করোনা কালে কুমোর পাড়ার হাল ধরেছেন দশভূজারা 

কুমোরটুলিতে ঠাকুর গড়েন মহিলারাও। কাজ শিখেছেন বাবা অথবা স্বামীর কাছে। এখন কোভিড-পরিস্থিতিতে বদলে গেছে জীবনের জলছবিটা।

September 17, 2020 | 5 min read
Published by: Drishti Bhongi

অথৈ জলে কুমোরটুলির মৃৎশিল্পীরা। করোনা এবং আম্পান, পরপর দুই বিপর্যয়ের জেরে মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছে শিল্পীদের। পুজো হবে তো? আশা-আশঙ্কার দোলাচলে রয়েছে কুমোরটুলি। 

কুমোরটুলিতে ঠাকুর গড়েন মহিলারাও। কাজ শিখেছেন বাবা অথবা স্বামীর কাছে। এখন কোভিড-পরিস্থিতিতে বদলে গেছে জীবনের জলছবিটা। কেমন আছেন কুমোর পাড়ার দশভূজারা? খোঁজ নিল দৃষ্টিভঙ্গি। 

মালা পাল এবং সুস্মিতা রুদ্র পাল মিত্রর সাথে একান্ত সাক্ষাৎকার রইল আপনাদর জন্য:

প্রঃ আপনি তো চোখ দান করেন মূলত। কি করে শুরু হল এই জার্নি? কারণ এই কাজ তো সহজ না। মূলত পুরুষরাই চোখ দান করে থাকেন।

সুস্মিতা: ছোট বেলায় কখনো ভাবিনি এই শিল্পের সাথে যুক্ত হব। পাশেই বসে আছেন আমার কাকিমা, এই কাকিমাই আমার অনুপ্রেরণা বলতে পারেন। আমাদের বাড়ির পুরুষ থেকে মহিলারা সবাই আমাকে সাপোর্ট করেছেন। আমার বাবা আমাকে হাতে করে কাজ শিখিয়েছেন। এই কাকিমা আমাকে হাতে করে কাজ শিখিয়েছেন। আমাকে এদিকে অনেকটা এগিয়ে দিয়েছে বলে আমার পক্ষে সম্ভব হয়েছে। বর্তমানে আমি বিবাহিত। আমার স্বামী, আমার শ্বশুর বাড়ির লোকজন তারাও আমার পাশে দাঁড়িয়েছে। যার ফলে আমার পক্ষে এই কাজটা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে।

প্রঃ রান্নাঘর সামলে, অফিস সামলে এরকম তো আমরা দেখিই। কিন্তু এক দশভূজার হাতে আরেক দশভূজার জন্ম হচ্ছে। কতোদিন হইয়ে গেল?

মালা: ১৪ বছর বয়সে যখন আমি এ লাইনে এলাম, তখন কুমোরটুলির লোকেরা বলেছিল মেয়েরা এ লাইনে আসবে না। কিন্তু আমার দাদা বলল কেন আসবে না? এখানে সব বাইরের লেবাররা কাজ করে, সে কারণে এখানে মেয়েরা ঘর থেকে বাইরে আসবে না। বাবাও বলত, বয়স্ক মানুষরা আমাকে বলছে, তুই এরকম দোকানে এসে কাজ করছিস। কিন্তু আমার ভালো লাগত। বাবা বড় ঠাকুরগুলো করতো, তার নীচেই আমি ছোটগুলো করতাম। 

বাবা ৮৫- এ মারা যান। দাদা গোবিন্দ পাল (কালু) বলল বাবা তো মরে গেল এখন দোকানে আসলে তোকে বকাবকি করবে না। তারপর আমি আসতাম। কিন্তু খুব একটা পছন্দ করতো না এখানকার লোকেরা। তারপর ৮৫-এ হ্যান্ডিক্যাপ্ট মিউজিয়ামে আমি চান্স পেয়ে যাই। আমাকে তখন ওখানেই চলে যেতে হল। ওখান থেকে কিছুটা কাজ করে আসার পরে আমি কুমারী মালা পাল ছিলাম, শিল্পী মালা পাল হলাম কুমোরটুলিতে এসে। 

শিল্পী মালা পাল হওয়ার পরেই সবাই আমার কাছে আসছে, আমি ভালো ভালো কাজগুলো করছি। সুস্মিতাকে নিয়েও আমরা বিবেকানন্দ কলেজে একটা প্রজেক্ট দিতে গেছিলাম। সেখানে সাতটা মেয়ে ছিল। সেখানে আমাদের একটা ডিগ্রী দেওয়া হয়েছিল, আমরা অতোগুলো মেয়ে নিয়ে কাজ করলাম। ওরা আমাদের সার্টিফিকেটও দিয়েছিল। গুরুসদয় মিউজিয়ামের হয়ে আমি বেশি কাজ করি, ওরা আমাকে মাস্টার ডিগ্রী দিয়েছে। 

