কালী সিংহী ও নীল বিদ্রোহ
শোনা যায়, হরিশ মুখোপাধ্যায়ের মৃত্যুর পর তাঁর পরিবারকে অভাব থেকে বাঁচাতে বিদ্যাসাগর কালী সিংহের কাছে নিয়ে যান। কালী সিংহী পাঁচ হাজার টাকার বিনিময়ে হরিশ মুখোপাধ্যায়ের প্রেস কিনে নেন।

জোড়াসাঁকোর দুটো বাড়ির প্রতি উনিশ শতকের বাংলা চিরকৃতজ্ঞ; কেবল উনিশ শতকের বললে অন্যায় হয়। কারণ আজকের বাংলার ভীত তৈরি হয়েছিল সেই সময়তেই… দু’বাড়ির মধ্যে একটি পীরালি ব্রাহ্মণদের ঠাকুর বাড়ি আর আরেকটি সিংহদের বাড়ি।
জোড়াসাঁকোর বারাণসী ঘোষ স্ট্রিটের বিখ্যাত সিংহ পরিবারেই ১৮৪০ সালের আজকের দিনে জন্ম নিয়েছিলেন কালীপ্রসন্ন সিংহ। তাঁর হুতোম পেঁচার নকশা তাঁকে অমর করে গিয়েছে। বহুমুখী প্রতিভার আড়ালে ঢাকা পড়ে গিয়েছে কালী সিংহীর স্বদেশ-স্বজাতি প্রেম।আমৃত্যু তাঁর পরোপকারী সত্ত্বা অক্ষত ছিল।
মাত্র ৩০ বছর পাঁচ মাসের জীবনে বরাবর সমাজপতিদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছেন কালীপ্রসন্ন। মেঘনাথ বদ লেখায় মাইকেলের উপর ক্ষিপ্ত সকলে, আর অন্যদিকে মাইকেলকে সন্মাননা জানাচ্ছেন, টিক্কি কেটে আনছেন, বিধবা বিবাহ থেকে কৌলীন্য প্রথা বিরোধী আন্দোলন সবেতেই তিনি, তবে চর্চার আড়ালে থেকে যায় নীল বিদ্রোহ। দেশে ইংরেজ বিরোধী আন্দোলনের মধ্যে অন্যতম ছিল নীল বিদ্রোহ। নীল চাষের বিরুদ্ধে লড়ে ছিলেন কৃষকেরা, আর জনমত গড়ার লড়াই লড়ে ছিলেন তিনজন। দুজন দেশীয়, একজন সাহেব। আর তাঁদের সঙ্গে ছিলেন কালী প্রসন্ন সিংহ।
আর্মহাস্ট স্ট্রিট চত্বরে আজ দাঁড়িয়ে রয়েছে কোরি চার্চ। সুদীর্ঘকাল এই চার্চে ছিলেন লং সাহেব, কাছেই সেন্ট পলস কলেজের সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন জেমস লং। এই চার্চের সঙ্গে থাকাকালীন লং সাহেবের বিরুদ্ধে মামলা উঠেছিল কোর্টে, তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল দীনবন্ধুর ‘নীলদর্পণ’ নাটকটি ইংরেজিতে অনুবাদ করার। মামলা হয়েছে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি স্যর মার্ডান্ট ওয়েলসের এজলাসে। নীলদর্পনের ইংরেজি হওয়ায়, ইংরেজদের দাঁত নখ প্রকাশ্যে এসে গিয়েছিল। ফলে আক্রমণ অভিপ্রেতই ছিল।
ইংরেজি অনুবাদের প্রকাশক ছিলেন মিস্টার ম্যানুয়েল। তাকেই খাড়া করা হয় প্রথমে কাঠগড়ায়। তারপর অনুবাদের সমস্ত দায়ভার গ্রহণ করেন জেমস লং। সাজা এক করাবাস ও ১০০০ টাকা জরিমানা করা হয়। সেই জরিমানার টাকা দিয়েছিলেন কালীপ্রসন্ন সিংহ। ত্রাতা হয়ে ছিলেন সিংহী মশাই। ১৮৬১ সালের জুলাইতে লং-এর এক মাস কারাবাস হয়েছিল। ১৮৭২সালে জেমস লং চিরতরে কলকাতা ত্যাগ করেন এবং জীবনের বাকি সময় তিনি লন্ডনেই অতিবাহিত করেছিলেন।
