বাঙালি খেদাও ২.০: বাংলার ভোটারদের বার্তা এবং NRC-র প্রথম ধাপ
ওড়িশা, রাজস্থান, দিল্লি, মুম্বই, গুজরাতের মতো রাজ্যে বাংলা বললেই নেমে আসছে প্রশাসনিক খাড়া।
সৌভিক রাজ

নিউজ ডেস্ক, দৃষ্টিভঙ্গি, ১০:০০: ওড়িশা, রাজস্থান, দিল্লি, মুম্বই, গুজরাতের মতো রাজ্যে বাংলা বললেই নেমে আসছে প্রশাসনিক খাড়া। কোথাও বন্দি করা হচ্ছে, কোথাও বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে, জুটছে মার কোথাও আবার জল, ইলেকট্রিসিটি বন্ধ করা হচ্ছে। বাংলার অভিবাসী শ্রমিকদের মানুষ বলে গণ্য করা হচ্ছে না। বৈধ আধার ও ভোটার কার্ড থাকার পরেও এমন আচরণ করা হচ্ছে, যেন তাঁরা ভারতের নাগরিকই নন।
এহেন বাঙালি খেদাও অভিযানের আদত উদ্দেশ কি অনুপ্রবেশ রোখা? পড়শী দেশের ভাষা বাংলা। গত পঞ্চাশ-ষাট বছরে সে দেশ থেকেই কাতারে কাতারে শরণার্থীরা ভিড় জমিয়েছেন ভারতে, ফলে বাংলাভাষীদের সহজেই উদ্বাস্তু বলে দাগিয়ে দেওয়া যায়। কিন্তু দেশে যদি আজও অনুপ্রবেশ ঘটতে থাকে তাহলে তার দায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের। দায় এড়িয়ে যেতে পারে কেন্দ্র সরকার? উত্তর একেবারেই নয়।
রাজ্যে রাজ্যে বাংলাভাষী শ্রমিকদের আটক করে, ওপার বাংলায় পাঠালেই কি অনুপ্রবেশ বন্ধ হবে? বাঙালি খেদাও ২.০ শুরু হয়েছে কেবল বিজেপি শাসিত রাজ্যে অর্থাৎ মোদী-শাহদের লব্জে যেখানে যেখানে ডবল ইঞ্জিন সরকার চলছে সেখানে সেখানেই চলছে বাঙালি খেদাওয়ের অভিযান। বিগত চার-পাঁচ মাসে দেশের ডবল ইঞ্জিন রাজ্যগুলোয় ব্যাপকভাবে শুরু হওয়া বাঙালি খেদাও অভিযানের মূলে রয়েছে বাঙালি বিদ্বেষ এবং ভোটের অঙ্ক।
অনুপ্রবেশ রোখা উদ্দেশ হলে কেরল, কর্নাটক থেকে কেন বাঙালি অভিবাসী শ্রমিকদের তাড়ানো হচ্ছে না? কেরলে বিপুল সংখ্যায় বাংলার শ্রমিকেরা যান। সেখান থেকে কোনও শ্রমিক অত্যাচারের খবর শোনা যাচ্ছে না। কেরলের বাম ও কর্ণাটকের কংগ্রেস সরকার কি বাংলাভাষীদের প্রতি একটু বেশিই সদয়? না! উত্তর একটাই। অনুপ্রবেশকে ঢাল করে বাঙালিকে পরিকল্পিতভাবে হেনস্থা করা হচ্ছে। আর্থ-সামাজিকভাবে একেবারে নিচুতলার মানুষদের হেনস্থা করে গোটা বাঙালি সমাজকে বার্তা দেওয়া হচ্ছে। বছর ঘুরলেই বাংলায় ভোট। নীলবাড়ি পাঁচ বছরের জন্য কার দখলে যাবে, সে লড়াই শুরু হয়ে গিয়েছে তলে তলে। তার প্রেক্ষিতেই বাঙালিদের বার্তা দেওয়া হচ্ছে। মূলত এ বার্তা বঙ্গের ভোটারদের জন্য। প্রেরক দেশের শাসক শক্তি। বাঙালি খেদাও দেখে নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছেন বঙ্গ বিজেপির তাবড় নেতারা। যা ইঙ্গিত করে কেন্দ্রের শাসিক শক্তির হয়তো কোনও নির্দেশ রয়েছে, ‘চুপ্ রাহো’। এটাই রণকৌশল।
