বাংলা ভাষার প্রতি অগাধ ভালোবাসা ছিল সৌমিত্রর

সেই সন্ধ্যায় প্রশ্ন তুলেছিলেন সৌমিত্র, কথ্য বাংলা ভাষার উচ্চারণের মানদণ্ড কোনখানে খুঁজব আমরা?

January 19, 2021 | 2 min read
Published by: Drishti Bhongi

কলকাতা বেতার(Kolkata Radio) নিয়ে ‘প্রণবেশ সেন স্মারক বক্তৃতা’-য় নিজের লেখা পাঠ করছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়(Soumitra Chatterjee), বছর সাতেক আগে, গোর্কি সদনে। প্রথম সারিতে তন্নিষ্ঠ শ্রোতা শঙ্খ ঘোষ(Sankha Ghosh)। বক্তৃতার পর শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে কথোপকথন ছিল সৌমিত্রর। অনুষ্ঠান শেষ হতেই তিনি মঞ্চের কিনারে, শঙ্খবাবুকে জিজ্ঞেস করলেন, “ঠিক ছিল শঙ্খদা?” স্মিত হাসিতে মাথা নাড়েন শঙ্খবাবু, তাঁর পরামর্শেই “উদ্যোগী হয়েছিলাম আমরা সে বারের স্মারক বক্তৃতায় সৌমিত্রবাবুকে বেতার-বিষয়ে কথা বলানোর আয়োজনে, সম্মত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এও বলেছিলেন: শঙ্খদা যেন উপস্থিত থাকেন,” ভবেশ দাশের স্মৃতি এখনও তরতাজা।
সেই সন্ধ্যায় প্রশ্ন তুলেছিলেন সৌমিত্র, কথ্য বাংলা ভাষার উচ্চারণের মানদণ্ড কোনখানে খুঁজব আমরা? বেতারের সূত্রে বোঝানোর চেষ্টা করছিলেন কোথায় তৈরি হচ্ছে সমস্যাটা: “যাঁরা ঘোষক বা সংবাদ পাঠক হিসেবে নির্বাচিত হন তাঁদের মধ্যে বেশির ভাগেরই গলা বেশ ভালো হয়… এঁদের অনেকেই নিজের নিজের কণ্ঠস্বরের প্রতি নার্সিসাস সুলভ আকর্ষণে ভুগতে থাকেন। তদুপরি সেই শ্রুতিমধুরতা শ্রোতার কাছে পৌঁছোনোর পথে প্রয়োজনের অতিরিক্ত স্পষ্ট গোটাগোটা শব্দ প্রক্ষেপের দরুন তাঁদের মুখনিঃসৃত বাংলা দারুণ কৃত্রিম ও নিষ্প্রাণ বলে মনে হতে থাকে।” সৌমিত্রর কাছে কলকাতা বেতারের উজ্জ্বল ব্যতিক্রম নীলিমা সান্যাল ও জয়ন্ত চৌধুরী, তাঁদের “বাংলা উচ্চারণ ছিল অত্যন্ত পরিষ্কার এবং ভানভণিতা বর্জিত।”
সত্যজিতের সুকুমার রায় তথ্যচিত্রে ভাষ্যপাঠের জন্য ডাক পড়ল সৌমিত্রর। ডেকে বললেন, “অনেক জায়গায় বাবার কবিতা থাকবে।” ছবির শেষে যেখানে আবোল তাবোল-এর পদ্য আছে— ‘ঘনিয়ে এল ঘুমের ঘোর’— “সেখানটায় আমি গলাটার মধ্যে একটা বেদনার ছায়া এনেছিলাম উইদাউট মেকিং ইট সেন্টিমেন্টাল— এটা আমারও শিল্পের আদর্শ— একটা শিল্প ইমোশোনালি স্ট্রং যেমন হবে, সেটা যেমন মানুষকে মুভ করাবে, তেমনই তার মধ্যে যেন সেন্টিমেন্টালিটি না থাকে…”, এক দীর্ঘ সাক্ষাৎকারে অনসূয়া রায়চৌধুরীকে বলেছিলেন সৌমিত্র। আর সত্যজিৎ বলেছিলেন, “সৌমিত্র শেষটা এত সুন্দর পড়েছে যে চোখে জল এসে যায়।”
নিজের ভাষার প্রতি সৌমিত্রর এই ভালবাসাই তাঁকে অভিনেতা হিসেবে পূর্ণতার দিকে এগিয়ে দিয়েছে, বাংলা ভাষার নির্ভুল উচ্চারণ ও অর্থদীপ্ত ব্যবহারই ছিল তাঁর অভিনয়ের মেরুদণ্ড। পাঁচ বছর আগে আশি পূর্ণ করার সময় এক আত্মভাষে ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন: “হাল আমলের পরিস্থিতি দেখে মনে হয় বাঙালিরা তার ভাষাটাকেই বিস্মৃত হয়েছে… অধিকাংশ তথাকথিত শিক্ষিত বাঙালি ভালো করে বাংলা ভাষাটাই আর বলে না। নিজের মনের ভাব, ইচ্ছে, আবেগ প্রকাশ করার জন্য তাদের হিন্দি ও ইংরেজি ভাষার শব্দ ব্যবহার করতে হয়।” এ যেন সটান আয়নার সামনে দাঁড় করিয়ে দেওয়া।

TwitterFacebookWhatsAppEmailShare

ভিডিও

আরও পড়ুন

Decorative Ring
Maa Ashchen