বাংলায় জন্ম বিখ্যাত জগতে, এক নজরে দেখে নিন বাংলার গর্বদের
এই বাংলতেই এমন অনেক জিনিস পাওয়া যায়, যার দেখা কেবল বাংলাতেই মিলতে পারে। বাংলায় তাদের জন্ম হলেও তারা বিখ্যাত ভারতে।
Authored By:
সৌভিক রাজ

বাংলার হল সমৃদ্ধির অপার ভাণ্ডার, একে রত্ন ভাণ্ডার বললেও অত্যুক্তি হয় না। কী নেই আমাদের বাংলায়, লোকসংস্কৃতি থেকে শুরু করে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য; সবেতেই অনন্য বাংলা। এই বাংলতেই এমন অনেক জিনিস পাওয়া যায়, যার দেখা কেবল বাংলাতেই মিলতে পারে। বাংলায় তাদের জন্ম হলেও তারা বিখ্যাত ভারতে।
বাংলা ও বাঙালির গর্বদের খোঁজ করল দৃষ্টিভঙ্গি :
দার্জিলিং চা বা রসগোল্লাই শুধু নয়, জগৎবিখ্যাত একাধিক জিনিসের ভৌগোলিক স্বত্ত্ব পেয়েছে বাংলা। নকশি কাঁথা, শান্তিনিকেতনের চামড়ার দ্রব্য, লক্ষ্মণভোগ আম, খিরসাপাটি বা হিমসাগর আম, মালদার ফজলি আম, শান্তিপুরের তাঁত, বালুচরী শাড়ি, ধনিয়াখালি শাড়ি, জয়নগরের মোয়া, বর্ধমানের সীতাভোগ ও মিহিদানা, গোবিন্দভোগ ও তুলাইপাঞ্জি চালের মতো জিনিসগুলিও রয়েছে জিআই রেজিস্ট্রশনের তালিকায়। বাংলার গর্বের এই জিনিসগুলিও বিশ্ববন্দিত। শুরুটা চা দিয়েই হোক…
দার্জিলিং চা :

দেশের সর্বপ্রথম জিআই ট্যাগ লাভ করে বঙ্গের এই অনন্য সম্পদ। শুনতে অবাক লাগলেও এটাই ঘোর বাস্তব। দেশের প্রথম জিআই নথিভুক্ত বস্তু ছিল বিশ্ববিখ্যাত দার্জিলিং চা। স্বাদে-গন্ধে অতুলনীয় এই ভূবনমোহিনী চা ২০০৪ সালে জিআই রেজিস্ট্রেশন পায়। শুধু দার্জিলিং চা-ই নয়, এমন বহু অমূল্য সম্পদ রয়েছে বাংলার ভাঁড়ারে যা দেশের মানচিত্রে এক স্বতন্ত্র জায়গা করে নিয়েছে।
বাংলার অনেক হস্তশিল্পও পেয়েছে এই স্বীকৃতি।
নকশীকাঁথা :

বাংলার হস্তশিল্পগুলোর মধ্যে সর্বপ্রথম জিআই ট্যাগ পেয়েছে নকশীকাঁথা। ২০০৮ সালে এই শিল্পকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছিল। বীরভূমের বিভিন্ন অঞ্চলে এই ধরনের কাজ দেখা যায়। সাধারণ কাঁথার চেয়ে এতে কারুকার্য অনেক বেশি থাকে। সূক্ষ্ম সুতোর কাজে নানা ধরনের গল্প ফুটে ওঠে এক একটা কাঁথায়। ফুল-পাতা-পশু-পাখি ছাড়াও নানা ধরনের লোকগল্প দেখা যায় এই নকশায়।
বাঁকুড়ার টেরাকোটার ঘোড়া :