ডিস্ট্রিক্ট, স্টেটে প্রাইজ নেওয়ার পর, ন্যাশনাল লড়ছি। জানি না কি হবে? কিন্তু মাস্টার ডিগ্রীটা নেওয়ার পর কিছু ছাত্র ছাত্রী নিয়েছি। শনিবার, রবিবার ২-৩.৩০ পর্যন্ত ওদের নিয়ে ক্লাস করাচ্ছি।

প্রঃ রান্নাঘর সামলানো, ঠাকুর তৈরি করা, ছাত্র ছাত্রী সামলানো। সহজ তো নয়। কি করে করেন?

মালা: সকাল ছটার সময় উঠি। এখন ৬ জন লেবার আছে আমার। কাজ করছে। সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে স্নান সেরে ভেবে নিই, এক হাড়ি ভাত করে কাজে যাব, পরে এসে বাকি রান্নাটা করতে পারব। সাড়ে এগারোটায় চলে গিয়ে দোকানে ওদের ভাত পৌছে দিই। সব কাজ সেরে ৩ টেয় দোকান যাই, রাত্রি ৯টা অবধি থাকি। এভাবেই সামলাতে হচ্ছে। শনিবার আর রবিবার একটু চাপ এসে গেছে, সকলের সাথে প্রোগ্রাম করতে হচ্ছে।

প্রঃ কাকিমার পরের প্রজন্ম তুমি। শ্বশুর বাড়ি থেকে যে সাপোর্ট পাও, সেটা তো সহজ নলয় এখনো। শ্বশুর বাড়িতে যখন তুমি প্রথম বললে, চোখ দেবে, কতোটা সাপোর্ট পেয়েছ?

সুস্মিতা: আমার বাবা শ্বশুর মশাই, শ্বাশুড়িমাকে বলেই নিয়েছিলেন আমার মেয়ে এই শিল্পের সাথে যুক্ত। কাজেই বিয়ের পর কাজের সময় ওকে ছাড়তে হবে। সে ক্ষেত্রে আমার শ্বশুর, শ্বাশুড়ি, স্বামী সবাই মত দিয়েছিলেন যে ওর কাজে আমাদের কোন আপত্তি নেই। যার ফলে বিয়ের পর থেকেই আমি এই কাজে আসছি। যতদিন শ্বাশুড়িমা ছিলেন আমার অবর্তমানে তিনিই সংসারটা সামলাতেন। 

বর্তমানে মাঝেমধ্যে স্বামীর ভরসায় রেখে চলে আসি সংসার। যখন পুরোটা সামলাতে পারে না তখন আমার শ্বশুর, স্বামী এখানেই চলে আসেন। দেখা গেল যতদিন আমি কাজ করি তারা এখানেই থাকেন। কাজ শেষ হয়ে গেলে তারা আমার সাথে বাড়ি ফেরে।

প্রঃ কোভিড আতঙ্কে অনেক ছোট ছোট ঠাকুর তৈরি হচ্ছে কুমোরটুলিতে। চোখ দান সূক্ষ কাজ।  ম্যানেজ করছ কিভাবে?

সুস্মিতা: প্রথমেই বলি এবছর কেন ছোট ঠাকুরের পরিমানটা বেশি। এবছর কোভিড আতঙ্কে বারোয়ারী কর্তাদের বাজেট অনেক ঘাটতি হয়ে গেছে। আগের তুলনায় ৩০%- এ এসে নেমেছে বাজেট। সবাই বলছে আমরা অতো বড় ঠাকুর না নিলেও ছোটর মধ্যে একটা কিছু করে দিন। যার ফলে ছোট ঠাকুর বেশি পরিমাণে তৈরি হচ্ছে। 

বড় ঠাকুর তৈরি করতে যতোটা পরিশ্রম হয়, একটা ছোট মূর্তি তৈরি করতেও ততোটাই পরিশ্রম হয়। কাজটা আরো বেশি সূক্ষ হয়ে যায় এবং আরেকটু বেশি ধরে ধরে কাজ করতে হয়। যেহেতু ছোট ঠাকুর মানুষ অনেক কাছ থেকে দেখবে, অনেক সূক্ষভাবে জানবে তাই।

প্রঃ চোখ দেওয়ার ক্ষেত্রে একজন বিশিষ্ট কাউকেই লাগে। প্রথমত তুমি মেয়ে এবং দ্বিতীয়ত তোমার বাবা এতোদিন ধরে করে এসেছেন, তারপর তোমাকে করতে হয়েছে। কিভাবে প্রস্তুত হলে?

