নীল বা কৃষ্ণবর্ণ নয়, শ্বেতশুভ্রা কালী পূজিতা হন রাজবলহাট, শোভাবাজার ও ব্যান্ডেলে

কালীমূর্তি বলতেই আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে কৃষ্ণবর্ণা বা গাঢ় নীল বর্ণের মূর্তি।

February 25, 2023 | 3 min read
Published by: Drishti Bhongi
ছবি সৌজন্যে: kulayefera

নিউজ ডেস্ক, দৃষ্টিভঙ্গি: হুগলির রাজবলহাটেই রয়েছে রাজবল্লভী কালী মন্দির। রাজবল্লভী দেবীর নামানুসারে এই জায়গাটি রাজবলহাট নামে পরিচিত। রাজবলহাট সংলগ্ন এলাকায় এই দেবী রাজবল্লভী দেবী রূপে পূজিতা হন। ষোড়শ শতকে ভুরশুটের রাজা রুদ্রনারায়ণ রায় এই মন্দির নির্মাণ করেছিলেন। দামোদর আর রণ নদী বেষ্টিত গ্রাম রাজবলহাট; ত্রয়োদশ শতকে সদানন্দ রায়ের উদ্যাগেই নদী তীরবর্তী জঙ্গলাকীর্ণ এই এলাকায় বাণিজ্যের উত্থান ঘটান এবং গড়ে তোলেন এক বিশাল হাট। তিনিই রাজবল্লভীর স্বপ্নাদেশ পেয়ে এই মন্দির নির্মাণ করেন। মনে করা হয়, এই রাজবল্লভী দেবী এবং হাট যুক্ত হয়ে হয় রাজবল্লভী হাট নামের উৎপত্তি, পরে কালক্রমে তা হয়ে উঠেছে রাজবলহাট। মন্দির থেকে কিছুটা দূরে রাজবল্লভী মাতার বিরাট দীঘি বা পুকুর আছে, যার নাম ‘রাজবল্লভী দীঘি’। ভুরশুটের রাজা সদানন্দ রায় এই দীঘি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ​

রাজবল্লভীর দেবীর নামেই মন্দিরটি রাজবল্লভীর মন্দির নামে পরিচিত। কালীমূর্তি বলতেই আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে কৃষ্ণবর্ণা বা গাঢ় নীল বর্ণের মূর্তি। তবে রাজবল্লভী মাতার মূর্তি কিন্তু একেবারেই তেমন নয়। তিনি উজ্জ্বল, অর্থাৎ শ্বেতবর্ণ। রাজবল্লভী কালীবিগ্রহ ছয় ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট। গঙ্গামাটি দিয়ে বিগ্রহ নির্মিত। ত্রিনয়নী মুণ্ডমালিনী দ্বিভূজা বিগ্রহের ডানহাতে ছুরি ও বামহাতে রক্তপাত্র। কালীমূর্তির ডান পা শায়িত শিবের বুকের ওপরে এবং বাম পা বিরুপাক্ষের মস্তকে স্থাপিত। বিগ্রহটি শ্বেতকালিকা নামেও বিখ্যাত। এই মন্দির চত্বরে রাজবল্লভী দেবীর মন্দির ছাড়াও একাধিক মন্দির রয়েছে। মন্দিরের পাশেই একটি নাটমন্দির আছে। স্থানটি অন্যতম শাক্তপীঠ হিসেবে পরিগণিত হয়।

জাঙ্গিপুর পুলিশ ফাঁড়ির অনতিদূরেই রাজবল্লভী মায়ের মন্দিরের প্রবেশপথ রয়েছে। প্রবেশপথ পেরোলেই এক বিরাট নাটমন্দির। নাটমন্দিরকে ঘিরে রয়েছে চারটি শিবমন্দির। নাটমন্দির পেরিয়ে গর্ভগৃহে প্রবেশ করতেই শ্বেতকালীর মূর্তিটি চোখে পড়বে। মূর্তিটি বিবসনা নয়, নয় চতুর্ভুজাও। দেবীর পরনে স্থানীয় তাঁতিদের বোনা শাড়ি। পায়ের নিচে একটি নয়, বরং দুটি শিবমূর্তি দেখতে পাওয়া যায়। ডান পা রয়েছে কালভৈরবের বুকের উপরে। আর বাম পা রাখা আছে বিরূপাক্ষ শিবের মাথার উপরে। রাজবল্লভী দেবীর মূর্তি অদ্ভূত এবং মাটির মূর্তি। গঙ্গা মাটি দিয়ে তৈরি হয় এই মূর্তি। বাম হাতের তালুতে আছে একটি সিঁদুরের পাত্র আর কোমরে ছোট ছোট কাটা হাতের মালা। গলায় ঘণ্টার মালা। বিভিন্ন শহর ও গ্রাম থেকে আসা ভক্তরা দেবীর প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে রাজবলহাটে মিলিত হয়। সকাল সাতটায় মন্দিরের দরজা খোলে। এগারোটায় পুজো শুরু হয়ে দুপুর দুটোয় ভোগ নিবেদন করা হয়। সাতটায় হয় সন্ধ্যারতি। 

