সরলা দেবী চৌধুরানী – সমাজে নারীদের প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী
ঊনবিংশ এবং বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধ্বে বাংলার নারীদের পথচলা মসৃণ ছিল না। পুরুষের সাহচর্য ও পরিচয়ে তৈরি হয়েছিল তাদের পরিচয়। পারিবারিক নিরাপত্তার ঘেরাটোপেই একটা সীমিত জায়গা তৈরি করে চলছিল তাদের জীবন। তার কারণ মেয়েদের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা, তাদের পেশা নিয়ে নারী স্বাধীনতার আন্দোলনরত পুরুষেরাও সেই সময়ে চিন্তা করেনি।
তবে, কিছু নারী নিজেরাই এগিয়ে এসে তৈরি করেছিলেন আত্মপরিচয়। নারীদের এই এগিয়ে আসায় অগ্রগণ্য উদাহরণ রেখেছিলেন কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়ির কিছু নারী। সেরকমই একজন ছিলেন সরলা দেবী চৌধুরানী।
জন্ম মামাবাড়ি জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে ১৮৭২ সালের ৯ই সেপ্টেম্বর। মা স্বর্ণকুমারী ছিলেন সে যুগের সফলতম লেখিকাদের একজন। বাবা জানকীনাথ ঘোষালও ছিলেন স্বাধীন ও মুক্তমনের মানুষ। সরলার শৈশব কাটে জোড়াসাঁকোয় মামাবাড়িতে। আরো অনেক মামাত, মাসতুতো ভাই, বোনেদের সাথে মিলে এক উৎকৃষ্ট সাংস্কৃতিক, সাহিত্যিক পরিবেশে। সকলের প্রিয় ‘রবি মামা’ বাড়ির সব সৃষ্টিশীলতার কেন্দ্রবিন্দু।
সরলা প্রথম নজরে পড়লেন তের বছর বয়সে এন্ট্রান্স পরীক্ষা দিয়ে যখন বেথুন কলেজে ঢুকলেন। ওই পরিবারে মেয়েদের এই প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় বসার ক্ষেত্রেও তিনি ব্যতিক্রম। এন্ট্রান্সে ইতিহাসে তিনি মেয়েদের মধ্যে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়েছিলেন। এর পরে বেথুন কলেজ থেকে ইংরেজিতে সাম্মানিক নিয়ে বিএ পাশ করলেন মাত্র আঠার বছর বয়েসে। পেলেন পদ্মাবতী স্বর্ণপদক। মেয়েদের মধ্যে এই পদক তিনিই প্রথম পেয়েছিলেন।
সরলার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কৃতিত্ব জীবিকা অর্জনের কথা ভাবা। এর আগে মেয়েরা যতই বিলেতে যান, গাড়ি চালান, লেখালেখি করুন আর কঠিন পরীক্ষায় বসার কথা ভাবুন, জীবিকা অর্জনের কথা তাদের চিন্তায় স্থান পেত না তেমনভাবে। ঠাকুরবাড়ির সর্বময় কর্তা দেবেন্দ্রনাথও সরলার স্বাধীন সত্তায় বাধা দিতে পারেননি।
দক্ষিণ ভারত ভ্রমণের সময় সরলার সঙ্গে দেখা হয়ে যায় মহীশূরের দেওয়ান নরসিংহ আয়েঙ্গারের। সরলার ব্যক্তিত্ব ও কথাবার্তায় মুগ্ধ হয়ে তিনি তাকে মহীশূরের মহারানী গার্লস কলেজে সুপারিন্টেনডেন্টের পদে আহ্বান জানান। সরলা সাগ্রহে গ্রহণ করেন সেই চাকরি। অতদূরে চাকরি করতে যাওয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল ঠাকুরবাড়ির অনেকেই। গ্রাহ্য করেননি কিছু কোনোদিন। যেটা করতে চেয়েছেন, সেটাই করেছেন।
মায়ের সম্পাদিত ‘ভারতী’ পত্রিকার সঙ্গে সরলা ও তাঁর বোন হিরন্ময়ী যুক্ত ছিলেন সেই বালিকা বয়েস থেকে। তারপর এলো পত্রিকা সম্পাদনার দায়িত্ব। ‘ভারতী’ যে শুধুই ঠাকুরবাড়ির পত্রিকা হয়ে থাকেনি এই কৃতিত্ব সরলার। ‘ভারতী’তেই আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের, তাঁর ‘বড়দিদি’ গল্পের মাধ্যমে।
লেখকদের পারিশ্রমিক দেবার প্রচলনও তিনি শুরু করেছিলেন। ‘ভারতী’র জন্যে প্রায় জোর করে রবীন্দ্রনাথকে দিয়ে লিখিয়ে নিয়েছিলেন ‘চিরকুমার সভা’। ‘ভারতী’ তাঁর এতটাই ভালোবাসার জায়গা ছিল যে পরে পাঞ্জাবে চলে গেলেও সম্পাদনা ও পরিচালনের জন্যে তিনি কলকাতায় ছুটে আসতেন।
শিল্প, সাহিত্যের নানা দিকে নারীরা তখন নিজেদের মেলে ধরলেও, সক্রিয় রাজনীতিতে তাদের দেখা যেত না। স্বদেশিয়ানায় উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন সরলা। জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে বাঙালি যুবকদের একত্রিত করে শুরু করলেন ‘বীরাষ্টমী’ ব্রত, পরের বছর ‘শিবাজী উৎসব’ ও ‘প্রতাপাদিত্য’ উৎসব। সাহসিকতা ও তেজস্বিতা ছিল তার খুব পছন্দের। স্বদেশি বস্ত্র বিক্রির জন্যে মানিকতলায় খুললেন ‘লক্ষ্মীর ভাণ্ডার’। এই হস্তশিল্পের কাজে নিয়োগ করলেন দুস্থ বিধবাদের। পরবর্তীকালে দুস্থ বাঙালি নারীদের অর্থ রোজগারের জন্যে তিনি কৃষ্ণভামিনী দাসের প্রতিষ্ঠিত ‘ভারত স্ত্রী মহামণ্ডল’-এর সঙ্গেও বিশেষভাবে যুক্ত হন।
নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্বের জোরে সমাজে নারীদের প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা নিয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন তিনি।