মধ্যপ্রাচ্যের খানা হালিম, আজ ইফতারের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ

পবিত্র রমজান মাসে অনেকেই রোজা রাখেন এবং রোজা ভাঙার পরেই শুরু হয় ইফতারের খাওয়া দওয়া। বিরিয়ানি, কাবাব, শরবত, হালুয়া ছাড়াও ইফতারের সঙ্গে মিশে থাকে আরও অনেক খানা।

April 4, 2022 | 4 min read
Published by: Drishti Bhongi

সৌভিক রাজ

শুরু হয়ে গিয়েছে রমজান মাস। রমজান একটি আরবি শব্দ। এই মাসেই ইসলাম ধর্মের পঞ্চমস্তম্ভের মধ্যে অন্যতম একটি হিসেবে বিবেচিত হওয়া রোজা পালন করা হয়। রোজাকে আরবি ভাষায় ”সাওম’ বলা হয়। যার অর্থ বিরত থাকা; এর বহুবচন হল ‘সিয়াম’। ফারসি, উর্দু, হিন্দি ও বাংলায় সাওমকে ‘রোজা’ বলা হয়। একই সঙ্গে উপবাসকে পারসি ভাষায় ‘রোজা’ বলা হয়। ভারতে পারসি প্রভাব বেশি হওয়ার কারণে এদেশে রোজা শব্দটি বেশি ব্যবহৃত হয়। মুসলমানরা ফজরের নামাজের মাধ্যমে রোজা শুরু করেন এবং সূর্যাস্তের পর উপবাস ভঙ্গ করেন। সূর্য ওঠার আগে নামাজের পর ‘সেহরি’ খেয়ে উপবাস শুরু করতে হয়। সারাদিন নির্জলা উপবাস রেখে সন্ধ্যাবেলার সূর্য ডুবলে, আজানের পর ইফতারের মাধ্যমে উপবাস ভঙ্গ করার নিয়ম।

পবিত্র রমজান মাসে অনেকেই রোজা রাখেন এবং রোজা ভাঙার পরেই শুরু হয় ইফতারের খাওয়া দওয়া। বিরিয়ানি, কাবাব, শরবত, হালুয়া ছাড়াও ইফতারের সঙ্গে মিশে থাকে আরও অনেক খানা।

হালিম :

হালিম খাঁটি মধ্য প্রাচ্যের খাবার, যা হয়ে গেল এই উপমহাদেশীয়। এই খাবারটি ছাড়া রমজান অসম্পূর্ণ। হায়দরাবাদ এই রান্নায় সুখ্যাতি অর্জন করেছে। ডাল-মাংস দিয়ে তৈরি একটি পদ যে এত ভালবেসে ফেলবে এই ভারতীয় উপমহাদেশের বাসিন্দারা, তা দেশে হালিমের জনক হায়দরাবাদের নিজামরাও ভাবতে পারেননি।

হালিমের উৎপত্তি হয় হারিস নামে জনপ্রিয় আরব দেশীয় একটি পদ থেকে। হারিসের সবচেয়ে পুরনো লিখিত রেসিপি পাওয়া যায় খ্রিস্টীয় দশম শতকে লেখা বাগদাদী রান্নার বই কিতাব-আল-তাবিখে। এই বইটিতে সংকলন করা হয়েছিল তৎকালীন রাজা বাদশাহদের খাবার টেবিলের উপাদেয় বেশ কিছু খাবারের রন্ধনপ্রণালী। বইটির লেখক আবু মুহাম্মদ আল মুজ্জাফর ইবন সায়ার। ইবন বতুতা তার ভ্রমণ কাহিনীতেও পারস্যে ডাল, ঘি এবং গোশত দিয়ে রান্না করা হারিসের কথা উল্লেখ্য করেছেন। রন্ধন ইতিহাসবিদ ক্লডিয়া রডেনের মতে উপমহাদেশের হালিম মধ্যপ্রাচ্যের হারিস নামক এক ধরনের ডাল ও মাংসের মিশ্রণ জাতীয় খাবার থেকে উৎপত্তি হয়েছে। হারিশা ইরাক, সিরিয়া, লেবানন, ইয়ামেন ও আরব বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সকলের কাছে উপাদেয় একটি পদ।

রন্ধন বিশেষজ্ঞ আনিসা হেলউ তার লেবানী রন্ধনশৈলী গ্রন্থে লিখেছেন, গরিবদের একসাথে খাওয়ানোর জন্য বড় ডেকচিতে হারিস রান্না করা হত। ভারতবর্ষে হারিসের আগমন মুঘলদের মাধ্যমে। দ্বিতীয় মুঘল সম্রাট হুমায়ুনের আমলে ভারতে হারিসের আগমন হলেও হারিস ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায় হুমায়ূনের পুত্র সম্রাট জালাউদ্দিন আকবরের আমলে। আকবরের আমলে লেখা আবুল ফজলের আইন-ই-আকবরী গ্রন্থে হারিসের উল্লেখ পাওয়া যায়।

