মহাশিবরাত্রির ইতিহাস এবং বিবর্তন

এ রাত্রিতে উপবাস করলে আমি অত্যন্ত সন্তুষ্ট হই। স্নান, বস্ত্র, ধূপ, পুষ্প ও অর্চনায় আমি যতটুকু সন্তুষ্ট হই তার চেয়ে বেশি সন্তুষ্ট হই শিবরাত্রির উপবাসে।

February 26, 2025 | 3 min read
Published by: Drishti Bhongi

নিউজ ডেস্ক, দৃষ্টিভঙ্গি: পুরানে কথিত আছে একদা পার্বতী শিবকে প্রশ্ন করেছিলেন, ভগবান, আপনি ধর্ম, অর্থ, কাম ও মোক্ষ-দাতা। আপনি কোন ব্রত বা তপস্যায় সন্তুষ্ট হন? দেবী পার্বতীর কথা শুনে শিব বললেন,

দেবী, ফাল্গুন মাসের কৃষ্ণপক্ষের চতুর্দশী তিথীর রাত্রিকে শিবরাত্রি বলা হয়। এ রাত্রিতে উপবাস করলে আমি অত্যন্ত সন্তুষ্ট হই। স্নান, বস্ত্র, ধূপ, পুষ্প ও অর্চনায় আমি যতটুকু সন্তুষ্ট হই তার চেয়ে বেশি সন্তুষ্ট হই শিবরাত্রির উপবাসে।

শিব ব্রতপালনের সহজ উপায় বাতলে দেন। এ ভাবে শিবরাত্রিব্রত পৃথিবীতে প্রচলিত হল। ফাল্গুন চতুর্দশীর কৃষ্ণপক্ষের মহানিশিতে মহাদেবের ‘জ্যোতির্লিঙ্গ’ প্রতীকরূপে আবির্ভাবের পবিত্রক্ষণটি পালনে ভারতের ঘরে ঘরে, মন্দিরে মন্দিরে বেজে ওঠে ‘ওঁ নমঃ শিবায়’ মন্ত্র। মহাশিবরাত্রির মহোৎসবে মেতে ওঠে গ্রাম ও শহরের মানুষ। বিশেষত মহিলারা।

শিব-পার্বতীর প্রণয়-ভালোবাসার রোম্যান্টিক কাহিনি খুব লোকপ্রিয়। পার্বতীর কঠোর সাধনায় মহাদেব তুষ্ট হয়ে বিয়েতে রাজি হলেন। এবং বিয়ের দিন বাঘছাল পরিহিত, সাপখোপ-ত্রিশূল-ডমরুশোভিত বর ভূতপ্রেত, নন্দী-ভৃঙ্গী সঙ্গীসাথীদের নিয়ে নাচতে নাচতে বিবাহবাসরে হাজির হলেন। পাড়াপড়শির তা দেখে কী হাল হল জানি না, তবে জামাতাকে দেখে হবুশাশুড়ি জ্ঞান হারালেন! পার্বতী প্রমাদ গুনলেন। মাকে শান্ত করতে শিবকে তিনি সুদর্শন মূর্তি ধারণের অনুরোধ করেন। পার্বতীর মনোবাঞ্ছা পূরণ করলেন শিবঠাকুর। এই মহাশিবরাত্রির রাতেই তাঁদের বিবাহ ঘটে। সেই জন্যই হয়তো শিবরাত্রি পারিবারিক সুখ-সমৃদ্ধি, মহাদেবের মতো উদার স্বামীলাভ, দীর্ঘ দাম্পত্যসুখের প্রতীক হয়ে দাঁড়ায়।

পার্বতীর মতো স্বামী পাওয়ার বাসনায় ভারতবর্ষের মহিলাকুল এরপর নীলকণ্ঠ শিবের মাথায় জল ঢালার ব্যাপারটা নিজেদের এক্তিয়ারে নিয়ে নেওয়ায় শিবরাত্রির উপর কালেকালে যেন মেয়েদের একচেটিয়া অধিকার— এমন ধারণাই চলে এসেছে।

