কার্তিক ঠাকুর: বাঙালির এক দেবতা, একাধিক তাঁর রূপ
পৌলমী বোস

নিউজ ডেস্ক, দৃষ্টিভঙ্গি, ১০:৪৫: দুর্গা পুজো এবং কালী পুজোর শেষে বাঙালি আবার এক নতুন উৎসবে জেগে ওঠে— কার্তিক পুজো। এখানে কার্তিকেয় আর দক্ষিণ ভারতের মুরগান বা দেবতাদের সেনাপতি নয়, বাঙালির কাছে তিনি হলেন কার্তিক ঠাকুর— কোমল, স্নেহ মিশে থাকা এক দেবতা।
এই পুজো রাজ্য জুড়ে বিভিন্নভাবে পালিত হয়, যা একে অপরের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। বাঁশবেড়িয়া, কাটোয়া এবং হুগলি, বর্ধমান, নদিয়া অঞ্চলের ছোট ছোট শহরগুলোতে এই পুজো যেন এক নতুন রূপ ধারণ করে। বাঁশবেড়িয়া, যেখানে পুজোর ঐতিহ্য অনেক পুরনো, আজও এক অনন্য রূপে জ্বলজ্বলে। এখানে কার্তিক পুজো যেন একটি প্রাণবন্ত উৎসবের রূপে পরিণত হয়, যেখানে প্রতিটি গলি, পাড়া, মহল্লা এক নতুন রূপে মূর্ত হয়ে ওঠে। পুজোর রাতেই যেন গোটা পরিবেশ এক আলোকিত উৎসবে পরিণত হয়, সড়কগুলো আলোকিত হয়ে ওঠে, বাঁশের মণ্ডপে তৈরি হয় বিশাল প্রবেশদ্বার, আর সেখান থেকে শোনা যায় প্রাচীন বাদ্যযন্ত্রের সুর। বাঁশবেড়িয়ার পুজো এক দীর্ঘ ইতিহাসের অংশ, যেখানে কুটির শিল্পী পরিবার, ব্যবসায়ী এবং যুবক দলগুলি একত্রিত হয়ে এই ঐতিহ্য বহন করে আসছে। তাদের সবার মধ্যে কার্তিক ঠাকুরের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা, ভালোবাসা এবং উৎসবের অনুভূতি বিদ্যমান।
এখানে, কার্তিকের মূর্তি কখনো সিংহের সামনে দাঁড়ানো, তীর-ধনুক হাতে, আবার কখনো আধুনিক আলোর আড়ালে রূপান্তরিত হয়, যা এই শহরের পুজোকে এক উন্মুক্ত মঞ্চে রূপান্তরিত করে। বিশেষ করে বাঁশবেড়িয়ার পুজোয় আপনি দেখতে পাবেন প্রতিটি পাড়া আলাদা আলাদা ভাবে কার্তিক ঠাকুরের দর্শন এবং উপস্থাপনা নিয়ে আসছে। প্রতিটি পাড়ার মানুষ তাদের নিজস্ব ভিন্নতা, ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতিকে তুলে ধরতে চায়। কাটোয়া অঞ্চলের পুজো তার নাটকীয় রূপের জন্য বিখ্যাত। এখানে, কার্তিক ঠাকুরের লড়াইয়ের দৃশ্য এক অভিনব রূপে তুলে ধরা হয়। এখানে বাস্তব, কোনো যুদ্ধ নয়, বরং এটি একটি সাজানো নাটকীয় পরিবেশন, যা কার্তিকের সাহসিকতা এবং যুদ্ধের প্রতীকী রূপ। প্রতিটি পাড়া একসঙ্গে মেতে ওঠে, যেখানে তারা সমন্বিত মিছিল, নাটকীয় আলো, সঙ্গীত এবং গর্জনকারী সুরে উদযাপন করে। কাটোয়া, যেখানে মূর্তিগুলি আকাশচুম্বী এবং ঝলমলে পটভূমির সঙ্গে সাজানো হয়, সেখানে প্রতিটি পাড়া একে অপরকে ছাড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে, যেন তারা ধর্মীয় আবেগকে এক নতুন রূপে মঞ্চে তুলে ধরছে। এখানে, কার্তিক পুজো শুধুমাত্র এক আয়োজন নয়, বরং এক নাটকীয় যাত্রা, যা পুরো শহরতলিকে এক মঞ্চে পরিণত করে। কাটোয়া একটি ‘মঞ্চ’ যেখানে কার্তিক ঠাকুরের শ্রদ্ধা নিবেদনের মধ্যে অনেক নাটকীয়তা এবং উন্মাদনা থাকে।