সুস্মিতা: প্রথমে আমি প্রস্তুত ছিলাম না। আমার বাবা যখন অসুস্থ হলেন, তখন আমি বাধ্য হয়েই এক প্রকার করলাম। করার পর সেই প্রতিমা যখন মন্ডপে গেল, সজ্জিত হল, দর্শক দেখে যখন প্রশংসা করলেন, তখন আমার বাড়ির সবাই আমাকে উত়্সাহ যোগালো। আজকে মৃৎশিল্প আস্তে আস্তে অবলুপ্তির পথে চলে যাচ্ছে, আমরা যদি এই শিল্পকে বাঁচিয়ে না রাখি, তাহলে তো বাইরে থেকে কেউ এসে এই শিল্পকে বাঁচাবে না। যার জন্যে এই শিল্প নিয়েই আমি এখনো বেঁচে আছি। এটাকেই আমি নিজের পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছি।

প্রঃ মৃৎশিল্পের তো এই দশা কিভাবে পরবর্তী প্রজন্মকে মোটিভেট করছেন?

মালা: নিজের কাজটাও সামলাচ্ছি। আবার এদেরকেও তো কষ্ট করে তৈরি করিছি, এদেরকেও জায়গা ছেড়ে দিচ্ছি যাতে এরাও আমার মতো কিছু একটা করতে পারে। ওরা আমার কাছে তিন চার মাস হল আছে। মোটামোটি সবাই একটা করে ঠাকুর করেছে। সেটা আমার খুব ভালো লাগছে যে ওরা এখান থেকে শিখে গিয়ে করেছে। এখন হয়তো ঠাকুরগুলো ঠিকঠাক করতে পারছে না। পরে যখন ওরা শিল্পী হয়ে উঠবে তখন এটাই বলবে মালা পালের কাছে আমি তৈরি হয়েছি।

প্রঃ মহিলা মৃৎশিল্পী হওয়ার জন্যে কি অনেক বেশি কোথাও সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছে?

মালা: হতে তো হয়েছেই, যে মহিলারা কেন এই কাজ করবে? অতো ছোট বয়সে যখন বাইরে চলে যেতে হয়েছিল, বাইরে গিয়েও খুব কষ্ট হয়েছিল। আলু ভাজা, পাউরুটি এসব খেয়ে থাকতে হত। এতো কষ্ট করে আজকে মালা পাল হতে সময় লেগেছে। সেই জায়গাটায় যদি না যেতাম, এতো বিখ্যাত শিল্পী মালা পাল হতে পারতাম না।

প্রঃ মেয়ের হাতেই আরেক মেয়ে তৈরি হচ্ছে, এর জন্যে নিজেকে প্রস্তুত করেছিলেন কিভাবে?

মালা: ছোট ছোট ঠাকুর তো করতামই, কিন্তু এতো জনপ্রিয় হয়ে যাব স্বপ্নেও ভাবি নি। এখন দামি দামি থিম আসছে। এবছর লকডাউনে আমাদের কাজ অনেকটা কম। তাই আমি ছোট ছোট থিমগুলো নিয়ে করতে আরম্ভ করে দিলাম, একটা করতে করতে আরেকটা এলো। এভাবে কিছুটা আমি লকডাউনে মেক-আপ দিতে পারলাম। কিন্তু বড় কাজের অবস্থা খুব খারাপ তাই ছোট নিয়েই চলতে হচ্ছে।

প্রঃ হেঁসেল এবং ব্যবসা ব্যালান্স করেন কিভাবে?\

মালা: দুটোর মধ্যে ব্যালান্স করতে খুব কষ্ট হয়। আজ তুমি এসেছ বললাম ১০ মিনিট বাদে এসো আমরা খাব। তাড়া থাকলে এই সময়টাও দিতে চাই না। হয়তো এক একদিন দুপুর বেলা আমাদের খাওয়া হয়না। সেই সময়টা ইন্টারভিউ দিতেই কেটে যায়। যখন সবাই চলে যায়, তখন খিদেটা মরে যায়, আর খাওয়াটা হয়না। ইচ্ছা করে না।

প্রঃ এবার মায়ের কাছে কি চাইবেন?

মালা: এবার মায়ের কাছে চাইব করোনাটা চলে যাক। এখনো আশাবাদী রয়েছি মা যদি আবার আসে, তাহলে আমরা আবার সবাই জাগব। কুমোরটুলি হাসবে।

সুস্মিতা: চাইব মহামারী দূর হোক, মানুষের কষ্ট চলে যাক, পৃথিবী আবার সুস্থ হয়ে উঠুক। সুস্থ পৃথিবীতে আবার আমরা মাকে ডাকবো, মা এসে আমাদের সকল দুঃখ দূর করে দেবে।

TwitterFacebookWhatsAppEmailShare

ভিডিও

আরও পড়ুন

Decorative Ring
Maa Ashchen