ভারতে করোনায় মৃত্যুর সংখ্যা চল্লিশ লক্ষ, বলছে হু
সর্বশেষ আপডেট: ৫ মে, ২০২২
(করোনার ফলে মৃত্যু সবচেয়ে বেশি ঘটেছে ভারতে। জানিয়ে দিল বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। ভারত সরকারের হিসেব অনুযায়ী দেশে মারা গেছেন ৫ লক্ষের কিছু বেশি মানুষ। হু এর হিসেবে এই সংখ্যাটি ৪০ লক্ষ। এই খবরটি প্রথম আপনাদের জানিয়েছিল দৃষ্টিভঙ্গি। আজ ৫ই মে, ২০২২ তারিখে মান্যতা দিল হু)
বিশ্ব জুড়ে প্রায় দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে তাণ্ডব চালাচ্ছে করোনা। অতিমারির দাপটে নাজেহাল মানুষ, বিপর্যস্ত জনজীবন। ভারতও তার ব্যতিক্রম নয়। অন্যান্য দেশের মতোই ভারতেও আঁচড় কেটেছে করোনা। এমতাবস্থায়, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা করোনা অতিমারির কারণে বিশ্বব্যাপী মৃত্যুর পরিসংখ্যান তৈরি করা শুরু করছে। কিন্তু সেই গণনাতেও কারচুপি মোদী সরকারের! তথ্য-পরিসংখ্যানে এমনই চঞ্চল্যকর তথ্য উঠে এসেছে।
হু-এর পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে যে, ২০২১ সালের শেষ পর্যন্ত বিশ্বজুড়ে করোনার কারণে দেড় কোটি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। যা বিভিন্ন দেশের তরফে পাওয়া সরকারি পরিসংখ্যানের দ্বিগুণেরও বেশি। সবচেয়ে লজ্জার বিষয় হল, করোনায় মৃত্যুর খতিয়ান পেশ করতে বিলম্বের কারণ হিসেবে ভারতকেই দুষছে হু। বিশ্বজুড়ে বিশেষজ্ঞদের এক বছরেরও বেশি সময় ধরে করা গবেষণা ও বিশ্লেষণের ফলাফল, কেবল মাত্র ভারতের আপত্তির কারণেই প্রকাশ করতে কয়েক মাস ধরে বিলম্বিত হয়েছে। করোনায় কতজন ভারতীয় মারা গিয়েছেন, সেই হিসেব নিয়ে বিভ্রান্তি থাকায়, অন্তরায় হয়ে উঠেছে মোদী সরকার।
বিভিন্ন দেশের সম্মিলিত পরিসংখ্যান অনুযায়ী, করোনায় ৬০ লক্ষ মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। আদপে সংখ্যাটা দেড় কোটি, অতিরিক্ত নব্বই লক্ষ মানুষের মৃত্যুর এক তৃতীয়াংশেরও বেশি ভারতে ঘটেছে বলেই অনুমান করা হয়েছে। মোদীর সরকারের তরফে হু-কে জানানো হয়েছিল যে, করোনার কারণে ৫,২০,০০০ ভারতীয় প্রাণ হারিয়েছেন। কিন্তু হু স্পষ্টতই জানাচ্ছে ভারতে কমপক্ষে চল্লিশ লক্ষ মানুষ করোনায় মারা গিয়েছেন। সমীক্ষকেরাও অনুমান করেছিলেন ভারতেই মৃত্যুর সংখ্যা সর্বাধিক হবে।
যেকোন অতিমারিতে মৃতের পরিসংখ্যান করা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ অতিমারি কীভাবে প্রভাব বিস্তার করেছে, কোথায় সর্বাধিক আঘাত এনেছে এবং ভবিষ্যতে একই ধরনের সংকটের সৃষ্টি হলে কীভাবে তার সঙ্গে লড়তে হবে, সেসব বিষয়ে তথ্য জানা প্রয়োজন। সর্বোপরি ভবিষ্যতের এমন রোগ হলে, সাবধানতা অবলম্বন করতে বিশ্বব্যাপী তথ্য অপরিহার্য। কিন্তু নিজেদের অপদার্থতা ঢাকতে স্বাস্থ্য সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহে সহযোগিতা করতে অস্বীকার করেছে মোদী সরকার।
বিশ্বব্যাপী করোনার প্রভাব বাস্তবে কতটা পড়েছে তা জানার জন্য বিভিন্ন পরিসংখ্যাবিদ, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, বিজ্ঞানীসহ বিশেষজ্ঞদের নিয়ে একটি টেকনিক্যাল অ্যাডভাইজরি গ্রুপ তৈরি করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। চলতি বছরের জানুয়ারিতে পরিসংখ্যানগুলি প্রকাশ্যে নিয়ে আসার পরিকল্পনা করেছিল সংস্থা, কিন্তু ক্রমাগতই তা পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে৷
