বিবিধ বিভাগে ফিরে যান

বেগম রোকেয়া – নারী জাগরণের অগ্রদূত 

December 9, 2020 | 3 min read

নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন (Roquia Sakhawat Hussain) ১৮৮০ সালের ৯ ডিসেম্বর রংপুর জেলার পায়রাবন্দ গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারের জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তাঁর মৃত্যুও হয়েছিল ৯ ডিসেম্বরেই; ১৯৩২ সালের ৯ ডিসেম্বর। মাঝের সময়টা খুব একটা লম্বা ছিল না। তাঁর মাত্র ৫৩ বছরের নাতিদীর্ঘ সময়ের পুরোটা কাল অতিবাহিত হয়েছে প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে।

ছোট বেলাতেই রোকেয়া স্বপ্ন দেখেছিলেন একদিন প্রকৃত শিক্ষা গ্রহণ করে মানুষের মতো মাথা উঁচু করে বাঁচবেন। কিন্তু পারিবারিক পরিবেশ অনুকূলে ছিল না। বাবা জহির উদদীন মোহাম্মদ আবু আলী হায়দার সাবের প্রকৃত অর্থেই নারী শিক্ষার পক্ষপাতি ছিলেন না। অনেকের মতো তিনিও মনে করতেন পুথিগত বিদ্যা মেয়েদের চক্ষুলজ্জা কমিয়ে দেয়, যা সংসারের অশান্তির কারণ। 

তিন ভাই, তিন বোনের মধ্যে রোকেয়া ছিলেন পঞ্চম। তাঁর বড় ভাইদের মধ্যে ইব্রাহিম সাবের প্রথম এবং দ্বিতীয় ভাই খলিলুর রহমান সাবের, পরের জন ছিলেন ইসরাইল সাবের। তবে তাঁর সেজ ভাই ইসরাইল সাবের অল্প বয়সেই মারা যান। বোনদের মধ্যে প্রথম ছিলেন করিমুন্নেসা খানম, দ্বিতীয় ছিলেন বেগম রোকেয়া এবং তৃতীয় বোন হোমায়রা খানম। পরিবারে ছিল উর্দু ভাষার প্রচলন। 

তাঁদের বাবা মেয়েদের পড়াশোনার প্রতি উৎসাহী না থাকলেও ছেলেদের শিক্ষিত করে তুলতে কোনো কার্পণ্য করেননি। দুজনকেই কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের সুযোগ করে দিয়েছিলেন তিনি। এ কারণে তাঁদের মেধা ও মননে শিক্ষা ও সভ্যতার প্রচুর প্রভাব পড়েছিল। বেগম রোকেয়া ও তাঁর বোনদের জীবনের শুরুতে বৈরী পরিবেশ থেকে সৃষ্ট প্রচুর মানসিক কষ্ট ভোগ করতে হয়েছে। বড় ভাই ইব্রাহিম সাবেরের সহযোগিতায় গভীর রাত পর্যন্ত মোমবাতির ক্ষীণ আলোতে পড়াশোনা করেছেন তাঁরা। 

কিন্তু বিষয়টি লুকানো গেল না; টের পেয়ে গেলেন বাবা। প্রতিক্রিয়া হিসেবে করিমুন্নেসাকে পাঠিয়ে দেওয়া হলো বলিয়াদীর মাতামহের বাড়ি। মাত্র চৌদ্দ বছর বয়সে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হলো তাঁর। এই বিয়ের মাত্র নয় বছরের মধ্যে বিধবা হয়েছিলেন তিনি। এই বোনের শ্বশুরবাড়ি ময়মনসিংহের দেলদুয়ারে বেড়াতে গিয়ে ইউরোপিয়ান গভর্ন্যান্সের কাছে ইংরেজি শিক্ষার সুযোগ পান রোকেয়া। পরে এই শিক্ষাটা খুব কাজে লেগেছিল তাঁর।

সাহিত্যিক হিসেবে আত্মপ্রকাশের পর বেগম রোকেয়া তাঁর এই বোনকে ‘মতিচুর’ গ্রন্থটি উৎসর্গ করেছিলেন। এই বোন ছাড়াও বড় ভাই ইব্রাহিম সাবেরের সহযোগিতার কথা তিনি বারবার করে বলেছেন বিভিন্ন লেখায়। বেগম রোকেয়ার ভাষায়, ‘আমাদিগকে অন্ধকারে রাখিবার জন্য পুরুষগণ ধর্মগ্রন্থগুলোকে ঈশ্বরের আদেশপত্র বলিয়া প্রকাশ করে। আর সেই সব গ্রন্থের দোহাই দিয়া নারীদের অন্তঃপুরে আবদ্ধ করিয়া রাখে তারা।’