বিশ্ব জুড়ে বাঁকুড়ার টেরাকোটার খ্যাতি। যারা বাঁকুড়ায় ঘুরতে যান, ঘর সাজানোর জন্য বা কাউকে উপহার দেওয়ার জন্য তারা ঘোড়া কিনে আনেন। ২০১৮ সালে এই শিল্প জিআই ট্যাগ পেয়েছিল।ডোকরার গয়না বেশ কয়েক বছর ধরে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।
মনসা চালি :

মনসা চালি বা মনসা বারি হল দেবী মনসার অনন্য মাটির প্রতিমা। যা পোড়ামাটি শিল্পকলার নিদর্শন। বাঁকুড়ার পাঁচমুড়ার মনসা চালি ২০১৮ সালে জিআই স্বীকৃতি লাভ করেছিল।
ডোকরা :

ঘর সাজানোর জন্য অনেকেই ডোকরার নানা রকম মূর্তি বা শিল্পকর্ম পছন্দ করে। বাংলা ডোকরার জিওগ্রাফিক্যাল ইন্ডিকেশন পেয়েছে।
পটচিত্র :

বাংলার শিল্পকলার অনন্য নিদর্শন এটি, পিংলা বা পুরুলিয়ার পটচিত্র বিশ্বখ্যাত। ছবির মাধ্যমে গল্প বলে এই শিল্প। নানা লোককথা, পুরাণের পৌরাণিক গল্প পটশিল্পীদের তুলীর টানে ফুটে ওঠে। বেশির ভাগ প্রাকৃতিক রং ব্যবহার হয়। কাগজ ছাড়াও এই ধরনের ছবি এখন পোশাক কিংবা বাসনপত্রেও আঁকা হয় সাজিয়ে রাখার জন্য। পটচিত্রের চাহিদা রয়েছে দেশের বাইরেও। বইমেলা, হস্তশিল্প মেলা, সাধারণ মেলাতেও এই শিল্পীরা এসে তাঁদের কাজের পসরা মেলে বসেন।
ছৌনাচের মুখোশ :

ছৌনাচের খ্যাতি দেশজুড়ে, এমনকি বিদেশেও বিস্তৃত। ছৌনাচের মাধ্যমে পৌরাণিক কাহিনী ফুটিয়ে তোলা হয়, নাচ দেখানোর সময় নৃতশিল্পীরা যে বড় বড় মুখোশ পরে নাচেন, তাও জিআই ট্যাগ প্রাপ্ত। অনেকেই এই অভিনব মুখোশ দিয়ে ঘর সাজাতে ভালবাসেন। হস্তশিল্প মেলায়। জিআই-প্রাপ্ত মুখোশের তালিকায় অবশ্য রয়েছে কুশমন্ডির কাঠের মুখোশও।
শান্তিনিকেতনের চামড়ার ব্যাগ :

বাঙালি জাতিকে শিল্পমুখী করার চেষ্টায় ত্রুটি রাখেননি রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর পুত্র রথীন্দ্রনাথ। কেবল শান্তিনিকেতন নয়, এদেশে ট্যানারি শিল্পের অন্যতম পথিকৃৎ ছিলেন রথী ঠাকুর। শান্তিনিকেতনে তাঁরই উদ্যোগে চামড়ায় ব্যাগ তৈরি শুরু হয়েছিল। যা আজ জগৎবিখ্যাত।
মাদুরকাঠি :

মেদিনীপুর জেলা এই কুটিরশিল্পের জন্য জগৎজোড়া খ্যাতি পেয়েছে। মাদুরকাঠির তৈরি মাদুর সর্বত্র সমাদৃত।
এবার আসি খাবারে…
রসগোল্লা :

রসগোল্লা কার? বাংলার না ওড়িশার? দীর্ঘদিন ধরে চলা সেই বিতর্কের যবনিকা পড়েছে। রসগোল্লা বঙ্গেরই এমনটাই জানিয়ে দিয়েছে জিওগ্রাফিক্যাল ইন্ডিকেশন বা জিআই কর্তৃপক্ষ। দিনটি ছিল রসগোল্লা দিবস, ১৪ই নভেম্বর, ২০১৭। ওই জয়কে উদযাপন করতে প্রতিবছর ১৪ই নভেম্বর দিনটি বাংলায় রসগোল্লা দিবস হিসেবে পালিত হয়।
সীতাভোগ-মিহিদানা :

