ঐতিহ্যের টালা – ধূসর স্মৃতির আড়ালে
টালা’ কলকাতার অন্যতম প্রাচীন এক স্থান। ১৬৯০ সালের ২৪ আগস্ট জব চার্নক নেমেছিলেন সুতানুটিতে। ১৬৯৩ সালের ১০ জানুয়ারি তিনি মারা যান। অর্থাৎ তিনি সুতানুটিতে ছিলেন জীবনের শেষ আড়াই বছর। তাঁর মৃত্যুর প্রায় পাঁচ বছর পরে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সাবর্ণ চৌধুরীদের কাছ থেকে গোবিন্দপুর, কলকাতা ও সুতানুটি গ্রাম তিনটির জমিদারি স্বত্ব কিনে নেয়। তবে এর মধ্যে টালা ছিল না।
পলাশি যুদ্ধের পর ব্রিটিশদের প্রভাব-প্রতিপত্তি বৃদ্ধি হল। ব্যবসা-বাণিজ্য ফুলে ফেঁপে উঠতে শুরু করল। সঙ্গী হিসেবে বাঙালী এবং অন্যান্য জাতির লোকজন প্রচুর কাজকর্ম শুরু করলেন। গোটা অঞ্চলে কর্মসংস্থানের জোয়ার এল। মানুষ বাড়ায় স্থান সংকুলানের জন্য তাঁরা ছড়িয়ে গেলেন আশপাশের অন্যান্য গ্রামে। কোম্পানি মোট ৫৫টি গ্রামকে শহরতলির স্বীকৃতি দিল। নাম রাখল ‘এস্টেট অব পঞ্চান্ন গ্রাম’।
গোবিন্দপুর, কলকাতা ও সুতানুটি-এই তিনটি গ্রামকে চাকার মতো ঘিরে ছিল ওই ৫৫টি গ্রাম। উত্তরে গঙ্গার ধারে ডিহি সিঁথি থেকে শুরু করে চিৎপুর। তারপর পূর্ব দিকে এগিয়ে এবং দক্ষিণ দিকে ঘুরে বাগজোলা, দক্ষিণ পাইকপাড়া, উল্টোডাঙা, বাহির-সিমলা, শুঁড়া, কুলিয়া, শিয়ালদহ, এন্টালি, তপসিয়া, শ্রীরামপুর, চক্রবেড়িয়া, ভবানীপুর হয়ে মনোহরপুর (যাকে এখন আমরা মনোহরপুকুর বলে থাকি) হয়ে আদিগঙ্গার ধারে এই ৫৫টি গ্রাম শেষ হয়েছে।
যে এলাকাগুলির নাম বললাম, সেগুলি ছিল এক একটা ডিহি, অর্থাৎ রাজস্ব সংগ্রহের কেন্দ্র। প্রত্যেকটি ডিহির অধীনে ছিল একাধিক গ্রাম। ডিহি চিৎপুরের মধ্যে ছিল চারটি গ্রাম – চিৎপুর, বীরপাড়া, টালা এবং কেলেদা। কেলেদার পরবর্তীকালে আদুরে নাম হয় কালিন্দী। টালা কখনওই পুরনো কলকাতার অঙ্গ ছিল না। ছিল পুরনো কলকাতার শহরতলির সদস্য। ফলে টালা কখনওই বর্ধিষ্ণু ছিল না। কিন্তু এই টালাতে অষ্টাদশ শতকে বড় বড় জমিদার বা প্রভাবশালী ব্যক্তিদের বিরাট বসতবাড়ি ও বাগানবাড়ি ছিল।
পলাশির যুদ্ধের পরই টালার নাম পাওয়া গিয়েছিল। অষ্টাদশ শতকের গোড়ার দিকে বা তারও আগে টালার নাম শোনা গিয়েছে। একইসঙ্গে এও বলা উচিত, একটা প্রাচীন দলিল অনুযায়ী, গ্রামকে টালা নয়, ‘তালা’ বলা হয়েছে। প্রাচীন গ্রামবাংলায় ‘তালা’ বলে অনেক গ্রাম রয়েছে। যেমন কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের পূর্বপুরুষরা সাগরদাঁড়ির আগে যশোরের তালা গ্রামে থাকতেন। ‘তালা’ নামের অর্থ যেখানে অনেক তালগাছ রয়েছে। সেখান থেকে তালা শব্দটি উঠে এসেছে। ইংরেজি উচ্চরণের ঠেলায় তালা শব্দটি টালা হয়ে গিয়েছে।
