ঘুরে আসুন বাংলার জাগ্রত শিব মন্দির থেকে
ফাল্গুন মাসে কৃষ্ণপক্ষের ত্রয়োদশী/চতুর্দশীর রাত্রি হল শিবরাত্রি – ফাল্গুনের এই তিথিটিই সবচেয়ে পবিত্র বলে গণ্য হয়। অনেকে বলেন, এই দিনটিতেই শিব লিঙ্গরূপে প্রথম প্রকাশ পেয়েছিলেন। পুরাণে আছে, এই দিন শিব ও পার্বতীয় বিয়ে হয়েছিল।
বলা হয়, উত্তর গোলার্ধের আকাশে এই দিনটিতে গ্রহ-নক্ষত্রের সংস্থান এমন হয়, যাতে মানুষ তার আধ্যাত্মিক এবং অন্যান্য শক্তি বিশেষ ভাবে জাগ্রত করে তুলতে পারে। শিব নিজে নাকি উমাকে বলেছিলেন, এই তিথি পালন করলে সমস্ত পাপের ফল থেকে নিষ্কৃতি মিলবে এবং মোক্ষলাভ হবে।
জানেন কি, এই বাংলাতে ছড়িয়ে আছে বহু ঐতিহ্যবাহী, জাগ্রত শিব মন্দির? আসুন দেখে নিই এক নজরে
বাবা তারকনাথ মন্দির
দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এই শৈবতীর্থ। হুগলি জেলার এই মন্দিরের ইতিহাস অতি প্রাচীন। স্থানীয় জঙ্গলে এক আশ্চর্য বিষয় লক্ষ্য করা যায়। গরুরা প্রতিদিন জঙ্গলের একটি বিশেষ স্থানে গিয়ে দুধ দিয়ে আসে। সেই স্থানে গিয়ে একটি পাথর দেখতে পান।
এই সময়েই বিষ্ণুদাস নামে এক ব্যক্তি স্বপ্নাদেশ পান যে, জঙ্গলে ওই পাথরটিই মহাদেবের তারকেশ্বর রূপ। সেখানে বিষ্ণুদাস একটি মন্দির নির্মাণ করেন এবং সেই স্থানই তারকেশ্বর ধাম নামে পরিচিত হয়। শোনা যায়, এই তারকেশ্বর মন্দির-সংলগ্ন পুষ্করিণী দুধপুকুরের জল আরোগ্যকারী। মহাশিবরাত্রি ও চৈত্র সংক্রান্তিতে তারকেশ্বর মন্দিরে বিশেষ উৎসব হয়। প্রতি সোমবার হয় বিশেষ পুজো।
বীরভূমের কলেশ্বর-কলেশনাথ
বীরভূমের কলেশ্বর-কলেশনাথ মন্দিরের উচ্চতা একশো ফুটেরও বেশি। ফাল্গুন মাসে শিবচতুর্দশী তিথিতে শৈবতীর্থ কলেশ্বর ধামে শিবরাত্রি ব্রত উৎসব পালন করা হয়। একই সঙ্গে সাত দিন ব্যাপী মেলা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের চল আছে। সাঁইথিয়া শহর থেকে প্রায় বারো মাইল পূর্বে রয়েছে এই মন্দির। ইন্টারনেটে নাম ‘টাইপ’ করা মাত্রই সহজে পাওয়া যায় পথ নির্দেশিকা।
বাঁকুড়ার এক্তেশ্বরের মন্দির
বাঁকুড়ার উপকণ্ঠে অবস্থিত শহর থেকে তিন কিলোমিটার দূরে দ্বারকেশ্বর নদের বাম তীরে অবস্থিত অন্যতম এই শিবমন্দির। মন্দিরের কুণ্ডের মধ্যে যে শিবলিঙ্গটি রয়েছে, সেটি নাকি দেখতে অনেকটা মানুষের পায়ের মতো। এক্তেশ্বরে পাথরের শিব মন্দিরটির উচ্চতা প্রায় ৪৫ ফুট। এটি পশ্চিমমুখী। ল্যাটেরাইট (মাকড়া) প্রস্তর দ্বারা সুন্দর ও সুগঠিত।
বর্ধমানের ১০৮ শিবমন্দির
বর্ধমানের নবাবহাটে ১০৮ শিবমন্দির প্রতিষ্ঠার এক দীর্ঘ ইতিহাস আছে। এই মন্দিরের নির্মাণ শুরু হয়েছিল ১৭৮৮ খ্রিস্টাব্দে। আর শেষ হয়েছিল ১৭৯০ খ্রিস্টাব্দে। জপমালার আদলে ১০৮টি কাঁঠি-সহ জপমালার ‘মেরু’ চিহ্নের মতো অতিরিক্ত আর একটি, অর্থাৎ মোট ১০৯টি স্থাপত্যকে গেঁথে প্রতিষ্ঠিত এই মন্দিরমালা বর্ধমানের এক অনন্য শিল্পকীর্তি।
