সুভাষ মুখোপাধ্যায়: চির বসন্তে বিপ্লবের ঘোষক

সমর সেনের অমর মেধার সামনে নত মস্তকে দাঁড়িয়েও বলতে হয়- ‘সুভাষ তার মতো’ সে অর্থে বাংলা কবিতায় তার কোন পূর্বসূরি নেই।

February 12, 2020 | 3 min read
Published by: Drishti Bhongi

জীবনানন্দ দাস তখন তার নিজ সৃষ্ট নির্জন কোণে মহাসমারোহে হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাচ্ছেন। সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, বিষ্ণু দে যথারীতি নিমগ্ন নিজস্ব নির্জনতায়। বুদ্ধদেব বসু তো রীতিমত ‘The era of Rabindranath is over’ ঘোষণা দিয়ে রণাঙ্গনে নেমেছেন নতুন কাব্য ভাষা নির্মাণ সাধনায়। ঠিক তখন বুদ্ধদেব বসুর পরামর্শে গদ্যছন্দ তুনে জুঁড়ে শব্দসর ছুঁড়ছেন অনতিদীর্ঘ কবি জীবনধারী সমর সেন। রবীন্দ্রনাথ তখন তার কাছে জোল মনে হয়, ঠিক বুঝে উঠতে পারেন না ‘দুধ ও তামাকে সমান আগ্রহী এই কবিকে।’

সুভাষ মুখোপাধ্যায়। ছবি সৌজন্যেঃ ইউটিউব

উর্বশীর কাছে সমরের সদর্প আহ্বান এভাবে, ‘তুমি কি আসবে আমাদের মধ্যবিত্ত রক্তে/দিগন্তে দুরন্ত মেঘের মতো।’ প্রবল বিরোধিতা সত্বেও বুদ্ধদেব বসু এক পর্যায়ে মেনে নিতে বাধ্য হন, ‘রবীন্দ্রনাথের প্রভাব আধুনিক বাঙালি কবির প্রচেষ্টায় অনিবার্য।’ মেনে নিয়েই আবার বলেন সমর এক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম, এই নবীন কবি রবীন্দ্রনাথে যেন কোন অবলম্বন খুঁজে পাননি। রবীন্দ্রনাথের প্রভাবের বাইরে থেকে সমর তৈরি করছেন নতুন পথ।

সমর যেখানে থেমে গেছেন সেখান থেকে সুভাষের শুরু। এখানে সুভাষের জন্য স্বীকৃতির জায়গাটা হলো তার পথচলার শুরুটা নতুন পথে। আর সমর সেনের অমর মেধার সামনে নত মস্তকে দাঁড়িয়েও বলতে হয়- ‘সুভাষ তার মতো’ সে অর্থে বাংলা কবিতায় তার কোন পূর্বসূরি নেই। তিনি নিজ পায়ে পথচলা ‘পদাতিক’ যিনি বাংলা কাব্য ভূবনে নির্মাণ করেছেন নতুন পথ।

আমাদের কয়েক প্রজন্মের কাছে সুভাষ মুখোপাধ্যায় তার কবিতার মতোই ‘মিছিলের মুখ।’ কমরেড সুভাষ মুখোপাধ্যায়। সুভাষ মানেই ‘স্ট্রাইক। স্ট্রাইক। পথে পথে আজ হোক মোকাবিলা, দেখি কার কত শক্তি।’

কাক রঙা ঝাঁকড়া চুলের সুভাষ তখন আমাদের কাছে সাহসের আরেক নাম। আমাদের হৃদয়ে সে চুলে কখনও সাদার ছোপ লাগেনি। লাগবে কী করে? তিনি তো আমাদের জানিয়ে দিয়েছেন, ‘ফুল ফুটুক আর না ফুটুক আজ বসন্ত।’ তিনি চির বসন্তের কবি। ভগিনী স্থানীয় একজনের সম্মান রক্ষার্থে মাস্তানদের সাথে ঘুসোঘুসিতে সামনের দাঁত ভাঙ্গা ভাঙ্গনের বার্তাবাহক এক কবি। তিনি ‘পদাতিক’ কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়। যিনি ভূমি, ভাষা, ভবিষ্যৎ এর কথা বলতে এসেছেন সেই সঙ্গে ভালবাসার কথাও। পণ করেছেন তাড়িয়ে দেবেন আরেক ‘ভ’ অর্থাৎ ভয়কে।

সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের জন্ম ১২ ফেব্রুয়ারি ১৯১৯ পশ্চিমবঙ্গের নদিয়া জেলায়। ভবানীপুর মিত্র স্কুল থেকে ম্যাট্রিক। ১৯৪১ সালে স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে দর্শনে অনার্সসহ বিএ। চেষ্টা সত্ত্বেও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের কারণে এর বেশি অগ্রসর হয়নি তার পড়াশোনা । ১৯৩২-৩৩ সালে বঙ্গীয় প্রাদেশিক কিশোর ছাত্রদল এ যোগ দেন। সমর সেন এর কাছ থেকে পাওয়া ‘হ্যান্ডবুক অব মার্কসসিজমের’ মাধ্যমে মার্কসবাদে দীক্ষা।

প্রথম প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ ‘পদাতিক’ ১৯৪০ সালে। কবির বয়স তখন একুশ। সুভাষ মুখোপাধ্যায় এর কাব্যোলোচনার শুরুতে সামনে রাখতে হবে তার শুরুর সময়ের ছবি। সময়টা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আঘাতে জর্জরিত পৃথিবীতে ত্রিশের দশকের রাজনৈতিক ব্যারোমিটারের পারদ রেখার ঘন ঘন উত্থান-পতনের। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে হিটলারের প্রতিষ্ঠা ও প্রসার, চীনে জাপানের হামলা, স্পেনে ফ্যাসিজম-কমিউনিজম দ্বন্দ্ব, মিউনিখ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, সমাজতন্ত্রের বার্তা যেমন প্রভাব ফেলেছে তার রচনায়।

তেমনি দেশের অভ্যন্তরে বিপ্লবী ও সন্ত্রাসবাদী কার্যাকলাপ, বামপন্থী দল-উপদল, গান্ধিজীর ডান্ডি অভিযান, সুভাষ বসুর উত্থান, অর্থনৈতিক মন্দা, হিন্দু-মুসলমান বিরোধ তাকে প্রভাবিত করেছে সমান। সরাসরি প্রভাবিত করেছে তার পদাতিক পর্যায়ের ১৯৪০-৫০ এর কালে প্রকাশিত পদাতিক, অগ্নিকোণ, চিরকুট তিনটি কাব্যগ্রন্থকে।

কোন সন্দেহ নেই ‘পদাতিক’ প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে একুশের এ যুবক কবি নাম লিখিয়েছেন বাংলা কবিতার ইতিহাসে অমরত্বের পাতায়, এতটাই ব্যতিক্রম তার ভাষা। তার শব্দেরা তার নিজের, নির্মেদ কবিতার শরীর, প্রকাশ সরাসরি, স্পষ্ট। নিজে যে জ্বলন্ত সময়ের প্রতিনিধি তাকে অস্বীকারের কোন চেষ্টা করেননি। প্রথম থেকেই তো তিনি মানুষের মিছিলের এক কমরেড। তিনি তো মানুষের কথা বলবেনই।

তবে এও সত্যি ইতিহাস নির্ধারিত সীমাবদ্ধতা তার কবি হয়ে উঠার পথে কোন বাঁধা দেয়নি। তার ভাষায়, ‘শ্রমিক আন্দোলন করতে করতেই আমার চারপাশের জীবন আমাকে লেখার দিকে ঠেলে দিল।’ একুশ বছরের এক তরুণ, সরলবিশ্বাস, পবিত্র আবেগ, বজ্র কঠিন প্রতিবাদী সঙ্কল্প নিয়ে বাংলা কবিতার আকাশে চল্লিশের দশকে নিয়ে উদয় হলেন যে কাব্যগ্রন্থে তার নাম ‘পদাতিক।’

(এই প্রবন্ধটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল চ্যানেল আই তে। লেখনী: আকিল উজ জামান খান)

TwitterFacebookWhatsAppEmailShare

ভিডিও

আরও পড়ুন

Decorative Ring
Maa Ashchen