শোনা যায়, বহুকাল আগে যখন এই অঞ্চলের পাশ দিয়ে কংসাবতী নদী বয়ে যেত, তখনই এক সদাগর দেবীর দেখা পান। তিনিই এখানে মন্দির তৈরি করেন। তবে সে কথার কোন ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই, নিছকই লোককথা। ইতিহাসেও রাজবল্লভী মায়ের মন্দির নিয়ে বিতর্ক আছে। কেউ কেউ মনে করেন আনুমানিক ১২৪২ সালে ভূরসুটের রাজা সদানন্দ মন্দিরটি নির্মাণ করেন। আবার অনেকের মতে, মন্দিরের বয়স ততটা পুরনো নয়। ষোড়শ শতকে রাজা রুদ্রনারায়ণ রায় নির্মাণ করেন মন্দিরটি।

তবে রাজবল্লভী মায়ের পুজোর ইতিহাস সুপ্রাচীন, একথা নিঃসন্দেহে স্বীকার করা যায়। একসময় এই অঞ্চলে আদিবাসী সম্প্রদায়ের বসবাস ছিল। তাঁদের মধ্যে বৌদ্ধ ধর্মের প্রসারও ঘটেছিল। সেই সময় থেকেই তান্ত্রিক পদ্ধতিতে এই পূজার্চনা চলে আসছে। দেবদেবীর সঙ্গে এখানে নীল সরস্বতী এবং তারা মাও পুজো পান। এঁরা দুজনেও বৌদ্ধ দেবী। আবার দুই পুরুষ অবতারের মাথায় পা দিয়ে দাঁড়ানো রাজবল্লভীর শক্তিমূর্তিটিও বৌদ্ধ দেবী পর্ণশবরীর কথা মনে করিয়ে দেয়। সম্ভবত অনেক পরে ব্রাহ্মণ বা উচ্চবর্ণের রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতা পান বলেই দেবীর নাম রাজবল্লভী।

আজও রাজবল্লভীর পূজার্চনার রীতিনীতিতে নানান তান্ত্রিক ক্রিয়াকলাপ দেখা যায়। নিয়মিত ছাগবলির পাশাপাশি দুর্গা পুজোর অষ্টমী তিথিতে মেষ বলির রীতি বহাল রয়েছে। ছাগ বলি অবশ্য এখানে হাঁড়িকাঠে মাথা রেখে হয় না। বরং ছাগলটিকে ঝুলিয়ে রেখে প্যাঁচ দিয়ে তার মুণ্ডচ্ছেদ করা হয়। বলির পর গর্ভগৃহের পিছনের খপ্পরে পশুদের দেহাংশ ফেলে রাখা হয়। শোনা যায় এই খপ্পরের জায়গাটিতেই একসময় ছিল রাজা সদানন্দের পঞ্চমুণ্ডের আসন। এখানে বসেই তিনি তন্ত্রসাধনা করতেন। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মন্দিরের সমস্ত প্রাচীন নিদর্শনই হারিয়ে গিয়েছে। সংস্কারের কারণে অনেক কিছুই হারিয়ে গিয়েছে বর্তমান মন্দিরটির বয়স একশো বছরের বেশি নয়।

রাজবল্লভী দেবীর স্বভাবও রাজকীয়। তিনি প্রতি রাত্রে কাঠের পালঙ্কে নিদ্রা যান। রাতে মাঝে মধ্যে তাঁর তামাক সেবনের ইচ্ছাও হয়। তাই মন্দিরের মধ্যেই এক কোণে প্রস্তুত রাখা থাকে গড়গড়া। তবে খাবারের বিষয়ে তাঁর কোন আড়ম্বর নেই। কোনরকম সম্বরা না দিয়ে প্রতিদিন সিদ্ধ ভোগ রান্না হয় মন্দিরের লাগোয়া রন্ধনশালায়। রোজ অন্তত হাজারজন ভক্তকে সেই ভোগ পরিবেশন করা হয়।

রাজবলহাট ছাড়াও কিন্তু আরও দুই জায়গায় শ্বেতকালীর সন্ধান পাওয়া যায়। তার একটি আবার খোদ কলকাতার বুকে। শোভাবাজারের এই মন্দিরটি আনুমানিক অষ্টাদশ শতকের প্রথমদিকে নির্মিত হয়েছিল। শোনা যায় তখন এখানে ডাকাতরা পুজো করতেন। ডাকাতি করতে যাওয়ার আগে তন্ত্রমতে পুজো দিয়ে যেতেন। অপর মন্দিরটি রয়েছে ব্যান্ডেল স্টেশনের নিকটেই। তাঁরাও রাজবল্লভী। তাঁদের প্রত্যেকের গায়ের রং সাদা।

TwitterFacebookWhatsAppEmailShare

ভিডিও

আরও পড়ুন

Decorative Ring
Maa Ashchen