দেশ বিভাগে ফিরে যান

১৮-৪৪ করোনা টিকাকরণ শুরু হলে দেখা দিতে পারে রক্তের আকাল

April 28, 2021 | 4 min read

একদিকে আশার আলো জ্বলছে মিটমিট করে, আর ঠিক তখনই অন্য দিকে জমছে ঘন কালো মেঘ। আগামী ১ মে গোটা দেশ জুড়েই থেকে ১৮ বছর বা তার বেশি বয়সি কারও কোভিড ভ্যাকসিন (Covid Vaccine) নিতে আর কোনও বাধা থাকছে না। দেশে যখন প্রতিদিন ৩ লক্ষর বেশি মানুষ করোনায় আক্রান্ত হচ্ছেন তখন টিকাকরণ প্রক্রিয়ার এই সম্প্রসারণ নিশ্চিত ভাবেই স্বস্তির ইঙ্গিত, কিন্তু ভয় অন্যত্র। প্রতিদিন চড়ছে তাপমাত্রার পারদ। আর গরম মানেই রক্তের আকাল (Blood Crisis), এবার সেই সংকট কোথায় গিয়ে ঠেকবে? করোনা টিকাকরণ এই সমস্যাকে ঠিক কতটা বাড়িয়ে দেবে?এসব প্রশ্নেই রাজ্যের আকাশে সিঁদুরে মেঘ।

ভয়ের মূল কারণ টিকাকরণ বিধি। এই বিধিতে স্পষ্টই বলা হচ্ছে ভ্যাকসিন নেওয়ার পর ২৮ দিনের মধ্যে কোনও ভাবেই রক্তদান করা চলবে না।  এই সময়সীমা পার হতে না হতেই চলে আসছে দ্বিতীয় ডোজের সময়। ফলে রক্তদাতার হাত পা বাঁধা দু’মাসেরও বেশি সময়। এদিকে প্রতি বছর গরমে যে রক্তের সংকট দেখা দেয়, তা থেকে রাজ্যবাসীকে বাঁচাতে এই সময়টাতেই রাজ্য জুড়ে রক্তদান চলে। আর তাতে মুখ্য ভূমিকা নেন ১৮-৪৫ বছর বয়সিরাই। এবার একদিকে কোভিডের বাড়বাড়ন্তের মধ্যে যেমন রক্তদান আয়োজন করা করা সম্ভব হচ্ছে না, তেমনই প্রাণে বাঁচতে তরুণ প্রজন্ম ভ্যাকসিন নিলে রক্তদানের পথও বন্ধ হচ্ছে। ভয়টা সেখানেই, দুমাস কী ভাবে সামাল দেওয়া হবে, লক্ষ লক্ষ থ্যালাসেমিয়া ও ব্লাড ক্যানসারের রোগী সঠিক সময়ে রক্ত পাবেন তো? অক্সিজেনের সংকট সামাল দিতে না দিতে রাজ্যে যদি রক্ত সংকট দেখা দেয়, তবে স্বাস্থ্যকাঠামো ধরে রাখা যাবে তো?

কলকাতা-সহ জেলায় জেলায় পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে প্রয়োজন অনুযায়ী রক্তের যোগান দিয়ে আসছে ব্লাডমেটস। চিন্তার ভাঁজ এই সংস্থার প্রতিনিধিদের কপালেও। তবে এখুনি হার মানতে রাজি নন ওঁরা। সংস্থার সক্রিয় সদস্য সোয়েল মীর বললেন, “আমাদের কম বেশি দেড়শো সদস্য রয়েছেন । প্রতিটি জেলায় আমাদের প্রতিনিধিরা কাজ করছেন। একটা বড় সমস্যা তৈরি হতে পারে আন্দাজ করেই আমরা সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচার চালাচ্ছি, লোককে রক্ত দিতে বলছি টিকা নেওয়ার আগেই। করোনার প্রথম ধাক্কায় আমরা ১০০-র বেশি ক্যাম্প করেছিলাম। কিন্তু এবার একদিকে ভোট অন্য দিকে করোনার হানা, জোড়া চাপে ক্যাম্প করা যায়নি এতদিন। তবে এখন আমরা এখন ছোট ছোট ইনহাউজ ক্যাম্প করছি। কোচবিহারে একটি ক্যাম্প হয়েছে ইতিমধ্যেই,শিলিগুড়িতেও ক্যাম্প হবে দু’একদিনে। বহু ফ্লাইং ডোনার স্বেচ্ছায় রক্ত দিতে চাইছেন আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে। এছাড়া আমাদের কাছে জেলা ধরে ডেটাবেস রয়েছে রক্তদাতার, চেষ্টা করছি ভ্যাকসিন নেওয়ার আগে তাঁরা যাতে রক্ত দেন সে ব্যাপারে তাদের অনুপ্রাণিত করতে।” কিন্তু তাতে কি আশু সংকট মোকাবিলা করা যাবে? এ প্রশ্নের নিশ্চিত উত্তর দিতে পারেন না সোয়েল মীর।

