কালিকা বঙ্গদেশে চ, কালী আরাধনাতেই লুকিয়ে শাক্ত-ভূমি বাংলার শিকড়

নিউজ ডেস্ক, দৃষ্টিভঙ্গি, ১০:০৬: আজ কালী পুজো। তিমির, তমসা ঘুচিয়ে দেন দেবী। তামসিক কালীর আরাধনায় আলোর উৎসবে ভেসে যাবে বাংলা। কালো মেয়েই যে আবহমানকাল থেকে বাংলা ও বাঙালির রক্ষাকর্ত্রী। কালী হলেন বঙ্গদেশের অধিষ্ঠাত্রী। বলা হয়, কালিকা বঙ্গদেশে চ। কালকে ধারণ করা দেবী কালী-ই হলেন বাঙালি জাতির আরাধ্যাদেবী। শাক্ত বাঙালি শক্তির উপাসনার মাধ্যমই কালী সাধনা।
একদা বিপ্লবীরা কালীর সামনে দেশ স্বাধীন করার শপথ নিতেন। অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষা নিতেন। তারপর বাংলার ‘রবিন হুড’ ডাকাতরা কালীর আরাধনা করত। ধনী, বিত্তবানদের লুট করে গরিবদের মধ্যে বিলিয়ে দিত সম্পদ। গুন্ডা থেকে নেতা, সমাজ বিরোধী থেকে সাধক, তান্ত্রিক, কাপালিক, জমিদার, রাজা… কালীর পদতলে কে মাথা ঠেকায়নি! বাংলায় কসাইয়ের দোকানেও কালীর পুজো হয়। কালী এতটাই মিশে আছেন বাংলার সঙ্গে। এই মাটি দিয়েই তিনি তৈরি হন, আবার এই মাটিতেই বিলীন হন।
কালী বাঙালির ঘরের কন্যে। তিনি রামপ্রসাদের হাতে হাত মিলিয়ে বেড়া বেঁধে দেন, দক্ষিণেশ্বরের কালীঘরের ঠাকুর পরমহংসদেবের কথা অক্ষরে অক্ষরে শোনেন, কমলাকান্ত-আগমবাগীশেরা কালীকে বাড়ির মেয়ে করে তুলেছেন। ঈশ্বরের এহেন হিউম্যানিফিকেশন একমাত্র বাংলাতেই সম্ভব। বাঙালি নিজে মাছ, মাংস খায়, সে তার দেবী কালীকেও তা নিবেদন করে। গান গেয়ে শোনায়। মার কাছে মানত করে। মানত পূরণ হলে নিবেদন করে প্রাণ ঢেলে। পুজো দেয়। কখনও নাকের নথ, গলার হার গড়িয়ে দেয়। শাড়ি দেয়। বলিপ্রিয়া দেবীর উদ্দেশ্যে বলিদান করে। দেবীর পুজোয় বাড়িঘর সাজিয়ে তোলে, আলো জ্বালে। এভাবেই কালী হয়ে ওঠেন বাড়ির সদস্য। যুগে যুগে এভাবেই দেবীর আরাধনা করে এসেছে বাংলা।
কিন্তু বিগত কিছু বছরে এসেছে আকাশ-পাতাল বদল। ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে বাংলার সংস্কৃতি। যে সংস্কৃতি গড়ে উঠেছিল শাক্ত আরাধনাকে ঘিরে, কালীকে ঘিরে। বাঙালির ঈশ্বর আরাধনার দখল নিচ্ছে হিন্দিবলয়ের সংস্কৃতি। শাক্ত আর বৈষ্ণবের মিলনক্ষেত্র বাংলা গো-বলয়ের ভেগানিজম আওড়াচ্ছে। ঈশ্বরকে আর মাছ, মাংস নিবেদন করতে চাইছে না বাঙালি। বাংলা অনন্য, কারণ ঈশ্বর- নিজের পরিবারের সদস্য হয়ে ওঠেন এখানে, বাংলার সেই নিজস্বতা হারিয়ে যাচ্ছে।
যে বাঙালি পত্নীবিরহে কাতর রঘুবীর রামের পুজো করত, সে বাঙালি এখন নীল সিক্স প্যাক অ্যাবস যুক্ত রামের পুজো করে। গোঁফ আর ভুঁড়িওয়ালা শিবকে জিমে পাঠিয়েছে বাঙালি। অকালবোধনের শারদীয় দুর্গাপুজো ছেড়ে নবরাত্রি পালন করছে। বিপত্তারিণীর লাল তাগা আর তারকেশ্বরের সাদা সুতো ছেড়ে রঙ-বেরঙের ধাগা পরছে। শ্রাবণে সবুজ চুরি পরছে। লাড্ডু ছেড়ে গণেশকে মোদক দিচ্ছে। করবা চৌথ পালন করছে। নামাবলি পরা পুরোহিতরা উধাও! রঙিন ধুতি পরা ব্রাহ্মণদের দাপট বাড়ছে। দুগ্গা দুগ্গার বদলে হালফিলে বাঙালি জ্যায় শ্রীরাম বলছে! লোকায়ত বঙ্গের পুজো, লোকাচারকে ঘিরে থাকা বাংলার নিজস্ব সংস্কৃতি কার্যত ভ্যানিস। যে বহির্বঙ্গ মাছ, মাংস খাওয়া বাঙালিকে কোনও দিন প্রকৃত হিন্দু বলে মানেনি, তাদের সংস্কৃতি আপন করার এহেন মরিয়া চেষ্টা দুঃখের। পীড়ার।
গোদা বাংলায় পরদেশী সংস্কৃতির আত্তীকরণ! ধাপে ধাপে বহির্বঙ্গীয় সংস্কৃতি দখল নিচ্ছে বাংলার। আড়ালে রয়েছে রাজনৈতিক, সামাজিক আগ্রাসন। রাজনৈতিক আগ্রাসন এত সুক্ষ্মভাবে দাবানলের মতো ছড়াচ্ছে যে আঁচ পাওয়া যাচ্ছে না। ধর্মের কেমোফ্ল্যাজের মোড়কে বাঙালির শাক্ত ডিএনএ-তে সনাতনী প্রোটিনের অনুপ্রবেশ হচ্ছে। সনাতন বলে কিন্তু কোনও ধর্ম নেই। কারণ সনাতন শব্দের অর্থ ক্লাসিক্যাল, প্রাচীন, শাশ্বত যা চিরকালীন। কিন্তু বহন পরিবর্তনের ধারা। সিন্ধু সভ্যতার লোকেরা উচ্চরণের কারণে হিন্দুস্তানের লোক হয়েছে। বৈদিক ধর্ম হারিয়ে গিয়েছে। সিন্ধু উচ্চারণের অপারগতায় হিন্দু হয়েছে। তারপর হয়েছে ধর্ম। বিবেকানন্দের সর্বজনীন গ্রহণযোগ্যতা ও সহিষ্ণুতার হিন্দু ধর্মের সংজ্ঞা পাল্টেছে শেষ এক-দেড় দশকে। পাল্টে যাওয়া ধর্মকে আপন করতে গিয়ে বাঙালি শিকড় খুইয়ে নিজভূমে পরদেশী হয়ে যাবে না তো?