বিবিধ বিভাগে ফিরে যান

বাংলা বর্ণমালায় সংস্কারের জনক বিদ্যাসাগর

September 26, 2020 | 3 min read

বাংলা বর্ণমালা এবং বাংলা ভাষার সংস্কারে গদ্যের জনক বিদ্যাসাগরের অবদান অপরিসীম। বাংলা গদ্যে প্রথম যতিচিহ্নের প্রচলন করেন বিদ্যাসাগর। শুধু তাই ন বিরামচিহ্নেরও? প্রাচীন কালে বাংলা গদ্য এবং পদ্যে বিরাম চিহ্ন ছিল কেবল মাত্র দুটি, এক দাঁড়ি (।), ও দুই দাঁড়ি (।।)। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ইংরেজি ভাষার অনুকরণে বিরাম চিহ্নগুলোর প্রচলন করেন বাংলা ভাষায়। 

বাংলায় বিদ্যাসাগর ‘য়’ বর্ণ প্রচলন ১৮৪৭ সালে। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর তখন সংস্কৃত কলেজের অধ্যাপক ।১৮৪৭ সালে তিনি সংস্কৃত কলেজের অধ্যাপনা ছেড়ে বাংলা বর্ণমালা সংস্কারের উদ্যোগ নেন। ১৮৫৫ সালে “বর্ণপরিচয়” বইটি অংশে প্রকাশিত হয়। সংস্কৃতের বেড়া ভেঙে বাংলা বর্ণমালার সংস্কার সাধন করেন। সংস্কৃত ভাষায় ‘য়’ বর্ণ নেই। বাংলায় আগে ‘য়’ বর্ণ ছিল না। এটি ঈশ্বরচন্দ্রের আবিষ্কার। বিদ্যাসাগর ‘য’ বর্ণের নিচে বিন্দু বসিয়ে ‘য়’ বর্ণ প্রচলন করেন।

উচ্চারণ গত ভাবে ‘য’ বর্ণের আসল উচ্চারণ হল ‘ইঅ’। সংস্কৃত থেকে প্রাকৃত তার পর বাংলা যখন হল তখন প্রাকৃত থাকতেই ‘য’ ধ্বনির উচ্চারণ ছিল ‘জ’ ধ্বনির বা ইংরেজি j (জে) র মত। আসলে বাংলা ‘য’ ধ্বনির উচ্চারণ ‘জ’ ধ্বনির মত ।যেমন, ‘যক্ষ’ উচ্চারণ ‘জোকখো’ ‘যত'<>’জতো’, ‘যুগ'<>’জুগ’। কিন্তু য-এর আসল উচ্চারণ তো ‘ইঅ’, ইংরেজির y(ওয়াই) এর সমান।

বাংলা ‘য-ফলার’ মধ্যে সে উচ্চারণটি এখনো কিছুটা আছে। যেমন: কাব্য,(য-ফলা) বাক্য(য-ফলা), সাম্য (য-ফলা)। এখানে তো ‘য-ফলার’ উচ্চারণ ‘জ-ধ্বনির’ মতো হচ্ছে না। তাহলে তো এগুলোকে পড়তে হত ‘কাব্‌জ’ ‘বাক্‌জ’ ‘সাম্‌জ’ এভাবে। কিন্তু সে ভাবে তো পড়া হয় না। আর হিন্দির ক্ষেত্রে এই পার্থক্য খুব ভালো ভাবে বোঝা যায়। 

আমরা যখন বাংলায় বলি ‘কন্যা’ তখন হিন্দি উচ্চারণে বলা হয় ‘কন্ইয়া’ বাংলায় ‘গদ্য’ কিন্তু হ হিন্দি উচ্চারণে ‘গদ্ইয়’ বাংলাতে ‘অভ্যাস’ বললেও হিন্দিতে বলি ‘অভ্ইয়াস’ সংস্কৃতের “य” বর্ণটি বাংলায় “য” হরফ দিয়ে লেখা হত, কিন্তু শব্দে অবস্থানভেদে এর উচ্চারণ “জ” (j) ধ্বনি কিংবা “ইঅ”-এর মতো উচ্চারিত হত। 

