যুবভারতী কান্ড: ৭২ ঘণ্টার মধ্যে নজিরবিহীন পদক্ষেপ, ‘রাজধর্ম’ পালনে কঠোর মুখ্যমন্ত্রী

নিউজ ডেস্ক, দৃষ্টিভঙ্গি, ২১:১৫: গত শনিবার দুপুরে যুবভারতীতে ঘটে যাওয়া নজিরবিহীন বিশৃঙ্খলার ঘটনার ৭২ ঘণ্টার মাথায় প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক স্তরে বড়সড় ঝু্ঁকুনি দিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় (Mamata Banerjee)। পুলিশ ও প্রশাসনের শীর্ষ আধিকারিকদের বিরুদ্ধে কড়া শাস্তিমূলক পদক্ষেপ নেওয়ার পাশাপাশি, মঙ্গলবার রাজ্য রাজনীতিতে আলোড়ন ফেলে দিয়েছে তদন্ত চলাকালীন ক্রীড়া দপ্তরের দায়িত্ব থেকে মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাসের সরে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত।
শনিবারের ঘটনার পর থেকেই প্রশাসনের ওপর চাপ বাড়ছিল। বিরোধীরা অভিযোগ তুলেছিল, সরকার ঘটনাটি ধামাচাপা দিতে চাইছে। কিন্তু মঙ্গলবার সকাল থেকে একের পর এক পদক্ষেপে মুখ্যমন্ত্রী বুঝিয়ে দিলেন, তাঁর সরকার এই ঘটনাকে ‘লঘু’ করে দেখছে না।
রাজ্য সরকারের পদক্ষেপগুলির মধ্যে সবচেয়ে চমকপ্রদ হলো মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাসের চিঠি। নিরপেক্ষ তদন্তের স্বার্থে তিনি ক্রীড়া দপ্তরের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি চেয়ে মুখ্যমন্ত্রীকে চিঠি দিয়েছেন। তৃণমূল কংগ্রেসের গত তিনটি মেয়াদের মধ্যে এই প্রথম কোনও মন্ত্রী কেলেঙ্কারির অভিযোগ ওঠার পর তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত নিজ দপ্তরের দায়িত্ব ছাড়লেন।
তৃণমূল নেতারা এই পদক্ষেপকে ঐতিহাসিক বলে দাবি করেছেন। তাঁদের কথায়, ১৯৮০ সালে ইডেনে ১৬ জন দর্শকের মৃত্যুর সময় মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর হাতেই ছিল স্বরাষ্ট্র ও ক্রীড়া দপ্তর, কিন্তু তিনি পদ ছাড়েননি। একইভাবে ১৯৯৬ সালে ইডেনে বিশ্বকাপ সেমিফাইনাল বন্ধ হয়ে যাওয়ার সময়ও তৎকালীন পুলিশমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নেননি। উত্তরপ্রদেশ বা আইপিএল সংক্রান্ত নানা দুর্ঘটনাতেও বিজেপি বা কংগ্রেস শাসিত রাজ্যে এমন নজির নেই। শাসক দলের এক নেতার দাবি, ‘‘ওরা যা পারেনি, আমরা তা করে দেখিয়েছি। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রকৃত রাজধর্ম পালন করেছেন।’’
প্রাক্তন বিচারপতি অসীম কুমার রায়ের নেতৃত্বাধীন তদন্ত কমিটি গঠনের মাত্র দু’দিনের মধ্যেই মঙ্গলবার সকালে তাদের প্রাথমিক রিপোর্ট পেশ করে এবং বিশেষ তদন্তকারী দল (সিট) গঠনের সুপারিশ করে। এই রিপোর্টের ভিত্তিতেই মুখ্যসচিব মনোজ পন্থ রাজ্য পুলিশের ভারপ্রাপ্ত ডিজি রাজীব কুমার এবং বিধাননগরের পুলিশ কমিশনার মুকেশ কুমারকে শো-কজ নোটিশ পাঠান। পাশাপাশি, বিধাননগর পুলিশের ডিসি অনীশ সরকারের বিরুদ্ধে বিভাগীয় তদন্ত শুরু করে তাঁকে সাসপেন্ড (নিলম্বিত) করা হয়েছে। ক্রীড়া ও যুব বিষয়ক দপ্তরের প্রধান সচিব রাজেশ কুমার সিংহকেও শো-কজ করা হয়েছে।
তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হলো, ডিজি রাজীব কুমার এবং মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস-উভয়েই মুখ্যমন্ত্রীর অত্যন্ত ‘আস্থাভাজন’ বলে পরিচিত। ঘটনার দিন রাজীব কুমার নিজেই ঘটনাস্থলে দাঁড়িয়ে পরিস্থিতির সামাল দিয়েছিলেন। তবুও প্রশাসনিক দায় এড়াতে পারেননি তিনি। রাজনৈতিক মহলের মতে, মুখ্যমন্ত্রী স্পষ্ট বার্তা দিতে চেয়েছেন যে, প্রশাসনিক সিদ্ধান্তে কোনও ব্যক্তিবিশেষ বা ‘ঘনিষ্ঠতা’ বিচার করা হবে না।
শনিবার তদন্ত কমিটি গঠনের পর বিরোধী শিবির কটাক্ষ করে বলেছিল, বিষয়টি ধামাচাপা দিতেই এই ‘লোকদেখানো’ কমিটি। কিন্তু অন্যান্য সরকারি কমিটির মতো দীর্ঘসূত্রিতা না করে, মঙ্গলবার সকালেই কমিটি রিপোর্ট জমা দেওয়ায় বিরোধীদের সেই অভিযোগ ধোপে টেকেনি। মেসি সফরের আয়োজক শতদ্রু দত্তকে গ্রেপ্তার করার পর অভিযোগ উঠেছিল তাঁকে ‘বলির পাঁঠা’ করা হচ্ছে। কিন্তু মঙ্গলবারের পর সেই অভিযোগও নস্যাৎ করে দিয়েছে রাজ্য সরকার। পুলিশকর্তা থেকে মন্ত্রী-সকলকেই জবাবদিহির আওতায় এনে মুখ্যমন্ত্রী প্রমাণ করলেন, প্রশাসন এই ঘটনায় কাউকেই আড়াল করছে না।