প্রমাদ গুনছেন থ্যালাসেমিয়া নিয়ে প্রত্যক্ষ ভাবে কাজ করা সমাজকর্মীরা। থ্যালাসেমিক গার্ডিয়ান অ্যাসোশিয়ানের পরিচালন সমিতির সদস্য পুষ্পেন্দুবিকাশ আচার্য নিজেও থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত। বিপদটা ঠিক কেমন, তিনি বুঝিয়ে দিলেন যুক্তি দিয়ে। পুষ্পেন্দু বলছেন, থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্তরা দু’সপ্তাহে একবার রক্ত নেন। এক্ষেত্রে ১৮ বছর থেকে ৪৫ বছর বয়সিরা টিকা নিচ্ছেন মানে তিন থেকে সাড়ে তিন মাস একজন ডোনার রক্ত দিতে পারবেন না। সে কারণে বিরাট অসুবিধেয় পড়তে পারেন রাজ্যের থ্যালাসেমিয়া রোগীরা। “আমরা জাতীয় রক্ত সঞ্চালন কাউন্সিলে মেইল করেছিলাম বিষয়টিকে সবিস্তারে জানিয়ে। ‌ রেডক্রস, এফডিএ-এর উদাহরণ সামনে রেখে আমরা বলেছি বহু জায়গাতেই রক্তদানে ই বিধিনিষেধ নেই। কিন্তু এখনও কোনও নতুন গাইডলাইন পাইনি। আমরা চেষ্টা করছি ডোনাররা যাতে টিকাকরণের আগেই রক্ত দেন তা সুনিশ্চিত করতে।”

বছরভর রক্তদানে সমন্বয়ক হিসেবে কাজ করেন সুচন্দ্রা কর মহাপাত্র। আগে ব্লাডমেটসের সক্রিয় সদস্য ছিলেন, এখন কোনও প্রতিষ্ঠানের ছাতার তলায় সরাসরি না থেকে কাজ করছেন স্বাধীন ভাবে। সুচন্দ্রা বলছিলেন, “আমরা এখন ক্যাম্প করতে পারছি না। ব্লাড ব্যাঙ্কগুলিও পরিস্থিতি বুঝে আগের মতো রক্তদানে উৎসাহিত করছে না। আমরা জনে জনে ফোন করে বলছি কাছাকাছি ব্লাড ব্যাঙ্কে ব্লাড দিতে। করোনা টিকার প্রথম ডোজ নেওয়ার পর ২৮ দিন রক্ত দেওয়া যায় না, এদিকে ২৮ দিন হতে না হতে দ্বিতীয় টিকা দেওয়ার সময় চলে আসে। এই অবস্থায় কমবয়সিরা টিকা নেওয়ার আগে ব্যক্তিগত উদ্যোগে রক্ত দিলেই একমাত্র সমস্যার সমাধান হতে পারে।”