মন্দিরগুলির অবস্থান যেমন পাশাপাশি, তেমনি প্রতিটি মন্দিরের সামনেই আছে খোলা টানা বারান্দা। প্রতিটি মন্দিরই এক দরজাবিশিষ্ট। আর সব মন্দিরেই বিরাজ করছেন কষ্টিপাথরে নির্মিত গৌরীপট্ট-সহ শিবলিঙ্গ।সবগুলি মন্দিরের সামনে রয়েছে একটি করে বেলগাছ। মন্দিরে প্রবেশের পথ পশ্চিমমুখী।
দার্জিলিং এর মহাকাল শিবমন্দির
দার্জিলিং এর চৌরাস্তা থেকে কয়েক মিনিটের হাঁটা পথে পৌঁছানো যায় মহাকাল মন্দিরে। মূল মন্দিরের সামনে প্রবেশ দ্বারের কাছেই রয়েছে শিবের বাহন নন্দীর মূর্তি। গোলাকার মন্দিরের মাঝখানে শিবলিঙ্গ ও বুদ্ধ মূর্তির সাথে হিন্দুদের ব্রাহ্মন পুরোহিত ও বৌদ্ধদের সন্যাসীকে একসাথে নিজ নিজ আরাধ্য ভগবানের অর্চনা করতে দেখা যায়।
শোনা যায় ঐ জায়গাটি কোনো এক সময় সিকিমের রাজারদের অধীনে থাকার সময় সেখানে বৌদ্ধদের আশ্রম ছিল। বৌদ্ধ সন্যাসীরা এই জায়গার নামকরন করেছেন ‘দোর্জে’ ও ‘লিং’ দুটি শব্দ থেকে যার অর্থ বজ্রের দেশ।
জয়ন্তি মহাকাল শিবমন্দির
ডুয়ার্সের অঘোষিত সাংস্কৃতিক রাজধানী তথা নতুন জেলা আলিপুরদুয়ার। সেখান থেকে মাত্র ৩০ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত জয়ন্তির পাহাড়ি গ্রাম।আর সেখান থেকে মাত্র ৭ কিলোমিটার দূরত্বে পাশের দেশ ভুটানের এক অজানা পাহাড়ের কোলে অবস্থিত জয়ন্তি মহাকাল। তিনটি গুহার মধ্যেই রয়েছে এই মন্দির। এই তিন গুহার দ্বিতীয়টিতে শিব বিরাজমান।
স্থানীয় মানুষদের মতে মহাদেব শিব নিজেই নিজের মূর্তি বানিয়ে এই গুহায় স্থাপন করেছেন। পাহাড়ের গুহায় স্থিত স্ট্যালাক্টাইট শিলাখণ্ড অবিকল শিব মূর্তির আকার ধারণ করেছে। এই গুহায় প্রবেশের পথটাও কিন্তু সহজ নয়। প্রথমে মই বেয়ে উঠতে হবে অন্তত ২০ ফুট। তার পরে সংকীর্ণ পাথরের ফোকরের মধ্যে দিয়ে কোনওমতে পৌঁছনো যাবে মূল গুহাতে (মন্দিরে)।
বড় কাছাড়ি মন্দির
দক্ষিন ২৪ পরগণার দ্বিতীয় বৃহত্তম তীর্থ বহু দূরদুরান্ত থেকে মানুষরা আসেন বাবা বড় কাছারির কাছে পূজো দিতে ভক্তরা এক ছোট কাগজের দরখাস্তে নিজেদের মনষ্কামনা লিখে বেঁধে দেন মন্দিরের গায়ে।
জপেশ্বর মন্দির
বীরভূম জেলার কীর্ণাহারে অবস্থিত এই মন্দির শিবরাত্রি উপলক্ষে এখানে অসংখ্য ভক্তদের সমাগম হয় অনেকেই বিশ্বাস করেন, মহাজাগ্রত বাবার কাছে পুণ্যর্থীদের করা মনস্কামনা পূর্ণ হয়ে যায় অলৌকিকভাবে।
জল্পেশ্বর মন্দির
জলপাইগুড়ি জেলার ময়নাগুড়িতে অবস্থিত এই মন্দির এখানকার শিবলিঙ্গ টি মাটির নিচে অবস্থিত বর্ষার সময় এই শিবলিঙ্গ প্রাকৃতিক জলে ডুবে থাকে এখানকার শ্রাবণী মেলা এবং শিবরাত্রির মেলা বিখ্যাত।
জটিলেশ্বর মন্দির
জলপাইগুড়ি জেলার ময়নাগুড়িতে অবস্থিত এই মন্দির প্রচলিত ধারণা এই মন্দিরটি তৈরি হয় গুপ্ত সাম্রাজ্যের যুগে জটা-জুট ধারী শিবকে উৎসর্গ করা হয়েছে এই মন্দির মন্দিরের দেওয়াল অন্যান্য দেবদেবীর কারুকার্যে শোভিত।