কাতারে জিতলেন মেসি, কলকাতায় অকাল দীপাবলি

মার্টিনেজের বল ঠেকানো দেখেছে, আর একটু একটু করে বাঙালি মশালে বারুদ ভরেছে। জিততেই সব আবেগ, কান্না, হাসি বেরিয়ে এসেছে। কাল কলকাতা ভেসেছে, অকাল দীপাবলি দেখেছে। শব্দে গমগম করেছে গোটা বাংলা।

December 19, 2022 | 2 min read
Published by: Drishti Bhongi

সৌভিক রায়

বিধবাবিবাহ প্রচলনের পর বিদ্যাসাগরের নামে ছড়াগান বাঁধা হয়েছিল, বেঁচে থাক বিদ্যাসাগর চিরজীবি হয়ে। সে’কথার প্রতিধ্বনি করে বলতে হয়, বেঁচে থাক বাঙালির ফুটবল আবেগ চিরজীবি হয়ে। অন্তত কালকের পর এটা বলতেই হচ্ছে। বুয়েন্স আয়ার্সের মতোই কাল বেলেঘাটা থেকে বালি, বেহালা থেকে বীরনগর স্বপ্ন দেখেছিল লিওর হাতে কাপ উঠুক। ক্রিসমাস ক্যারোলে মিশে যাক, “লিও ওহ! লিও মাই লিও…”।

টাইব্রেকারে শট নিতে গেলেন মেসি, কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম নেই। মুখে একটুও চাপের চিহ্ন নেই। শুধু একটু ছোঁয়া, বল জড়িয়ে গেল। সাথে সাথে সশব্দে জানান দিল কলকাতা, লিও আরেক ধাপ এগোলো কাপের দিকে, আমাদের লিও। ম্যাচের জোড়া গোলেও একইভাবে জানান দিয়েছে তিলোত্তমা। নুন আনতে পান্তা ফুরিয়ে যাওয়া লোকটার হাতে ঠান্ডা হয়ে যাওয়া আলু সেদ্ধ আর গোল্লা পাকানো ভাত, হাঁ করে সে ফোনের দিকে তাকিয়ে। আজ ভাত অপেক্ষা করুক। পরদিন ডায়লেসিস করাতে যাওয়া মেয়েটা রাত জেগে, কেমো নিয়ে আসা খিটখিটে পক্ককেশী, যে ঠাকুর ডাকে ‘তুলে নাও!’ সে লিওর জন্য সত্যনারায়ণকে ডাকছে…এটাই তো লিও। সব্বাই মেসির সঙ্গে বাঁচলাম কালকের দিনটা। এমন স্বপ্নপূরণের রাত জীবনে খুব কম আসে, দেড় দশক সে স্বপ্ন বুকে করে বয়েছেন মেসি, তার ভার ও ভর দুটোই বহন করেছে বঙ্গ সন্তানদের হৃদয় ও মস্তিষ্ক।

মার্টিনেজের বল ঠেকানো দেখেছে, আর একটু একটু করে বাঙালি মশালে বারুদ ভরেছে। জিততেই সব আবেগ, কান্না, হাসি বেরিয়ে এসেছে। কাল কলকাতা ভেসেছে, অকাল দীপাবলি দেখেছে। শব্দে গমগম করেছে গোটা বাংলা। কাতার-কলকাতা-আর্জেন্টিনা, কোথাও গিয়ে এক হয়ে গিয়েছে। মধ্যরাতে আলোর রোশনাই, আতসবাজির ঝলকানি, এমন মধ্যেরাত কটা পেয়েছে বাঙালি! লিওর ট্রফি চুম্বন এখন বাঙালির সবচেয়ে প্রিয় দৃশ্য। সোমবারের অফিস, ডেডলাইন, পরীক্ষা, ইএমআই, প্রেসক্রিপশন, প্রেসার, কোলেস্ট্রেরল, ইউরিক অ্যাসিড; সব ভুলে একরাত ফুটবলে বাঁচল বাংলা। ফুটবলে ভোর হল।

বাঙালির কাছে ফুটবল কেবল খেলা নয়, খালি পায়ে স্বাধীনতার লড়াই। সেই উনিশ শতকে টাউন ক্লাব, কুমারটুলি, শোভাবাজার ক্লাব থেকে বাঙালির ফুটবল যাত্রার শুরু, তারপর নগেন্দ্রপ্রসাদ, শিবদাস, বাঘা সোম, গোষ্ঠ পাল হয়ে পিকে, চুনী, বিদেশ, মানস, কৃশানু। আজ আর ময়দানে খেলা হলে হাফবেলার অফিস ছুটি নেন না মুখার্জী, ব্যানার্জী, ঘোষবাবুরা, আকাশে স্কোর লেখা ঘুড়ি ওড়ে না, ধারাবিবরণীতে বাঙালির পদবি শোনা যায়, কদাচ! ফুটবল তবু বেঁচে আছে, মানিকবাবুর ছবির সংলাপে ফুটবল, মহানায়কের আউটে কিক করা ডায়লগে ফুটবল, আজও মেসি এমবাপেদের মতো দেখতে মিষ্টি তৈরি হয়, রঙিন সন্দেশ, রসগোল্লার রঙে প্রিয় দলের প্রতি সমর্থন লুকিয়ে থাকে। তেরঙা ছাড়া অন্য পতাকার বিক্রি বাড়ে, জার্সি সেলাইয়ের জন্যে রাত জাগা হয়। পাড়া সেজে ওঠে ইউরোপ, ল্যাটিন আমেরিকার দেশের কলেবরে। বইপাড়ার প্রকাশকরা ছাড় দেন, ঘুগনিওয়ালা বা চা দোকানি নিজের দোকানের খাবার ফ্রি করে দেন, এটাই তো বাঙালি। যাদের সেরিব্রো স্পাইনাল ফ্লুইডে মিশে থাকে আবেগ, রবীন্দ্রনাথ, সুভাষ, সত্যজিৎ আর ফুটবল। এই বাঙালি চিরজীবি হোক।

TwitterFacebookWhatsAppEmailShare

ভিডিও

আরও পড়ুন

Decorative Ring
Maa Ashchen