রাজনৈতিক দলগুলি একে অন্যের মধ্যে যতই চুলোচুলি করুক, রাজ্য জুড়ে যতই পক্ষ-বিপক্ষ থাকুক, রক্তদানে সবচেয়ে বড় উদ্যোগ নেয় রাজনৈতিক দলগুলিই একথা অস্বীকার করার উপায় নেই। এবার হাত পা বাধা তাঁদেরও। সিপিএম জেলা সম্পাদক শমীক লাহিড়়ী অবশ্য বলছেন, টিকাকরণ নীতি নিয়ে ‘সরকারি অব্যবস্থা’ ‌শাপে বর হয়েছে। তাঁর কথায়, ১ তারিখ থেকে টিকা চালু হলেও কে কবে টিকা পাবে তাঁর তো কোনও ঠিক ঠিকানা নেই। কারণ এই নিয়ে সরকারের কোনও সংহত পরিকল্পনাই নেই। আমরা তাই রক্তদান শুরু করছি জেলায় জেলায়। আর আমাদের কর্মীদের বলছি তাঁরা যেন টিকা দেওয়ার আগে রক্ত দেন। প্রতি বছর রক্তদানে রাজ্যে অগ্রণী ভূমিকা নেয় এসএফআই-ডিওয়াইএফআই। গোটা বিষয়টা পুরোভাগে থেকে যিনি নেতৃত্ব দেন তিনি এবার অন্য গুরুদায়িত্বে, সিঙ্গুরের বাম প্রার্থীমুখ তিনি। তরুণ‌ বাম নেতা সৃজন ভট্টাচার্য বললেন, “আগের বছর জায়গায় জায়গায় রক্তদান করেছিলাম, প্রশাসনের সহযোগিতা পাইনি। এবার এই বিষয়টি নিয়ে আমরা প্রচার শুরু করছি, ডিওয়াইএফআই, এসএফআই কর্মীদের অনুরোধ করব যাতে তাঁরা টিকা নেওয়ার আগে ব্যক্তিগত ভাবে রক্ত দেন।”‌

অশনিসংকেত পাচ্ছে রাজ্যের ব্লাডব্যাঙ্কগুলিও। অথচ পথে নেমে প্রচার করা যাচ্ছে না। লাইফ কেয়ার ব্লাড ব্যাঙ্কের প্রতিনিধি ইন্দ্রজিৎ কুণ্ডু আমাদের বললেন,”পরিস্থিতি খুব খারাপ হতে পারে এবার। রোগীর আত্মীয়দের রোগীর প্রয়োজনে রক্ত দেওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। তাছাড়া যদি আগেভাগে ব্যক্তিগত ভাবে ব্লাড দেন কেউ, তবে কিছুটা হলেও সংকট মোকাবিলা করা যায়।”

কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের রক্ত সঞ্চালন বিভাগের বিভাগীয় প্রধান চিকিৎসক প্রসূন ভট্টাচার্য সমস্যাটির গভীরতা স্বীকার করে নিলেন। বললেন, “আশঙ্কার বিষয় রক্তদান শিবির হচ্ছে না এখন, আগেভাগে রক্ত মজুত রাখা যাচ্ছে না। এখন টিকাকরণ শুরু হলে বহু ইচ্ছুকই রক্ত দিতে পারবেন না। ফলে রাজ্যের স্বাস্থ্য পরিকাঠামোর বর্তমান সংকটের সঙ্গে এই বিপদ যুক্ত হবে না এমনটা বলা যাচ্ছে না।” ২ মে ভোটের কাজ মেটার পর রক্তদান শিবির আয়োজন করতেই হবে। আরও একটি নিদান দিচ্ছেন চিকিৎসক প্রসূন ভট্টাচার্য। তাঁর যুক্তি, প্রথম ডোজের পর ২৮ দিন পর একজন রোগী রক্ত দিতে পারবেন। এখন দুটি ডোজের মধ্যে ৪৫ দিন মতো ব্যবধান থাকছে কেন্দ্রের বিধি মেনেই। অর্থাৎ একজন রক্তদাতা মধ্যবর্তী ১০-১২ দিনের মধ্যে চাইলে রক্ত দিতে পারেন। যদিও এভাবে এতবড় সংকটমোচন করা যাবে না একবাক্যে মানছেন তিনি।

তাহলে উপায়? আরও একটি সংকটের উল্টোদিকে আপাতত অস্ত্র বলতে একটাই-সদিচ্ছা।

TwitterFacebookWhatsAppEmailShare

#corona vaccine, #covid 19, #blood, #COVID Second Wave

আরো দেখুন