সম্প্রতি, ১০ সদস্য বিশিষ্ট উপদেষ্টামন্ডলীর কয়েকজন সদস্য হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন; যদি হু পরিসংখ্যান প্রকাশ না করে তবে বিশেষজ্ঞরা নিজেরাই তা প্রকাশ্যে আনবেন। এরপরেই হু-এর মুখপাত্র, আমনা স্মাইলবেগোভিচ এক আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমকে বলেন, “আমরা এপ্রিলে পরিসংখ্যান প্রকাশ করার লক্ষ্যে এগোচ্ছি।”
হু-এর তথ্য পরিসংখ্যান, বিশ্লেষণ বিভাগের সহকারী ডিরেক্টর ডাঃ সামিরা আসমা, যিনি এই গবেষণার কাজে নেতৃত্ব দিচ্ছেন, জানান, “ভারত প্রমান করতে চায় যে হু-এর সমীক্ষা পদ্ধতি ত্রুটিপূর্ণ। ভারত মনে করে যে সমীক্ষা প্রক্রিয়ায় সহযোগিতামূলক প্রতিনিধিত্ব পর্যাপ্ত ছিল না।” ফেব্রুয়ারিতে জাতিসংঘের পরিসংখ্যান কমিশনে মোদী সরকারের তরফে এমনই একটি বিবৃতিতে দেওয়া হয়েছিল। এই ধরনের সমীক্ষার ক্ষেত্রে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার যোগ্যতা নিয়েও সওয়াল করে ভারতের বিজেপি সরকার।
করোনা নিয়ন্ত্রনে মোদী সরকারের ভূমিকা বিশ্ব জুড়ে সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছে। বিশেষত করোনা মোকাবিলায় বিজেপি সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি সঠিক ছিল না। জনস্বাস্থ্য প্রসঙ্গে অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসের জন্য মোদী সরকার সমালোচিত হয়েছে। ২০২১ সালের জানুয়ারিতে মোদী গর্ব করে বলেছিলেন, ‘ভারত একটি বড় বিপর্যয় হাত থেকে মানবতাকে রক্ষা করেছে।’ কয়েক মাস পরে, তার স্বাস্থ্যমন্ত্রী ঘোষণা করেছিলেন, ‘দেশে কোভিড-১৯ শেষ হয়ে গিয়েছে”। আত্মতৃপ্তিই হয়েছিল কাল। সরকারের দূরদর্শিতার অভাব বিপদ ডেকে আনে।
মোদী সরকারের ভুল পদক্ষেপের মাসুল গুনতে হয় সাধারণ দেশবাসীকে, ২০২১ সালের এপ্রিলে, করোনার বিধ্বংসী দ্বিতীয় ঢেউ আঘাত হানে ভারতে। মেলেনি হাসপাতাল, রোগীদের বিনা চিকিৎসায় মৃত্যু হয়েছিল। অক্সিজেনের হাহাকার চলেছিল দেশ জুড়ে। দেশজুড়ে শুরু হয়েছিল মানুষের মৃত্যু মিছিল। সৎকারের জন্য পাওয়া যায়নি জায়গা, গঙ্গায় ভেসেছে দেহ। এখন সেই মোদী সরকার নিজেদের বাঁচাতে হু-এর পরিসংখ্যান পদ্ধতি নিয়ে প্রশ্ন তুলছে!
মোদী সরকার করোনার কারণে মৃত্যুর তথ্য হু-কে জানায়নি। গত দুই বছর ধরে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গবেষকরা অন্ধ্রপ্রদেশ, ছত্তিশগড় এবং কর্ণাটকসহ কমপক্ষে ১২টি রাজ্য থেকে সংগৃহীত তথ্য ব্যবহার করেছেন। এর ফলেই বিশেষজ্ঞদের অনুমান কোভিডের ফলে ভারতে সরকারি হিসেবের চেয়ে কমপক্ষে চার থেকে পাঁচ গুণ বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে।
কিন্তু সমীক্ষার ফলাফল প্রকাশ বিলম্বিত করা বা কার্যত একেবারে স্থগিত করার জন্যে মোদী সরকারের নির্লজ্জ প্রচেষ্টা স্পষ্ট করে যে, অতিমারির কারণে মৃত্যুর তথ্য মোদী সরকারের জন্য একটি সংবেদনশীল সমস্যা। এর নেপথ্যেও রয়েছে রাজনীতি। আসল মৃত্যুর সংখ্যা বেরিয়ে পড়লে মোদী সরকারের সামগ্রিক ব্যর্থতার ছবি প্রকাশ্যে চলে আসবে। বেড়িয়ে পড়বে মোদী আমলে ভারতের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার কঙ্কাল। তাই সমীক্ষার প্রকৃত ফলাফলকে জনসমক্ষে আসা থেকে রুখতে আপ্রাণ লড়ে গিয়েছে মোদী সরকার।