তাজমহল না তেজোমহল? মিথে ঘেরা এক কাহিনী
২০০০ সালে নিজের তত্ত্বের সত্যতা প্রমাণের জন্য তাজমহলে খনন কার্য চালানোর জন্যে দেশের সর্বোচ্চ আদালতে আবেদন করেছিলেন ওক। কিন্তু তার দাবি নস্যাৎ করে, আবেদন খারিজ করে দেয় সুপ্রিমকোর্ট।
সৌভিক রাজ

শাহজাহানের ভালোবাসার সাক্ষ্য বহন করে চলেছে তাজমহল, চিরকালীন এবং শাশ্বত প্রেমের নিদর্শন হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে এই সৌধ। চিরন্তন প্রেমের সৌধ, সপ্তম আশ্চর্যের অন্যতম এক আশ্চর্য, মনোগ্রাহী স্থাপত্য রূপে বিশ্বের দরবারে পরিচিত তাজমহল। ১৬০৭ সালে মীনাবাজারে আরজুমন্দ বানু বেগমের প্রেমে পড়েছিলেন যুবরাজ খুরম। যাকে বলে লাভ অ্যাট ফার্স্ট সাইট! পরবর্তীকালে ১৬১২ সালে খুরমের বিয়ে হয় আরজুমন্দের সঙ্গে, ইতিহাসে তিনিই মমতাজ নামে পরিচিত। ১৬২৮ সালে সিংহাসনে বসার পরে খুরম হন শাহজাহান। তার বছর তিনেক পরেই চতুর্দশ সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে প্রয়াত হন মমতাজ। স্ত্রীয়ের স্মৃতিতে তাঁরই সমাধিস্থলে শাহজাহান গড়ে তোলেন তাজমহল। ১৬৩২ সালে তাজমহল নির্মাণ শুরু হয়েছিল এবং ১৬৫৩ সালে তা শেষ হয়েছিল।
এই তাজমহল নিয়ে কিংবদন্তির অন্ত নেই! আসলে মিথ, ইতিহাস ও তথ্য প্রমাণের তোয়াক্কা করে না। জনশ্রুতিই তার ভিত্তি। গোপন কুঠুরি, লুকিয়ে রাখা গুপ্তধন, পূর্ণিমা রাতে মুমতাজের ঘুরে বেড়ানো কি নেই, মিথের ঝুলিতে! শাহজাহানের কালো তাজমহল তৈরির ইচ্ছে, নির্মাণ শেষ হওয়ার পরে নির্মাণকর্মীদের হাতের আঙুল কেটে দেওয়া, মশলাদার গপ্পের কোন অভাব নেই। কিন্তু আদপে এসব কিছুই হয়নি। ইতিহাস এবং গবেষকেরা তাই বলেন।
তবে সাম্প্রতিককালে তাজমহলকে ঘিরে অবর্তিত হওয়া বহুলপ্রচলিত মিথটি হল তেজোমহল বা তেজো মহালয়া বিতর্ক। তেজো মহালয়া শব্দের অর্থ শিব ঠাকুরের আলোয়। আগ্রায় যেখানে আজ তাজমহল দাঁড়িয়ে আছে, সেখানে তেজোমহল বলে একটি হিন্দু মন্দির ছিল, এমনই দাবি করা হয়। ওই শিব মন্দিরের উপরেই তাজমহল নির্মিত হয়েছে, এই জনশ্রুতি সর্বত্র ছড়িয়ে গিয়েছে।

এই মিথটি জনক হলেন জনৈক পি এন ওক নামে এক ব্যক্তি। পুরুষোত্তম নাগেশ ওক, তার ‘দ্য তাজমহল ইজ তেজো মহালয়া, এ শিব টেম্পল’ শীর্ষক বইতে এমন দাবি করেছিলেন। ৩০ পৃষ্ঠার এই বইতে প্রায় ১০৩টি দাবি করে তিনি লিখেছিলেন যে, শিব মন্দিরের উপরেই তৈরি হয়েছে তাজমহল এবং ওই শিব মন্দিরটির নাম ছিল তেজো মহালয়া। বইটি ১৯৮৯ সালে প্রথম প্রকাশিত হয়। বইটিতে তিনি লেখেন, এদেশে মুসলমান আক্রমণের আগে তেজো মহালয়া মন্দির তৈরি হয়েছিল। রাজা পারমর্দি দেব এর নির্মাণ করেন, বংশানুক্রমে মন্দিরের উপত্তরাধিকারী হন রাজা মান সিংহ ও রাজা জয় সিংহ। সেই সঙ্গে তেজো মহালয়াকে বৈদিক যুগের মন্দির বলেও দাবি করেন তিনি। প্রসঙ্গত, বৈদিক যুগে সাকার ঈশ্বর ও মন্দিরের খুব একটা প্রচলন ছিল না।
২০০০ সালে নিজের তত্ত্বের সত্যতা প্রমাণের জন্য তাজমহলে খনন কার্য চালানোর জন্যে দেশের সর্বোচ্চ আদালতে আবেদন করেছিলেন ওক। কিন্তু তার দাবি নস্যাৎ করে, আবেদন খারিজ করে দেয় সুপ্রিমকোর্ট।
২০১৫ তেও এই একই দাবিতে মমলা হয়েছিল, যার পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৭ সালের আগস্টে এএসআই অর্থাৎ আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া আদালতে জানায়, তাজমহল যেখানে, সেখানে কোনও হিন্দু মন্দিরের অস্তিত্ব ছিল বলে কোনও প্রমাণ নেই। ২০১৮ সালে আবারও এএসআই স্পষ্ট করে দেয়, তাজমহল যেখানে দাঁড়িয়ে, সেখানে কখনও হিন্দু মন্দির ছিল এবং হিন্দু মন্দিরটিকে তাজমহলে রূপান্তরিত করা হয়েছিল; এমন কোনও প্রমাণ নেই।