হালিমের ভারতে আগমনের গল্প জানতে গেলে পিছিয়ে যেতে হবে অনেকটা পথ! এই ডিশটির পূর্বপুরুষ হল, হারিস। এই হারিস তৈরি হত পারস্য সম্রাট খুসরোর রাজকীয় হেঁশেলে, ষষ্ঠ শতকে। তার প্রকায় এক শতক পরে, দামাস্কাসের খলিফা ইয়েমেন থেকে আগত এক প্রতিনিধি দলের জন্য প্রথম এই পদটি পরিবেশন করেন! এঁরা অনেক দূর থেকে, ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত হয়ে এসেছিলেন, তাই এই ডাল-মাংসের কম্বিনেশনে তাঁদের চটজলদি উদরপূর্তি এবং এনার্জিপূর্তি, দু’টিই হয়েছিল। তারপর থেকেই এটা প্রায় ট্র্যাডিশনের রূপ পায়। যখনই সৈন্যাবাহিনী যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ফিরত, তাদের পরিবেশন করা হত এই ইনস্ট্যান্ট এনার্জি বুস্টার ডিশটি। ১৪শতকে বিখ্যাত পরিব্রাজক ইবন বতুতার লেখাতেও এই হারিস পরিবেশনের উল্লেখ পাওয়া যায়। মোগল সম্রাট হুমায়ুন যখন শের শাহের কাছে পরাজিত হয়ে পারস্যে আশ্রয় নিয়েছিলেন, তখন মোগল হেঁশেলেও স্থানীয় পাচক মারফত জায়গা করে নেয় এই হারিস। তবে হারিসের হালিমে রূপান্তর কিন্তু হায়দরাবাদের নিজামের হাত ধরেই!

১৯ শতকে নিজামি রান্নাঘরে হারিস ঢোকে, আসলে এই সময় ইয়েমেনি যোদ্ধার দল চৌশরা নিযুক্ত হয় নিজামের দেহরক্ষী হিসেবে। তাদের একটি গ্রাম দেওয়া হয় বসবাসের জন্য। এই যোদ্ধারা নিজেদের সনাতনী খাবার ও স্থানীয় মালমশলা মিশিয়ে তৈরি করে হারিসের নতুন রূপ হালিম। তখন হালিম হত শুধু গোরুর মাংস দিয়ে এবং নোনতা ও মিষ্টি, দু রকমের হালিমই তৈরি করা হত। চৌশদের কাছ থেকে হালিম আসে নিজামের খানসামাদের কাছে এবং সেখান থেকে নিজামের ব্যক্তিগত ফেভারিট হয়ে ওঠে এই পদটি।

ডাল, গম, মাংস (মূলত বিফ বা মটন, যদিও এখন চিকেন হালিমও পাওয়া যায়), নানা রকমের গরম মশলা দারচিনি, শাজিরে, এলাচ ইত্যাদি, নানা রকমের বাদাম, ঘি, কাজু, কিসমিস, আমন্ড, পেস্তা ইত্যাদি ইত্যাদি দিয়ে হালিম তৈরি হল। এত সব উপকরণ থাকলে, সেই পদ সুস্বাদু তো বটেই, সুখাদ্যও হবে। নানা গুণে সমৃদ্ধ খাবারটি খেয়ে উপবাস ভঙ্গ করলে নাকি সারাদিনের যে পুষ্টিজনিত খামতি, তা অনায়াসে পূরণ করা যায়, সেই কারণের ইফতারি খানা হিসেবে এর জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পেয়েছে। এখন যত রকমের হালিম পাওয়া যাক না কেন, আদপে হালিমের কেবল দুটি প্রকারভেদই আছে, সেটি হল বিফ হালিম এবং মটন হালিম।

পদটি মূলত রমজান মাসেই সব মোগলাই খাবারের দোকানে মেলে। হালিম ঢিমে আঁচে প্রায় ১০-১২ ঘণ্টা ধরে রান্না করাটাই দস্তুর। কলকাতায় জাকারিয়া স্ট্রিটে রমজান মাসে নানা ধরনের হালিম পাওয়া যায়। খাস কলকাতার বুকে জাকারিয়াকেই হালিমপীঠ বলা যায়। ​

TwitterFacebookWhatsAppEmailShare

ভিডিও

আরও পড়ুন

Decorative Ring
Maa Ashchen