বিবিধ বিভাগে ফিরে যান

একাধিকবার নোবেলের জন্যে মনোনীত হয়েও সে পুরস্কার পাওয়া হয়নি মেঘনাদ সাহার 

October 6, 2020 | 3 min read

১৯৩০ সালে ভারতীয় পদার্থবিজ্ঞানী দেবেন্দ্র মোহন বসু এবং শিশির কুমার মিত্র মেঘনাদ সাহাকে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কারের জন্য মনোনীত করেন। নোবেল কমিটি মেঘনাদ সাহার কাজকে পদার্থবিজ্ঞানের একটি উল্ল্যেখযোগ্য প্রয়োগ হিসেবে বিবেচনা করলেও এটি “আবিষ্কার” নয় বলে তিনি নোবেল পুরস্কার পান নি। 

মেঘনাদ সাহাকে ১৯৩৭ সালে এবং ১৯৪০ সালে আর্থার কম্পটন এবং ১৯৩৯, ১৯৫১ ও ১৯৫৫ সালে শিশির কুমার মিত্র আবারো মনোনীত করলেও নোবেল কমিটি তাদের সিদ্ধান্তে অনড় থাকে ৷

এই জ্যোতির্পদার্থবিজ্ঞানী পদার্থবিজ্ঞানে তাপীয় আয়নীকরণ তত্ত্বের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে খ্যাত। তাঁর আবিষ্কৃত সাহা আয়নীভবন সমীকরণ নক্ষত্রের রাসায়নিক ও ভৌত ধর্মাবলি ব্যাখ্যায় ব্যবহৃত হয়।

ছোটবেলা থেকেই রীতীমতো আর্থিক অনটেনর মধ্যে তাঁকে মানুষ হতে হয়েছিল। গ্রামের টোলে মেঘনাদের পড়ালেখার সূচনা হয়। গ্রামটিতে তৃতীয় শ্রেণির উপরে পড়ালেখার কোনও সুযোগ ছিল না৷ কিন্তু মেঘনাদের ইতিহাস আর গণিতের সাফল্যে তার শিক্ষকেরা তাকে একটি ইংরেজি স্কুলে পাঠানোর সুপারিশ করেন এবং গ্রামের মানুষের সহায়তায় তা হয়।

এরপর তিনি প্রাথমিক পরীক্ষায় তৎকালীন ঢাকা জেলার মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করায়, সে সময় মাসিক ৪ টাকার সরকারি বৃত্তি পান, বৃত্তির টাকা ও বাড়ি থেকে পাঠানো পাঁচ টাকা নিয়ে তিনি ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তির উদ্দেশ্যে ঢাকায় আসেন এবং ভর্তি হন। এরপর বৈশ্য সমিতির মাসিক দুই টাকা বৃত্তিও তিনি লাভ করেন।

এদিকে সেই সময় বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন চলছিল। ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলে পূর্ব বাংলার গভর্নর স্যার বামফিল্ড ফুলার আসবেন শুনে বিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী তার সম্মুখে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী মিছিল করবে মনস্থির করে। সে মিছিলে মেঘনাদও যোগ দেন। ফলে পরদিন তাঁকে স্বদেশী আন্দোলন এ জড়িত থাকার জন্য ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলে ছাড়তে বাধ্য করা হয়। পাশাপাশি তাঁর  সরকারী বৃত্তিও বাতিল করা হয়। 

পার্শ্ববর্তী কিশোরীলাল জুবিলি হাই স্কুলের একজন শিক্ষক স্বঃপ্রণোদিত হয়ে মেঘনাদকে তাদের স্কুলে ভর্তি ও বিনাবেতনে অধ্যয়নের ব্যবস্থা করেন। পরবর্তীতে তিনি কলকাতা প্রেসিডেন্সী কলেজে পড়াশোনা করেন। সহপাঠি হিসেবে সত্যেন্দ্রনাথ বসু ও উপরের শ্রেণির প্রশান্ত চন্দ্র মহালনবিশ, আচার্য হিসেবে জগদীশ চন্দ্র বসু ও আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের সান্নিধ্য লাভ করেন। ১৯১৩ সালে গণিতে সম্মানসহ বিএসসি করেন এবং ১৯১৫ সালে ফলিত গণিতে মাস্টার্স করেন। উভয় পরীক্ষায় তিনি দ্বিতীয় এবং সত্যেন্দ্রনাথ বসু প্রথম হন। 