বড়লাট কার্জনের বর্ধমান যাত্রাকে স্মরণীয় করে রাখতেই এই দুই মিষ্টির জন্ম হয়েছিল। আজ যা বর্ধমান জেলার কার্যত সমার্থক। বর্ধমান মিষ্টির দুটির জিওগ্রাফিক্যাল ইন্ডিকেশন ট্যাগ জয় করেছে।
জয়নগরের মোয়া :

বাঙালির শীতকাল মানেই জয়নগরের মোয়া। ২০১৮ সালে এই মোয়ার ভৌগোলিক স্বত্ব পেয়েছে বাংলা।
তবে রসগোল্লার পরে বাংলার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে স্থানীয় মিষ্টান্নগুলির জিআই স্বীকৃতির জন্য দাবি জোরাল হয়েছে। যেমন কাটোয়ার ক্ষীরের পান্তুয়া ও রানাঘাটের ছানার পান্তুয়া, চন্দননগরের জলভরা, কৃষ্ণনগরের সরভাজা-সরপুরিয়া, শান্তিপুরের নিখুতি, বহরমপুরের ছানাবড়া, শক্তিগড়ের ল্যাংচা, বিষ্ণুপুরের মোতিচুড়, কামারপুকুরের সাদা বোঁদে, মালদার রসকদম্বের জন্য জিআই ট্যাগের দাবি উঠেছে। সেগুলি আদৌ বিবেচ্য হবে কিনা তা সময়ই বলবে। তবে বাংলার ভাঁড়ারের এই অমূল্য সম্পদগুলি যে অতুলনীয় তা নিয়ে কোনও সন্দেহের অবকাশ নেই।
এছাড়াও বাংলার তিন বিখ্যাত শাড়ি, শান্তিপুরী তাঁত, ধনেখালি তাঁত এবং বালুচরী শাড়ির জন্য যথাক্রমে নদীয়ার শান্তিপুর, হুগলির ধনেখালি এবং মুর্শিদাবাদ জিআই স্বীকৃতি পেয়েছে। চালের মধ্যে উত্তর দিনাজপুরের তুলাইপাঞ্জি চাল ২০১৭ সালে ভৌগোলিক স্বীকৃতি পায়। ২০১১ সালে, গোবিন্দ জীয়ের ভোগে নিবেদন করা চাল অর্থাৎ গোবিন্দ ভোগ চালের ভৌগোলিক স্বীকৃতি পেয়েছিল বাংলা। মালদহের তিন বিখ্যাত আম ফজলি, হিমসাগর, লক্ষ্মণ ভোগ বাংলাকে গর্বের ভৌগোলিক স্বীকৃতি এনে দিয়েছে।

তবে বিগত বছর পাহাড়ে লঙ্কা কাণ্ড বেঁধেছে।
ডলে খুর্সানি লঙ্কা :

দার্জিলিং-এর বিখ্যাত ডলে খুর্সানি লঙ্কা, যা পৃথিবীর অন্যতম ঝাল লঙ্কা। মূলত দার্জিলিং, সিকিম এই সব পার্বত্য এলাকায় চাষ হয় এই লঙ্কা। তবে এই লঙ্কা কিন্তু লম্বা নয়, বরং চেরির মতো ছোট এবং গোল এর আকৃতি।
২০২১ সালের ১৪ই সেপ্টেম্বর ডলে খুর্সানি লঙ্কার ভৌগলিক স্বত্ত্ব পেল বাংলার দার্জিলিং ও কালিম্পং। ভীষণই ঝাল এই লঙ্কা, স্থানীয় উচ্চারণে একে ডল্লে বলা হয়। এই লঙ্কার আচার দেওয়ারও চল রয়েছে, যা স্বাদে অতুলনীয়।