শচীন থেকে শাকিরা, প্যান্ডোরা পেপারসে ফাঁস বিশ্বের তাবড় তাবড় ধনকুবেরদের আর্থিক লেনদেন
বিশ্বের ৩৫ রাষ্ট্রনেতা, তিনশোরও বেশি সরকারি আধিকারিক, সেনাবাহিনীর শীর্ষ আধিকারিক এবং শতাধিক ধনকুবেরের গোপন সম্পদ ও তার লেনদেন ফাঁস করেছে ‘প্যান্ডোরা পেপারস’। এর মাধ্যমে গ্রিক উপকথায় বিশ্বের প্রথম মানবী প্যান্ডোরার বাক্সের মতোই বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে বিশ্বের প্রভাবশালীদের গোপন সম্পদের তথ্য।
প্যান্ডোরা পেপারসে প্রকাশিত নথিগুলো নিয়ে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি, গার্ডিয়ানসহ বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের যৌথ অনুসন্ধান বহু বিষয়ের পর্দা ফাঁস করেছে বলে ইন্টারন্যাশনাল কনসোর্টিয়াম অব ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্টস প্রতিবেদনের নাম দিয়েছে ‘প্যান্ডোরা পেপারস’। যৌথ অনুসন্ধানে সংবাদমাধ্যমগুলো প্রায় এক কোটি ২০ লাখ দলিলপত্র হাতে পেয়েছে।
কাদের নাম রয়েছে এই তালিকায়? বরং বলা ভালো কারা নেই এই তালিকায়। একের পর এক নাম উঠে এসেছে। শচীন তেন্ডুলকর থেকে শাকিরা-তাবড় ব্যক্তিত্বদের গোপন তথ্য ফাঁস হয়েছে এই তদন্তে।
আইসিআইজে তার প্রতিবেদনে বলেছে, গোপন নথির মাধ্যমে অফশোর কোম্পানিগুলোর সাথে যুক্ত ব্যক্তিদের মধ্যে রয়েছেন ভারতের ক্রিকেট ঈশ্বর শচীন তেন্ডুলকার, পপ সঙ্গীত ডিভা শাকিরা, সুপার মডেল ক্লডিয়া শিফার এবং ‘লেল দ্য ফ্যাট ওয়ান’ নামে পরিচিত ইটালিয়ান মবস্টার।
তবে এই তথ্যের বিরোধিতা করেছেন শচীনের অ্যাটর্নি। তিনি বলেছেন শচীনের যাবতীয় বিনিয়োগ বৈধ এবং আয়কর বিভাগের কাছে এর প্রতিটির হিসেব রয়েছে। অন্যদিকে, শাকিরার অ্যাটর্নি বলেন, গায়িকা ব্রিটেনের সরকারকে নিয়মিত কর দেন, এতে কোনও রহস্য বা জটিলতা নেই।
তদন্তে দেখা গেছে, জর্ডনের বাদশা গোপনে ব্রিটেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও মালিবুতে ১০ কোটি ডলারের সম্পদ তৈরি করেছেন।
ব্রিটেনের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার ও তাঁর স্ত্রী লন্ডনে একটি অফিস কেনার সময় তিন লাখ ১২ হাজার পাউন্ড কর ফাঁকি দিয়েছেন। এই দম্পতি একটি অফশোর কোম্পানি কিনে নেন, যারা ওই ভবনের মালিকানার দায়িত্বে ছিল।
ফাঁস হওয়া নথিতে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের মোনাকোয় গোপন সম্পদ এবং চেক প্রজাতন্ত্রের প্রধানমন্ত্রী আন্দ্রেজ বেবিসের ফ্রান্সে দুই কোটি ২০ লাখ ডলার দিয়ে প্রাসাদ কেনার তথ্য বেরিয়ে এসেছে। এই ভাবে ভারত সহ মোট ৯১টি দেশের রাঘব বোয়ালদের তথ্য ফাঁস হয়েছে বলে জানা গিয়েছে।
ইন্টারন্যাশনাল কনসোর্টিয়াম অব ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্টস। এই টিমের সঙ্গে যুক্ত ব্রিটেনের বিবিসি এবং দ্য গার্ডিয়ান সংবাদপত্র এবং ভারতের ‘দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস’-এর মতো ১৫০টি সংবাদমাধ্যম। এরা দাবি করেছে যে ১১.৯ মিলিয়নের বেশি তথ্য তারা ফাঁস করেছে।