বাংলা এমন এক রাজ্য, যেখান থেকে বহু মানুষ ভিন রাজ্যে যান কাজের আশায়। উল্টোটাও হয়, ভিন রাজ্য থেকে বাংলাতেও আসেন অনেকে। ২০২০ সাল, আমফানে বিধ্বস্ত বাংলায় ট্রেন বোঝাই করে অভিবাসী শ্রমিকদের ফেরত পাঠানো হয়েছিল। দোহাই ছিল করোনা। সেটিও ছিল বিধানসভা নির্বাচনের আগের বছর। এবারও বিধনসভা ভোটের আগের বছর বাংলা থেকে ভাতের আশায় রাজ্যে রাজ্যে কাজ করতে যাওয়া মানুষগুলো হেনস্থার শিকার হচ্ছে। কাজ করতে দেওয়া হচ্ছে না। সাফ বার্তা, ফিরে যাও নিজের রাজ্যে নয়তো অন্যত্র পাঠানো হবে পর দেশীতকমা দিয়ে।
এটি হল কেন্দ্রীয় শাসক দলের কৌশল। এক ধরনের মনোস্তাত্মিক লড়াই। বাঙালিদের হেনস্থাকারীরা মনে করছেন, এমন চলতে থাকলে বাংলা বলা ছেড়ে দেবেন পশ্চিমবঙ্গের অভিবাসী শ্রমিকেরা। কিছুটা অভিঘাত পড়বে পশ্চিমবাংলায়ও।
অসমের মুখ্যমন্ত্রী অর্থাৎ পূর্ব ভারতে বিজেপির পোস্টার বয় হিমন্ত বিশ্বশর্মা বলেই দিয়েছেন, মাতৃভাষা বাংলা লিখলেই বিদেশি। সাফ কথায়, বাংলা বললে দেশ ছাড়া হতে হবে। নয়তো ঠাঁই হবে, ডিটেনশন ক্যাম্প। একে হুমকি বলা যায়। এর নেপথ্যে রয়েছে কেন্দ্র সরকারের নানা পদক্ষেপ। বিগত চোদ্দ-পনেরো মাস যাবৎ কেন্দ্রের একের পর এক পদক্ষেপ লক্ষ্য করলে বোঝা যেতে পারে এই বাঙালি খেদাও ২.০ অভিযানের কারণ। সিএএ লাগু করা, এক দেশ এক ভোট চালু করার উদ্যোগ, আসন পুনর্বিন্যাসের উদ্যোগ, ওয়াকফ আইন, সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষ শব্দ তুলে দেওয়ার জিগির তোলা, জনগণনার বিজ্ঞপ্তি জারি এবং বিহারের বিধানসভা নির্বাচনের প্রাক্কালে ভোটার তালিকার নিবিড় পর্যবেক্ষণ… ধাপে ধাপে দেশ এনআরসি চালুর দিকেই এগোচ্ছে। মূল টার্গেট মুসলমান আরও নির্দিষ্ট করে বললে বাংলাভাষী মুসলমান।
বিজেপির বঙ্গ বিজয়ের অন্তরায় মুসলমানদের ভোট, এমন একটি ভাবনা তৈরি হয়েছে। অন্তত গেরুয়া দলের নেতাদের বক্তব্যে তাই মনে হয়। বিরোধী দলনেতার একের পর এক ভাষণের সরলীকরণ করলে দাঁড়ায়, বাংলার ভোটদাতারা ধর্মের ভিত্তিতে বিভক্ত। একটি ধর্মের মানুষ একটি নির্দিষ্ট দলকে ভোট দেয়। যদিও তথ্য অন্য কথা বলে। বাঙালি খেদাও ২.০ -এর ফসল ছাব্বিশের ভোটে ঘরে তুলতে চাইছে বিজেপি কিন্তু এটিও বঞ্চনা ইস্যুর মতো তৃণমূলের অস্ত্র হয়ে উঠতে পারে ভোটের ময়দানে। একশো দিনের কাজ, আবাসের টাকা আটকানোর মতো এবারেও গ্রামীণ বাংলায় সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়েছে বাঙালি খেদাও ২.০, কারণ গ্রাম থেকেই বেশি শ্রমিক যান দেশের বিভিন্ন রাজ্য। গ্রামের মন জিততে না-পারলে বিজেপির নীলবাড়ি দখলের স্বপ্ন অধরা থেকে যাবে। ভোটে খড়কুটোর মতো উড়ে যেতে পারে পদ্ম বাগান।