স্বপ্ন, সাহস ও সাফল্যে উজ্জ্বল ভারতের মহিলা ক্রিকেটের নবজাগরণ

দেশ-বিদেশের ক্রিকেটাররা একত্রিত হওয়ায় ভারতের মহিলা ক্রিকেটাররা পেশাদারিত্ব, ফিটনেস ও মানসিক প্রস্তুতির দিক থেকে শিখছেন অনেক কিছু

July 19, 2025 | 3 min read
Published by: Drishti Bhongi

লিখেছেন শুভদীপ মুন্সী

নিউজ ডেস্ক, দৃষ্টিভঙ্গি, ১৭:৪৬: খেলাধুলোর দিক থেকে ভারত একেবারেই একটি ক্রিকেট-কেন্দ্রিক (Cricket) দেশ। কিন্তু ক্রিকেটপ্রেমী দেশ হলেও, সকল লিঙ্গের খেলোয়াড় সমান সুযোগ ও জনপ্রিয়তা পায় না। পুরুষ ক্রিকেটারদের ভিড়ে মহিলা ক্রিকেটারদের (Women’s Cricketer) চেহারাটা দীর্ঘদিন স্পষ্টভাবে চোখে পড়েনি। তবে এখন সময় বদলেছে। নারী ক্রিকেটাররাও এখন জনপ্রিয়তা, স্বীকৃতি ও সম্মান কুড়োচ্ছেন।

দীর্ঘদিনের অবহেলা, উপেক্ষা এবং সীমিত সুযোগের পথ পেরিয়ে আজ ভারতীয় মহিলা ক্রিকেট আন্তর্জাতিক (International Cricket) অঙ্গনে নিজস্ব অবস্থান তৈরি করেছে। একসময় যেখানে পর্যাপ্ত অনুশীলনের মাঠও ছিল না, সেখানে আজ ভারতীয় মহিলা ক্রিকেটাররা বিশ্বকাপের ফাইনালে খেলছেন, কোটি টাকার লিগে অংশ নিচ্ছেন এবং দেশের ক্রীড়াক্ষেত্রে নতুন ইতিহাস গড়ছেন।

বিশ্ব ক্রিকেটের লাইমলাইটে কবে এল ভারতীয় মহিলা দল?

২০১৭ সালের বিশ্বকাপ সেমিফাইনালে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে হরমনপ্রীত কৌরের (Harmanpreet Kaur) ১৭১ রানের দুরন্ত ইনিংস ভারতীয় মহিলা ক্রিকেটের চেহারাই বদলে দিয়েছিল। এরপর ২০২০ সালে ভারত পৌঁছে যায় টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ফাইনালে। সেখান থেকেই শুরু এক নবজাগরণের। আর সেই পথচলার ভিত্তি গড়ে দিয়েছিলেন মিতালি রাজ, ঝুলন গোস্বামী, শান্থা রঙ্গস্বামী, ডায়ানা এডুলজি এবং অঞ্জুম চোপড়ার মতো কিংবদন্তিরা।

বিসিসিআই ও মহিলা ক্রিকেটর ইতিহাস

১৯৭৩ সালে লখনউতে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘উইমেন’স ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্ডিয়া’ (WCAI)। কিন্তু সেই সময় তীব্র আর্থিক সংকটে ভুগছিল সংগঠনটি। ১৯৭৮ সালে ভারত প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলে, তবে সীমিত তহবিল ও অব্যবস্থাপনার কারণে বহু বাধার মুখে পড়তে হয়।

প্রাক্তন জাতীয় ক্রিকেটার কথাকলি ব্যানার্জির কথায়, “সেই সময় কোনও পরিকাঠামোই ছিল না। খেলোয়াড়দের নিজেদের পকেট থেকে টাকা দিয়ে ট্যুরে যেতে হত। ট্রেনে অনারক্ষিত কামরা, মেঝেতে ঘুম, ক্লাসরুমে থাকা—সবই করতাম শুধুমাত্র ক্রিকেটের ভালবাসায়।”

২০০৬ সাল থেকে ধীরে ধীরে মহিলা ক্রিকেটকে গুরুত্ব দিতে শুরু করে বিসিসিআই (BCCI)। মহিলা ক্রিকেটকে নিজেদের ছাতার তলায় নিয়ে আসে বোর্ড। এরপর থেকেই পরিস্থিতির উন্নতি হতে থাকে।

২০২৩ সালে বিসিসিআই ঘোষণা করে, পুরুষদের মতোই আন্তর্জাতিক ম্যাচে মহিলা ক্রিকেটাররাও সমান ম্যাচ ফি পাবেন। এর ফলে ভারত অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড ও নিউজিল্যান্ডের পরে লিঙ্গভিত্তিক বেতন বৈষম্য দূর করা চতুর্থ দেশ হয়ে ওঠে।