চেক প্রজাতন্ত্রের প্রধানমন্ত্রী কীভাবে ফ্রান্সের দক্ষিণে এক কোটি ২০ লাখ পাউন্ডের দুটো ভিলা কেনার ক্ষেত্রে অফশোর কোম্পানিকে কাজে লাগানোর বিষয়টি চেপে গেছেন, তাও প্রকাশ পেয়েছে ফাঁস হওয়া নথিতে।
আজারবাইজানের ক্ষমতাসীন অলিয়েভ পরিবারের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ দীর্ঘদিনের। অর্থ লুককোতে এ পরিবার একটি বিশাল অফশোর নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছে। তাদের ঘনিষ্ঠ সহযোগীরা যুক্তরাজ্যে ৪০ কোটি পাউন্ডের সম্পত্তি কেনাবেচায় জড়িত বলে উঠে এসেছে প্যান্ডোরার নথিতে।
নথিতে কেনিয়ার প্রেসিডেন্ট উহুরু কেনিয়াত্তা ও তার পরিবারের ছয় সদস্যের অফশোর কোম্পানি থাকার তথ্য মিলেছে। গোপন সম্পদ এবং লেনদেনের তালিকায় রয়েছেন সাইপ্রাস এবং ইউক্রেইনের প্রেসিডেন্টও।
বিবিসি ওই প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, প্রায় ৭ বছর ধরে ফিনসেন ফাইলস, প্যারাডাইস পেপারস, পানামা পেপারসের প্রতিবেদনে অনেক বিশ্বনেতার গোপন সম্পদের তথ্য ফাঁস হয়। তবে ২০১৬ সালে যখন পানামা পেপারস ঝড় তুলেছিল, তখন এটাও বলা হয়েছিল, এটা ‘গল্পের অর্ধেকটা’ মাত্র।
সেই অর্ধেক গল্পের ধারাবাহিকতায় রবিবার খুললো প্যান্ডোরা পেপারস, যার নেপথ্যে অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের সংগঠন ‘ইন্টারন্যাশনাল কনসোর্টিয়াম অব ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্টস’ (আইসিআইজে)। ৯৫ হাজার অফশোর ফার্মের প্রায় এক কোটি ২০ লাখ নথি নিয়ে প্রায় ছশো সাংবাদিকের পরিশ্রমে সৃষ্টি হয়েছে ‘প্যান্ডোরা পেপারস’।
ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যমটির প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, গোপনীয়তা এবং নিরাপত্তা রক্ষার কারণে অফশোর কোম্পানির মাধ্যমে সম্পত্তি কেনা উচ্চ পর্যায়ের মানুষের একটি সাধারণ প্রবণতা। পানামা পেপারস বিভিন্ন দেশের সরকার প্রধানসহ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের অর্থ পাচারের তথ্য ফাঁস করেছিল। মূলত কর এড়িয়ে বেনামে সম্পদের পাহাড় গড়া, সেই অর্থ পাচার করা কিংবা অবৈধ আয়ের টাকায় ক্ষমতার মালিক হওয়ার ঘটনায় বেরিয়ে এসেছিল দেড়শো রাজনীতিবিদের নাম।
বিশ্বের মানচিত্রে অফশোর লেনদেনের সাথে যুক্ত রাজনীতিবিদদের সংখ্যা তুলে ধরে, ভারতের ছজন ও পাকিস্তানের সাতজন রাজনীতিবিদের নাম প্রকাশ্যে আনা হয়েছে। আইসিআইজের সর্বশেষ তদন্তে প্যান্ডোরা পেপারসে পাকিস্তানি রাজনৈতিক খেলোয়াড়দের অফশোর কোম্পানিতে বিনিয়োগের তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। জানা গিয়েছে প্রকাশ্যে আসতে চলেছে প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের নামও।
বলা হয়েছে পাক প্রধানমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিদের অফশোর হোল্ডিং প্রকাশ করা হয়েছে, যার মধ্যে পাক অর্থমন্ত্রী এবং একজন শীর্ষস্থানীয় আর্থিক সহায়কের নাম রয়েছে।