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বাংলায় ‘য়’ বর্ণ প্রচলন করার পূর্বে শব্দের মাঝে ও অন্তে অন্তঃস্থ য দিয়ে ‘ইঅ’ উচ্চারণ হত।যেমন এখন আমরা লিখি ‘সময়’ আগে লেখা হত’সময’কিন্তু উচ্চারণ হত সময়।সংস্কৃত ও হিন্দি ভাষা লেখা হয় দেবনাগরী লিপিতে। এই বর্ণমালায় ‘য়’ নেই।যেমন বাংলায় আমরা লিখি ‘নয়ন’। হিন্দিতে অন্তঃস্থ য দিয়ে লেখে, नयन<> নয়ন। আমাদেরও ‘য়’ যখন ছিল না তখন এই সমস্যা দূর করার জন্য বিদ্যাসাগর ‘য’-এর নিচে বিন্দু বা ফুটকি দিয়ে ‘য়’ বর্ণ প্রচলন করেন।

‘বিয়োগ’ শব্দের মাঝের ‘য়’আসলে অন্তঃস্থ ‘য’।যেমন বি+যোগ= বিয়োগ। বাংলা শব্দ উচ্চারণকালে ‘য়’ বর্ণটি যে স্বরবর্ণের সঙ্গে যুক্ত থাকে তার উচ্চারণ প্রাপ্ত হয়। যেমন: য়্+অ= য়; উচ্চারণে অ। যেমন সময়, বিষয় ইত্যাদি। আবার, য়্+আ= য়া, উচ্চারণে আ, যেমন দয়া। য়্+ই= য়ি, উচ্চারণে ই; যেমন দয়িত; এভাবে, য়্+ঈ= য়ী, যেমন জয়ী, য়্+উ= য়ু, যেমন বায়ু।সেখানে ‘য’ এর উচ্চারণ হয় ইঅ ইংরেজিতে y. যেমন বাংলায় আমরা বলি, যুবরাজ, হিন্দিতে বলে Yubaraj, আমরা বলি যাদব, হিন্দিতে Yadab. এভাবে যামিনী<>Yamini, যোগী<>Yogi, যদু<>Yadu, যশ<>Yash.

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বাংলা বর্ণমালায় আরও অনেক সংস্কার করেন।যেমন। ‘য়’ বর্ণটি যেমন তিনি প্রচলন করেন, তেমনি ‘ড়’ আর ‘ঢ়’ বর্ণ দুটিও প্রচলন করেন।।এর আগে এ ধ্বনিদুটোর উচ্চারণ ছিল না তখন শব্দের মাঝে ও শেষে হলে ‘ড’ ও ‘ঢ’ লেখা হত। যেমন ‘কড়ি’ শব্দটি আগে লেখা হত ‘কডি’ কিন্তু উচ্চারণ হত কড়ি। 

তেমনি ‘আষাঢ়<> ‘আষাঢ’, কিন্তু উচ্চারণ হত আষাঢ়। বিদ্যাসাগর এই সমস্যা দূর করার জন্য ‘ড’এবং ‘ঢ’-এর নিচে ‘ফুটকি’ দিয়ে প্রচলন করেন ড় এবং ঢ় বর্ণের। বাংলা বর্ণমালার জন্য অনেক সংস্কার করেন আর — এই জন্যই তো তিনি বিদ্যাসাগর। আরও আছে। সংস্কৃত স্বরবর্ণমালায় ‘অনুস্বার’ ‘বিসর্গ’ ‘চন্দ্রবিন্দু’ ছিল। এসব যেহেতু ‘ব্যঞ্জনবর্ণ’ তাই বিদ্যাসাগর বাংলা বর্ণমালায় এদের ব্যঞ্জনবর্ণে অন্তর্ভুক্ত করেন। 

এছাড়া স্বরবর্ণে আগে আরও কিছু বর্ণ ছিল। যেমন “দীর্ঘ-ৠ” এবং “দীর্ঘ-৯”।  বিদ্যাসাগর এ দুটি বর্ণ বর্জন করেন। এছাড়া স্বরবর্ণে “ঌ” (উচ্চারণ লি) বর্ণ ছিল। ‘লি’ দিয়ে শব্দের ব্যবহারের ক্ষেত্রে- যেমন লিচু ফলটিকে লেখা যায় ঌচু (ঌ=লি)। যদিও বিদ্যাসাগর এই ‘লি’ বর্ণটি নিয়ে কিছু বলেননি। এখন এটি অকেজো হয়ে হয়ে বাংলা বর্ণমালা থেকে হারিয়ে গিয়েছে। বর্ণমালাকে হাতে ধরে দাঁড় করিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে বিদ্যাসাগরের ভুমিকা অনন্য সাধারণ।

TwitterFacebookWhatsAppEmailShare

#Ishwar Chandra Vidyasagar

আরো দেখুন