দিয়ে দেবীর কাঠামো তৈরি হত। যদিও এখন গরান কাঠ দিয়ে তা বানানো হয়। জন্মাষ্টমীর দিন কাঠামোতে দেবীর মস্তক স্থাপন করা হয়। অন্য দেবদেবীর মস্তক স্থাপন হয় পরে। পটুয়ারা দেবীর চালচিত্র তৈরি করেন। মহালয়ার পরের দিন প্রতিপদে থেকে এই বাড়ির পুজো আরম্ভ হয়, দেবীর বোধন হয়। দেবীর প্রাণ প্রতিষ্ঠার সময় তেরোটি শাড়ি ও তেরোটি কাঁসার পাত্র দেওয়া হয়। এছাড়াও একশো আটটি পেতলের প্রদীপ সাজানো হয়। দাঁ বাড়ি বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষিত বলে, এখানে পশুবলি হয় না। বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষিত বলেই এ বাড়ির প্রতিমার সঙ্গে আধুনিক রূপের সাদা সিংহের দেখা মেলে। অব্রাহ্মণ পরিবার হওয়ায় দাঁ বাড়িত অন্নভোগের চল নেই। চাল, ডাল, বিভিন্ন ফল ও নিষ্টান্ন নৈবেদ্য রূপে অর্পণ করা হয়। এই বাড়ির পুজোর বিশেষ বৈশিষ্ট্য হল কলাবউয়ের ছাতা। সপ্তমীর দিন ভোরে ঢাক-ঢোল বাজিয়ে শোভাযাত্রাসহ বিরাটা এক কারুকার্যখচিত ছাতায় ঢেকে গঙ্গায় নবপত্রিকাকে স্নান করাতে নিয়ে যাওয়া হয়। আগেকার দিনে কলকাতার বনেদি পরিবারগুলিতে গৃহদেবতাদের স্থানান্তরের সময় ছাতা ব্যবহার করা হত। ইংল্যান্ড থেকে আমদানি করা হত সে সব ছাতা। ঢাকা বা বারাণসী থেকে আসা দক্ষ কারিগরেরা সেই ছাতার উপরে সরু সোনা ও রুপোর তার দিয়ে নকশা তৈরি করতেন। দাঁ-বাড়িতে এখনও সপ্তমীর সকালে নবপত্রিকাকে স্নান করাতে যাবার সময়ে সেই রকম ভেলভেটের উপরে সোনা-রুপোর তারের কাজ করা বড় ছাতা ব্যবহার করা হয়। সন্ধিপুজোয় এক বিশেষ রীতি রয়েছে। এবাড়ির পুজোয় নারীরা থাকেন নেপথ্য। সন্ধিপুজোর সমস্ত কাজ পরিচালনা করেন বাড়ির পুরুষেরা, বাড়ির ছেলেরা, জামাইয়েররা সকলে মিলে। অষ্টমীর দিন কুমারী পুজো হয়। আগে নবমীর দিন এই বাড়ির ঠাকুরদালানের সামনে বা বৈঠকখানার ঘরে গানবাজনার আসর বসত। পুজোর সময় নাটক ও যাত্রা হত। দোতলার বারান্দা থেকে মেয়েরা অনুষ্ঠান দেখতেন।
দশমীর দিনের এক বহুল প্রচলিত গল্প রয়েছে। প্রতিমা বিসর্জনের সময় ৪০ জন বাহক দেবীকে নিরঞ্জনের জন্যে গঙ্গার ঘাটের কাছে নিয়ে যেতেন। বাহকদের প্রতি নির্দেশ দেওয়া হত, তারা যেন দেবীকে কাঁধে করে বিসর্জন দিতে নিয়ে যাওয়ার সময় ঠাকুরবাড়ির সামনে দেবীকে বেশ কয়েকবার ঘুরিয়ে নেন। হুকুম দেওয়া থাকত। চলত ঢাক-ঢোল, বাজনা বাদ্যি। আদপে ঠাকুরবাড়ির সদস্যদের ঈর্ষা উদ্রেক করতেই এমন নির্দেশ দেওয়া হত। তবে এখন সেই সব চুকে গিয়েছে। লরিতে করেই দেবী নিরঞ্জনে যান। তবে আজও পুজো হয়ে চলেছে জোড়াসাঁকোর শিবকৃষ্ণ দাঁর বাড়িতে। ইতিহাস, ঐতিহ্যের মিশেলে দাঁ বাড়ির পুজোর আর কলকাতার বনেদি বাড়ির পুজো আজ সমার্থক হয়ে উঠেছে।