কিন্তু বিচারপতিকে রেহাই দেননি কালী সিংহী; বাঙালি বিদ্বেষী বিচারপতিকে শিক্ষা দিতে রাজা রাধাকান্ত দেবের নাটমন্দিরে সভা বসল। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, যতীন্দ্রমোহন ঠাকুর, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরেরা এলেন। সভা থেকেই ওয়েলসের বিরুদ্ধে সরব হলেন কালীপ্রসন্ন। ওই বিচারপতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থার দাবিতে প্রায় কুড়ি হাজার লোকের সই সংবলিত আবেদনপত্র পাঠানো হল ইংল্যান্ডে সেক্রেটারি অব স্টেট চার্লস উডের কাছে। ওয়েলস সম্পর্কে গভর্নর জেনারেলকে সতর্কবার্তা পাঠালেন প্রধানমন্ত্রী উড। এরপর ‘নীলদর্পণ’ নাটকের (বাংলা ভাষায়) দ্বিতীয় সংস্করণটি প্রকাশ করে বিনামূল্যে তা জনসাধারণের মধ্যে বিতরণ করান কালীপ্রসন্ন।
নীল বিদ্রোহের সময় দেশীয় পত্রিকার মধ্যে হিন্দু পেট্রিয়ট সরব ছিল।১৮৫৩ সালে চার্টার আইনের নবীকরণের সময় ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশানের প্রতিবাদ পত্রের রচয়িতা ছিলেন হরিশ মুখার্জী। সে বছরই শুরু হল হিন্দু প্রেট্রিয়ট পত্রিকা। অল্প কিছু দিনের মধ্যেই সেই পত্রিকা চালানো ভার আসে হরিশ মুখোপাধ্যায়ের উপর। ১৮৫৪ সালে ভবানীপুরে প্রেস খুলে নিজেই সম্পাদনা করে পত্রিকা চালাতে থাকেন। এটাই হয়ে ওঠে ব্রিটিশ বিরোধী লড়াইয়ের হাতিয়ার। হিন্দু পেট্রিয়টকে ঘিরে ব্রিটিশ বিরোধী জনমত তৈরি হতে শুরু হয়। তখন আরও একটি দেশীয় পত্রিকা চলত কাশীপ্রসাদ ঘোষের হিন্দু ইন্টেলিজেন্সি। হিন্দু পেট্রিয়টের সম্পাদক হরিশ্চন্দ্র মুখোপাধ্যায় তাঁর পত্রিকায় নীলকর সাহেব আর্চিবাল্ড হিলসের বিরুদ্ধে কিছু অভিযোগ আনলেন। সাহেবও মানহানির মামলা ঠুকে দিলেন। হরিশ বাবু মহাবিদ্রোহ ও নীল বিদ্রোহের সময়, তাঁর পত্রিকা নিয়ে লড়াই জারি রাখেন। অত্যাধিক পরিশ্রম তাঁর স্বাস্থ্য ভঙ্গের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ৩৭ বছরেই চলে যান এক নির্ভীক কলমের মালিক। ওদিকে ততদিনে মামলার রায় প্রকাশ হয়েছে, মামলার যাবতীয় ব্যয়ভার হরিশ্চন্দ্রকেই দিতে হবে। হরিশ্চন্দ্রের মৃত্যু হয়েছে। তাঁর পরিবারের লোকজন দেখলেন, বাড়ি বিক্রি ছাড়া উপায় নেই! পরিবারেরই পথে বসার উপক্রম হল। এগিয়ে এলেন গিরিশচন্দ্র ঘোষ, কালীপ্রসন্ন-সহ আরও কয়েক জন। তৈরি হল ‘গৃহরক্ষা তহবিল’। হরিশ্চন্দ্রের বাড়ি রক্ষা পেল। হরিশ্চন্দ্রের অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ এবং তাঁর স্মৃতি রক্ষার্থে প্রচার শুরু করেন কালী প্রসন্ন। স্মৃতিমন্দির তৈরির জন্য সুকিয়া বাগান স্ট্রিটে দু’বিঘা জমি দান করার প্রতিশ্রুতি দিলেও মন্দির আর হয়নি।
শোনা যায়, হরিশ মুখোপাধ্যায়ের মৃত্যুর পর তাঁর পরিবারকে অভাব থেকে বাঁচাতে বিদ্যাসাগর কালী সিংহের কাছে নিয়ে যান। কালী সিংহী পাঁচ হাজার টাকার বিনিময়ে হরিশ মুখোপাধ্যায়ের প্রেস কিনে নেন।