কূটনৈতিকভাবে বাংলাদেশকে প্রতিষ্ঠা করছিলেন প্রণববাবু
প্রয়াত ভারতরত্ন প্রণব মুখোপাধ্যায়। প্রাক্তন রাষ্ট্রপতির প্রয়াণে আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক মহল শোকস্তব্ধ। কিন্তু স্বজনহারা বেদনা বাংলাদেশে। ময়ুরাক্ষী ও লাল মাটির ছোট্টখাট্টো মানব বিশ্বজনীন ছায়া বিস্তার করেছিলেন। মৃত্যু নিশ্চিত। তার পরে থেকে যায় কিছু কাহিনি।
প্রণববাবুর তৈরি এই কাহিনিতে মিশে থাকে বাংলাদেশ আর বাংলাভাষীদের অদম্য সংগ্রামে পাক শাসন থেকে মুক্তির কথা। জীবদ্দশায় বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু, প্রয়াণের পরেও থাকবেন। ভারতের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতির কূটনৈতিক লড়াই বাংলাদেশকে বিশ্বের দরবারে অবস্থান পোক্ত করতে ভূমিকা নিয়েছিল।
১৯৭১ সাল জল জমির সবুজ ভূখণ্ড তখন রক্তাক্ত। চলছিল মুক্তিযুদ্ধ। আর এসব থেকে অনেক দূরে থেকে দিল্লিতে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী যে কূটনৈতিক লড়াই শুরু করেছিলেন, তার সুযোগ্য সেনাপতি প্রণববাবু।
আত্মজীবনীমূলক বইয়ের প্রথমটি ‘দ্য ড্রামাটিক ডিকেড : দ্য ইন্দিরা গান্ধী ইয়ারস’ এ তিনি একটি পুরো অধ্যায়ই লিখেছেন ‘মুক্তিযুদ্ধ : দ্য মেকিং অব বাংলাদেশ’ নামে। এখানেই ধরা রয়েছে পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বাংলাদেশ তৈরি পর্বে কূটনৈতিক ভূমিকা। মুক্তিযুদ্ধে প্রণববাবুর ভূমিকা কেমন তা জানা যায় এই বই থেকে।
‘বাংলাদেশ প্রতিদিন’ জানাচ্ছে- “প্রণব মুখার্জি তখনো ইন্দিরা গান্ধীর দলে যোগ দেননি। বাংলা কংগ্রেসের প্রতিনিধি হিসেবে রাজ্যসভার সদস্য ছিলেন।” মুক্তিযুদ্ধে নিজের অবস্থান ব্যাখ্যা করতে গিয়ে প্রণববাবু
লিখেছেন, ‘১৫ জুন বাজেট অধিবেশন চলাকালে আমি রাজ্যসভায় বাংলাদেশ সমস্যা নিয়ে আলোচনার উদ্যোগ নিই। আমি বলেছিলাম, ভারতের উচিত বাংলাদেশের প্রবাসী মুজিবনগর সরকারকে অবিলম্বে স্বীকৃতি দেওয়া। একজন সদস্য জানতে চান, কীভাবে এই সমস্যার সমাধান হতে পারে।
উত্তরে আমি জানাই, গণতান্ত্রিক ও সার্বভৌম বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার মাধ্যমেই এর রাজনৈতিক সমাধান সম্ভব। রাজনৈতিক সমাধান মানে গণতান্ত্রিক ও সার্বভৌম বাংলাদেশকে বস্তুগত সহায়তা করা। আমি সংসদকে এটাও স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলাম যে, বিশ্ব ইতিহাসে এ ধরনের ঘটনায় হস্তক্ষেপ করার বহু নজির আছে।’
ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে প্রণব মুখার্জির রাজনৈতিক সম্পর্কও গড়ে ওঠে এই মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে। তিনি লিখেছেন, ‘সে সময় থেকেই ইন্দিরা গান্ধী আমাকে গুরুত্ব দিতে শুরু করেন। ১৯৭১-এর সেপ্টেম্বরে আমাকে প্রথম আন্তঃ সংসদীয় ইউনিয়নের বৈঠকে ভারতীয় প্রতিনিধিদলের সদস্য মনোনীত করেন।
সেই বৈঠকে আমাদের কাজ ছিল প্রতিটি দেশের প্রতিনিধিদের কাছে বাংলাদেশের পরিস্থিতি এবং ভারতের অবস্থান বিস্তারিত ব্যাখ্যা করা, যাতে তারা যে যার দেশে ফিরে গিয়ে নিজেদের সরকারকে বিষয়টি অবহিত করতে পারেন। হতে পারে এই বৈঠকে আমার ভূমিকার কথা প্রধানমন্ত্রীর কানে পৌঁছেছিল এবং তিনি খুশি হয়েছিলেন।
কেননা, এরপর একই দায়িত্ব দিয়ে তিনি আমাকে ইংল্যান্ড ও জার্মানি পাঠান।’ প্রণববাবু ১৯৭২ সালে জাতীয় কংগ্রেসে যোগ দেন এবং ১৯৭৬ সালে ইন্দিরা মন্ত্রিসভার সদস্য হন। শুধু মুক্তিযুদ্ধে বিশ্বের বুকে বাংলাদেশের নিপীড়িত মানুষের পক্ষে জনমত গঠনেই নয়, তাঁঁর সক্রিয় ভূমিকা ছিল পরবর্তী সময়েও।
১৯৭৫ সালে সেনাবাহিনির একটি অভ্যুত্থানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরবারে খুন করা হয়। সেই হত্যাকাণ্ডের পর মুজিব কন্যা শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা ও তাঁর পরিবারকে আগলে রেখেছিলেন প্রণববাবু।
বাংলাদেশের রাজনীতি ও গণতন্ত্রের প্রতিটি ইতিহাসে তাঁর স্ত্রী শুভ্রা মুখোপাধ্যায়ের পৈত্রিক ভিটে বাংলাদেশের নড়াইলে। সেই সূত্রে তিনি বাংলাদেশের জামাই। ইতিহাস এভাবেই ধরা থাকবে পদ্মা করতোয়া সুরমা নদী বিধৌত বাংলাদেশের সঙ্গে।