এবার আসি টালা সেতুর প্রসঙ্গে। চিৎপুর রেল ইয়ার্ডের উপরে তৈরী হয় এই সেতু। যখন সেতু তৈরী হয়নি, তখন রেললাইন পেরতে হতো বাসিন্দাদের। দু’ধারে দু’টি রেলগেট ছিল। সেগুলির দায়িত্বে ছিলেন দু’জন গেটম্যান। পাইকপাড়া রাজবংশের কুমার ইন্দ্রচন্দ্র সিংহ ছিলেন দারুণ বিলাসী এবং শৌখিন। প্রতিদিন বিকেলে তিনি চার ঘোড়া বিশিষ্ট চৌঘুড়ি গাড়িতে চেপে ময়দানে হাওয়া খেতে যেতেন। কিন্তু লেভেল ক্রসিংয়ে আটকে গেলে মেজাজ হারিয়ে ফেলতেন তিনি। আর রোষের মুখে পড়তেন গেটম্যানরা। ঘোড়ার চাবুকের ঘা পড়ত তাঁদের পিঠে। তাই তাঁর গাড়ির আওয়াজ পেলেই গেটম্যানরা লেভেল ক্রসিং খুলে দিয়ে ভয়ে পালিয়ে যেতেন। একদিন এমনই কারণে দুর্ঘটনায় পড়ল ইন্দ্রচন্দ্রের চৌঘুড়ি। ফাঁকা মালগাড়ির ধাক্কায় তাঁর গাড়ির সামনের দু’টি ঘোড়া কাটা পড়ে। সেগুলিকে পরে কবর দেওয়ার নির্দেশ দিয়ে বাকি দু’টি ঘোড়াকে নিয়ে অবিচল মনোভাবে চলে যান কুমারসাহেব।
কিন্তু কোম্পানি বিষয়টি হালকাভাবে নেয়নি। চাবুকের ভয়ে গেট খুলে রাখার বিষয়টি কোম্পানি লাটবাহাদুরকে জানাল। লাটবাহাদুর ইন্দ্রচন্দ্রের ওই কাণ্ডকে ‘র্যাশ অ্যাক্ট’ বা দুঃসাহসিক কাজ বলে কটাক্ষ করলেন। এতেই ক্ষিপ্ত হয়ে যান কুমারসাহেব। মেজাজি ইন্দ্রচন্দ্র সঙ্গে সঙ্গে রেললাইনের উপরে সেতু তৈরী করার জন ১০ হাজার টাকা চাঁদা দেন। রেললাইনের উপর দিয়ে তৈরী হয়ে গেল আস্ত একটি সেতু। সেই সেতু দিয়েই কুমারসাহেব মনের আনন্দে চৌঘুড়ি চেপে হাওয়া খেতে যেতেন। কোম্পানিও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল।
একটি কোড়া বা চাবুকের জন্য সেতুটি তৈরী হওয়ায় সেটিকে দীর্ঘদিন ধরে প্রবীণ-বৃদ্ধরা ‘এক কোড়ার পুল’ বলতেন। পরে সেটির নাম হল টালা সেতু। আবার এই সেতু দিয়েই টিটাগড়-কামারহাটি এলাকার বিহারি সম্প্রদায়ের মানুষ গোরু পারাপার করতেন। তাই কেউ কেউ বলতেন, ‘কাউ ক্রসিং ব্রিজ’। জনসাধারণের জন্য এই সেতু খুলে দেওয়া হয় ১৯৩৬ সালে। পরবর্তীকালে শ্যামপুকুর রাজবাড়ির সামনে খুন হওয়া ফরওয়ার্ড ব্লক নেতা হেমন্ত কুমার বসুকে শ্রদ্ধা জানাতে ১৯৭৩ সালের ৫ অক্টোবর ওই সেতুর নামকরণ হয় হেমন্ত বসু সেতু।
বিশ শতকের পঞ্চাশের দশকের শেষ দিকে বা ষাটের দশকের গোড়ায় একটি ডবল ডেকার বাস সেতুর রেলিং ভেঙে নীচে পড়ে যায়। তখন ওই সেতু সংস্কার এবং সম্প্রসারণ করে ১৯৬৪ সালে জনসাধারণের জন্য খুলে দেওয়া হয়। অর্থাৎ এখন আমরা যে সেতু দেখি, তার বয়স ৫৬ বছর। মানুষ তো ৫৮ বা ৬০ বছর বয়সে কর্মজীবন থেকে অবসর নেয়। আমাদের টালা সেতুও অবসর নিল ৫৬ বছর বয়সে।