মেঘনাদ তাঁর সমস্ত গবেষণার ফলাফল গুলো একত্র করে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ডক্টর অব সায়েন্স ডিগ্রির জন্য আবেদন করেন। তার সব গবেষণা বিবেচনা করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাকে ১৯১৯ সালে ডক্টর অব সায়েন্স ডিগ্রি প্রদান করে। একই বছর মেঘনাদ প্রেমচাঁদ রায়চাঁদ বৃত্তি লাভ করেন। যার ফলে তিনি ইংল্যান্ড ও জার্মানীতে গবেষণার সুযোগ পান। 

১৯১৬ সালে আশুতোষ মুখোপাধ্যায় বিজ্ঞান কলেজ চালু করার পর সত্যেন্দ্রনাথ ও মেঘনাদ উভয়কেই গণিত বিভাগের যোগ দিতে বলেন। যদিও পরবর্তী কালে দুজনেই পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে চলে যান। সেখানে চন্দ্রশেখর ভেঙ্কট রামন পালিত অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। 

এরপর ১৯১৯ সালে তিনি প্রথম পাঁচ মাস লণ্ডনে বিজ্ঞানী আলফ্রেড ফাউলারের পরীক্ষাগারে এবং পরবর্তীতে বার্লিনে ওয়াস্টার নার্নস্টের সাথে কাজ করেন। দুইবছর ধরে দেশের বাইরে গবেষণা করার পর মেঘমাদ সাহা ১৯২১ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে খয়রা অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। 

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার জন্য কোনো পদ বরাদ্দ সে সময় না থাকায় তিনি ১৯২৩ সালে এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন। তিনি ১৯৩৮ সাল পর্যন্ত এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি গণিতবিদ অমীয় চরন ব্যানার্জি এর সান্নিধ্য লাভ করেন। ১৫ বছর ধরে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত থাকা অবস্থায় তিনি বিভাগটিকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করেন। এরপর তিনি মারা যাবার আগে অব্দি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় এর বিজ্ঞান বিভাগের ডিন হিসেবে দ্বায়িত্ব পালন করেছেন।

মেঘনাদ এবং সত্যেন বোস যুগ্মভাবে সর্বপ্রথম আলবার্ট আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতার তত্ত্ব সহ তার বিভিন্ন নিবন্ধ ইংরেজি ভাষায় অনুবাদ করে প্রকাশ করেন। আইনস্টাইনের ১৯০৫ থেকে ১৯১৬ সাল পর্যন্ত মোট যতগুলি নিবন্ধ জার্মান ভাষায় প্রকাশিত হয়েছিল তার সবগুলো ইংরেজিতে অনুবাদ শুরু করেন মেঘনাদ সাহা ও সত্যেন্দ্রনাথ বসু। 

তাদের এই অনুবাদ ১৯১৯ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রিন্সিপাল্‌স অব রিলেটিভিটি নামে প্রকাশিত হয়। অনূদিত বইটির ভূমিকা লেখেন প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ। ১৯৭৯ সালে আইনস্টাইনের জন্মশতবার্ষিকী অনুষ্ঠানে বলা হয় আইনস্টাইনের নিবন্ধগুলির প্রথম অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছিল জাপানে।

এই ভুল সংশোধন করে দেন সেই অনুষ্ঠানে উপস্থিত নোবেলজয়ী পদার্থবিজ্ঞানী সুব্রহ্মণ্যন চন্দ্রশেখর। আইনস্টাইনের রচনার প্রথম অনুবাদের স্বীকৃতি পান সাহা ও বসু। তাদের এই প্রিন্সিপাল্‌স অব রিলেটিভিটির একটি প্রতিলিপি প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনস্টাইন আর্কাইভে সংরক্ষিত আছে। সাহা ও বসুর এই অনুবাদ সর্বপ্রথম ইংরেজিতে অনুবাদ শুধু নয়, সারাবিশ্বে এটিই  আইনস্টাইনের রচনার প্রথম অনুবাদ।  

TwitterFacebookWhatsAppEmailShare

#Nobel Prize, #Meghnad Saha

আরো দেখুন