হিন্দুধর্ম পাঁচ হাজার বছরের দীর্ঘপথ পরিক্রমার পর আজকের ইলেকট্রনিক সমৃদ্ধির যুগে এসে পৌঁছেছে। একবিংশ শতাব্দীতে তাই শিবরাত্রি পালনে কিছু কিছু পরিবর্তন নজরে পড়ে। আমাদের জীবনে ধর্মের অনুশাসন কমেছে। ধর্মের আফিং খেয়ে মন্দকে ভালো বলার মানসিক জড়তা অনেক মেয়েই কাটিয়ে উঠেছেন। একালের নারী তাঁর আর্থসামাজিক অধিকার নিয়ে সচেতন। শিবমাহাত্ম্যে সে নারীর পুরোপুরি আস্থা রাখা সম্ভব এখনও? নাকি গ্রামের বা ‘স্বল্পশিক্ষিত’ মেয়েদের মধ্যেই যুগ যুগ ধরে চাপিয়ে দেওয়া এই ব্রত এখন সীমিত? চাকুরিরতা মহিলাদের ব্যস্তজীবনে ব্রত উদ্‌যাপনের অনুকূল অবসর বা ইচ্ছা কি কমছে? এখন ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলি অনেকাংশেই উৎসবমুখর হয়ে উঠেছে। নিছক আমোদ-আহ্লাদের উপকরণসমৃদ্ধ অভ্যাসেও পরিণত হচ্ছে। চটুল নাচগান, সাজসজ্জা, থিমসর্বস্ব, মাইকের দৌরাত্ম্য আমাদের ধর্মীয় বাতাবরণের সুষমা কেড়ে নিচ্ছে। শিবরাত্রির ক্ষেত্রেও সারা রাত সিনেমা দেখার বা নাচাগানা করার, সাজসজ্জা ও আড়ম্বরের অনুপ্রবেশ ঘটে যাচ্ছে। পুজোআচ্চার নামে আমরা বিশ্বাস আর অভ্যাসের দাসত্ব করে চলেছি কি না— সেই দোলাচলটা যুক্তিনির্ভর বিজ্ঞানভিত্তিক সমাজের মনে জাগছে কি? মনে হয় না। কারণ শিবরাত্রি অনেক
ঘরেই সমারোহে পালিত হচ্ছে। কিছুটা হাজার হাজার বছরের ভক্তি ও অন্ধবিশ্বাসে, কিছুটা অভ্যাসে আর কিছুটা হয়তো উৎসবপ্রিয়তায়।

তবে এটাও ঠিক, ত্রিনয়নে আত্মদর্শনের মগ্নতা এবং অসীমকে প্রত্যক্ষ করার দুর্বার রহস্যময়তা শহরের আধুনিকমনস্ক মহিলাদেরও শিবরাত্রির মাহাত্ম্যের দিকে হয়তো কিছুটা আকৃষ্ট করছে। এজন্য শিবঠাকুরকেই আমরা বিশেষ ক্রেডিট দেব কারণ তিনি একাধারে লৌকিক এবং বৈদিক দেবতা।

সমাজের চোখে মহিলাদের ব্রতপালনের এই রীতি শাঁখা-সিঁদুরের মতোই স্বামীর প্রতি আনুগত্য দেখানোর আরও একটি বেড়ির সমান। আজকের যুগে নারী-পুরুষের যখন সমাজ-সংসারে সমানাধিকার নিয়ে সর্বত্র ভাবনা চলছে, সেখানে ব্রতপালনেও স্বামী-স্ত্রীর হাত ধরাধরিই তো কাম্য। একজন আনুগত্য প্রকাশে ব্রত রাখবেন, আর একজনের কোনও দায়িত্বই নেই?

বিয়ে ছাড়াও সমাজে নারীপুরুষের একসঙ্গে বসবাসে (লিভ ইন) সমাজের অনুমোদন পাওয়ায় বিয়ের গুরুত্বও কমেছে। বিয়েও এখন আগের মতো চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত নয়। মেয়েরা শ্বশুরবাড়িতে অন্যায়-অত্যাচার মেনে নেয় না। স্বামী-স্ত্রীর বনিবনার অভাবে বিবাহবিচ্ছেদ এখন খুবই স্বাভাবিক। স্বনির্ভর মেয়েদের জীবনে নানাভাবেই পুরুষনির্ভরতা কমে গিয়েছে। দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনে শিবের মতো আলুথালু অগোছালো, ভুঁড়িওয়ালা পুরুষের চেয়ে ঝকঝকে বলিয়েকইয়ে পুরুষই হয়তো মেয়েদের এখন বেশি পছন্দ! এমনকী স্বামীর মাত্রাছাড়া ধূমপান বা সুরাপান, মাদকসেবন শরীরসচেতন জিমপ্রিয় মহিলাদের ভালো লাগার কথা নয়। শিবের মতো বদমেজাজি, যত্রতত্রগামী ইয়ারদোস্ত সহযোগে ফূর্তি করে বেড়ানো অসংসারী পুরুষের ঘর সামলানো সহজ নয়! মর্তের মহিলাদের তো আর মা দুর্গার মতো দশটি হাত নেই! শুধু ঘর সামলানো সেকেলে মেয়েদের মধ্যে উদাসীন শিব জনপ্রিয় হলেও আজকের স্বয়ংসম্পূর্ণা নারীর কাছে তাই তাঁর টিআরপি খানিক পড়তির দিকেই!

TwitterFacebookWhatsAppEmailShare

ভিডিও

আরও পড়ুন

Decorative Ring
Maa Ashchen