এছাড়াও হরমনপ্রীত কৌরের অনুরোধে প্রথমবারের জন্য মহিলা দলে নিযুক্ত হন স্পোর্টস সাইকোলজিস্ট। ধাপে ধাপে দলের সঙ্গে যুক্ত হন কোচ, ফিজিও, অ্যানালিস্ট ইত্যাদি।

ছোট শহরের স্বপ্ন ও সংগ্রাম

ছোট শহর থেকেও অনেক তরুণী জাতীয় দলের জার্সি গায়ে চাপানোর স্বপ্ন দেখেন। তবে সবার সেই স্বপ্ন বাস্তব হয় না। আমরাবতীর ভারতী ফুলমালির গল্প অনুপ্রেরণার। ছোটবেলায় ছেলেদের সঙ্গে গলিতে ক্রিকেট খেলে শুরু হয় তাঁর যাত্রা। তখন কোনও ক্লাবই মেয়েদের নিত না। পরে এক বিজ্ঞাপন দেখে ক্রিকেট ক্যাম্পে ভর্তি হন এবং সেখান থেকেই শুরু হয় পেশাদার ক্রিকেটজীবন। ২০১৯ সালে জাতীয় দলে সুযোগ পেলেও মাত্র দু’টি ম্যাচ খেলার পর বাদ পড়েন। হতাশা কাটিয়ে ২০২২ সালে ঘোষিত মহিলা প্রিমিয়ার লিগ (WPL) তাঁর জীবনে নতুন আশার আলো নিয়ে আসে। ২০২৪ সালে গুজরাট জায়ান্টসের হয়ে খেলেন তিনি।

ফুলমালির মতোই বিদর্ভের বৈষ্ণবী খান্ডকারের গল্পও একইরকম। সীমিত সুযোগ, অপরিচিত পরিকাঠামো, তবু আত্মবিশ্বাস, কঠোর পরিশ্রম ও পরিবারের সহযোগিতায় জাতীয় স্তরে পৌঁছন তিনি।

WPL: এক নতুন দিগন্ত

পুরুষদের আইপিএল শুরু হয় ২০০৮ সালে। বহু প্রতিভার জন্ম দিলেও মহিলাদের জন্য এমন কোনও লিগ ছিল না। সেই শূন্যস্থান পূরণ করল ২০২৩ সালের উইমেন’স প্রিমিয়ার লিগ (WPL)। প্রথম বছরেই প্রায় ৩৭৭ কোটি টাকার আয় করে বিসিসিআই। সম্প্রচারের চুক্তি হয় ৯৫১ কোটি টাকায়।

দ্বিতীয় আসরে অংশ নেয় মুম্বই ইন্ডিয়ান্স, রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স ব্যাঙ্গালোর, দিল্লি ক্যাপিটালস, গুজরাট জায়ান্টস এবং ইউপি ওয়ারিয়র্সের মতো দল।

দেশ-বিদেশের ক্রিকেটাররা একত্রিত হওয়ায় ভারতের মহিলা ক্রিকেটাররা পেশাদারিত্ব, ফিটনেস ও মানসিক প্রস্তুতির দিক থেকে শিখছেন অনেক কিছু। ফুলমালি জানিয়েছেন, “স্কটল্যান্ডের ক্যাথারিন ব্রাইসের সঙ্গে আলাপ হওয়ার পর আমার দৃষ্টিভঙ্গিই পাল্টে গেছে।”

চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি নারী ক্রিকেট

অবশ্য এত অগ্রগতির মাঝেও আজও নানা সমস্যার মুখে পড়েন নারী ক্রিকেটাররা। তার মধ্যে অন্যতম যৌন হেনস্তা ও নিরাপত্তাহীনতা। ২০২৩ সালের শেষ দিকে ‘দ্য কারাভান’ পত্রিকায় প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে মহিলা ক্রীড়াঙ্গনের ভয়াবহ চিত্র উঠে আসে। এরপর বিসিসিআই গঠন করে অভ্যন্তরীণ অভিযোগ কমিটি (ICC)। নারীদের কর্মক্ষেত্রে সুরক্ষা দিতে জারি হয় কঠোর নীতিমালা।

আজকের দিনে ক্লাবে অনুশীলনে এক-দু’জন নয়, শতাধিক মেয়ে আসে। মিতালি রাজ, স্মৃতি মান্ধানা, জেমিমা রডরিগসদের মতো তারকাদের দেখে তাঁদের স্বপ্ন নতুন রূপ নিচ্ছে।

TwitterFacebookWhatsAppEmailShare

ভিডিও

আরও পড়ুন

Decorative Ring
Maa Ashchen