নারীর অধিকার নিয়ে কাজ করতে গিয়ে তিনি উপলব্ধি করলেন, নারীকে মানুষ হিসেবে মানুষের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করতে হলে শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। এ জন্য একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তৈরির প্রয়োজনীয়তার কথাও চিন্তা করেছিলেন তিনি। সাখাওয়াত হোসেন এই জন্য বেগম রোকেয়াকে দশ হাজার টাকাও দিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর স্বল্পকালীন বিবাহিত জীবনে সেই ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটাতে পারলেন না রোকেয়া। স্বল্পায়ু নিয়ে জন্ম নেওয়া তাঁর দুই মেয়ে মাস কয়েকের ব্যবধানে মারা গেলে তিনি প্রচণ্ড মানসিক কষ্টের মধ্যে পড়ে যান। এই অবস্থায় সাখাওয়াত হোসেনও মারা গেলেন ১৯০৯ সালের ৩ মে।

স্বামীর মৃত্যুর পাঁচ মাস পর ভাগলপুরে তিনি শুরু করলেন সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল। কিন্তু এই অবস্থায় সাখাওয়াতের আগের ঘরের মেয়ে ও তার জামাতার বিরুদ্ধাচরণ এমন পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছাল যে, তিনি তাঁর সব কাজ পরিহার করে চলে এলেন কলকাতায়। ১৯১১ সালে মাত্র আটজন ছাত্রী নিয়ে নতুনভাবে শুরু করলেন স্কুল। এই স্কুলটি ছিল ইংরেজি ভাষায় শিক্ষাদানকারী প্রথম মুসলিম বালিকা বিদ্যালয়। এই আটজন ছাত্রীর যাতায়াতের জন্য কলকাতার একজন ব্যবসায়ী প্রথম একটি ঘোড়ার গাড়ি উপহার দিলেন।

এদিকে সাখাওয়াত হোসেন যে দশ হাজার টাকা দিয়েছিলেন, ‘বার্মা ব্যাংক’ নামক একটি ব্যাংকে তা জমা রাখা হয়েছিল। ব্যাংকটি দেউলিয়া হলে পুরো টাকাই নাই হয়ে গেল। চরম বিপদে পড়লেন রোকেয়া। এই অবস্থায় কিছু দানশীল ব্যক্তির সাহায্য এবং পরিচালনা কমিটির সদস্যদের মাসিক চাঁদার ওপর নির্ভর করে স্কুলটি চালিয়ে গেলেন। ১৯১৫ সালে ছাত্রীসংখ্যা ৪০-এ উন্নীত হলে স্কুলটিতে পঞ্চম শ্রেণি চালু করলেন এবং একে একটি উচ্চবিদ্যালয়ে উন্নীত করলেন। ১৯৩১ সালে ওই স্কুল থেকে তিনজন ছাত্রী মাধ্যমিক পরীক্ষায় অংশ নিয়ে উত্তীর্ণও হলো।

রোকেয়া একজন উঁচু মানের সমাজসংস্কারকও ছিলেন। ১৯১৭ সালে কংগ্রেসের কলকাতা অধিবেশনে বিখ্যাত আলী ভাইদের মা বি আম্মা বেগম ও অ্যানি বেশানতের আগমন উপলক্ষে গঠিত স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীতে বেগম রোকেয়া তাঁর কয়েকজন অনুগামী নিয়ে যোগ দেন। এ ছাড়া ১৯১৬ সালে কলকাতায় আঞ্জুমানে খাওয়াতিনে ইসলাম নামে একটি মহিলা সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তিনি। 

১৯১৭ সালে ওই সংগঠনের ৫০ জন মহিলা সদস্যের উপস্থিতিতে ১৫ এপ্রিল প্রথম বার্ষিক সম্মেলন করে একটা যুগান্তকারী ইতিহাসের জন্ম দিয়েছিলেন। এ ছাড়া নারীদের ভোটাধিকার আন্দোলনেও নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি। ১৯৩০ সালের দুই ডিসেম্বর প্রথম মুসলিম মহিলা হিসেবে উড়োজাহাজে চড়ে আকাশভ্রমণের সুযোগও গ্রহণ করেছিলেন রোকেয়া। তাঁর এ-সংক্রান্ত লেখা ‘বায়ুযানে পঞ্চাশ মাইল’ এ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য।

মাত্র ৫৩ বছর বয়সে ১৯৩২ সালের ৯ ডিসেম্বর মারা গেলেন মহীয়সী এই নারী। যে রাতে মারা গেলেন, ওই রাতেও লেখালেখি করেছেন। মৃত্যুর পর তাঁর টেবিলে পেপারওয়েটের নিচে ‘নারীর অধিকার’ শীর্ষক একটি অর্ধসমাপ্ত লেখা পাওয়া গিয়েছিল। তাঁর নিশ্বাস, বিশ্বাস, কর্ম ও ধ্যানে শেষ পর্যন্ত তিনি সেই একই চিন্তাধারাকে লালন করে গেছেন—‘মেয়েমানুষ নয়, মানুষ হয়ে বাঁচতে হবে, তবেই সার্থক মানবজনমের।’

TwitterFacebookWhatsAppEmailShare

#Roquia Sakhawat Hussain

আরো দেখুন