কোলকাতা শহরের মধ্যে কিছু স্থান ছাড়া, এই পুজো একেবারে গ্রামের ছোট ছোট শহরগুলিতে সজীব এবং চিত্তাকর্ষকভাবে পালিত হয়। যেখানে এর প্রকাশ একটু বেশি অন্তরঙ্গ, সাধারণ, কিন্তু গভীর। চুঁচুড়াতে পুরনো ব্যবসায়ী পরিবারগুলি চমৎকার মূর্তি শিল্পকে সযত্নে ধারণ করে, নবদ্বীপ এবং কৃষ্ণনগরে গৃহস্থালীর পূজা এবং বৈষ্ণব প্রভাবিত আচারপ্রণালীতে এই পুজো উঠে আসে। তাহেরপুর এবং গ্রামীণ বর্ধমানে পুজো জনপদের লোকনাট্য, ছোট নাটক, এবং স্থানীয় কাহিনী-আখ্যানের সঙ্গে মিশে যায়।
এখানে, কার্তিক ঠাকুরের পুজো শুধুমাত্র বড় আয়োজন নয়, বরং এক গভীর স্মৃতিময় ভাবনার অংশ। গ্রামে, মূর্তি কখনোই অহংকারের নয়, বরং এক স্নেহের প্রতীক। এটি মানুষের মধ্যে বিশ্বাস এবং ধর্মীয় আবেগের এক অভ্যন্তরীণ সংলাপ। কার্তিক ঠাকুর বাঙালির মধ্যে এক চিরন্তন চরিত্র। বাঙালির গল্প বলার ঐতিহ্য তাকে নানা রূপে এবং আবেগে রূপান্তরিত করে। একে শুধুমাত্র একটি মূর্তির মধ্যে সীমাবদ্ধ করা যায় না; বরং সে হয়ে ওঠে প্রতিটি অঞ্চলের নিজস্ব আবেগের প্রতিফলন। হুগলি এবং পূর্ব বর্ধমানে, শিশুরা বেড়ে ওঠে ল্যাংটো কার্তিক সম্পর্কে গল্প শুনে— একটি নগ্ন শিশু-দেবতা, যে শৈশবের প্রতীক। গ্রামীণ মৃৎশিল্পীরা এখনও এই রূপটি মেলা এবং বাড়ির জন্য তৈরি করে। কাটোয়া–কালনা অঞ্চলে, পরিবারগুলো মৃদু হাস্যকর ধেড়ে কার্তিক কে আহ্বান করে, যিনি কখনো সময়মতো পৌঁছন না— একটি রূপ যা গৃহস্থালি কৌতুকে এবং শীতকালের রীতিতে জীবিত থাকে।
নদীয়া জেলার কৃষ্ণনগর এবং নবদ্বীপে, লোকনাট্য আখ্যানগুলোতে দর্পোক কার্তিক — এক লাজুক, হাস্যকর দেবতা — জনপ্রিয় চরিত্র। বানশবেরিয়া এবং কৃষ্ণনগরে কুমার কার্তিক পছন্দ করা হয়, যার রূপ যুবক এবং সুন্দর, আবার কাটোয়া এবং বানশবেরিয়া অঞ্চলে সেনাপতি কার্তিক কে ও অত্যন্ত সমাদৃত করা হয়, যিনি তীর এবং ময়ূরের সঙ্গে দেবতার সৈনিক।
এই রূপগুলো দেখায়, কার্তিক ঠাকুর কখনোই একরূপ নয়। তিনি একে অপরের মধ্যে নিজেকে আকারে, স্থানীয় আবেগে, স্মৃতিতে, এবং সর্বোপরি, মানুষের মধ্যে পুনঃআবিষ্কৃত হন। বাঙালিতে কার্তিক ঠাকুর বেঁচে থাকে শুধুমাত্র বড় আচার-অনুষ্ঠানে নয়, বরং তিনি স্থানীয় আবেগ এবং প্রতি বছর নতুন করে গড়ে তোলার মধ্য দিয়ে। বানশবেরিয়া তাকে আর্টে পরিণত করে। কাটোয়া তাকে গতি দেয়। গ্রামীণ বাঙালি তাকে কোমলতা এবং স্মৃতিতে জীবন্ত রাখে। কার্তিক শুধু একটি উৎসব নয়। তিনি একটি জীবন্ত কাহিনী— প্রতিটি স্থানেই নতুনভাবে বলা, নতুনভাবে কল্পনা করা এবং প্রতিবার পুনর্জন্ম লাভ করা।