বিবিধ বিভাগে ফিরে যান

আজ রামনবমী, হিন্দিবলয়ের পেশিবহুল রামের গুঁতোয় হারিয়ে যাচ্ছে বাংলার রাম?

March 30, 2023 | 6 min read

বাংলার রাম ও হিন্দিবলয়ের পেশিবহুল রাম

নিউজ ডেস্ক, দৃষ্টিভঙ্গি: আজ রামনবমী। বছর সাত-আট আগেও বাংলায় রামনবমীর এত বাড়বাড়ন্ত চোখে পড়েনি। কালী-দুর্গা-শিবের আরাধনা করা বাঙালি কি হঠাৎ করেই রামের ভক্ত হয়ে উঠল নাকি তাকে রামের ভক্ত বানানো হল? আর সেই রাম কোন রাম?

বাঙালির মুখে রাম নাম অনেকটা ভূতের মুখে রাম নামের মতো শোনায়, না? ভারতের অন্যান্য অংশে সাক্ষাতে রাম রাম বলার রেওয়াজ থাকলেও বাংলায় তা নেই। শবযাত্রাতেও আমরা রাম নাম ব্যবহার করি না। আমাদের জন্য বাড়ি থেকে বেরোনোর দুগ্গা দুগ্গাই যথেষ্ট! আমাদের প্রবাদে রাম, আমাদের প্রমাদ বলায় জিভ কেটে এ রাম!!! আমাদের পালা কীর্তনে একটু একটু করে রামায়ণের কাহিনী ছুঁয়ে যাওয়া। এই ছিল বঙ্গের হাল-আমলপূর্ববর্তী রামে উপস্থিতি। আদপে যে রাজ্যে ৩৪ বছর বাম শাসন ছিল; সেখানে কুল কমরেড সাজার জন্য রামকে কৃষি বিপ্লবের চরিত্র বানাতেই হয়। অথচ বাংলায় রাম দীর্ঘকাল ধরেই ছিল, ঘটি অর্থাৎ এদেশীয়দের অনেকেরই আরাধ্য দেবতা রঘুবীর, সেও তো রাম। মহাপ্রভুর সংকীর্তনেও রাম নাম কৃষ্ণ কেশব কৃষ্ণ কেশব কৃষ্ণ কেশব পাহি মাম্ – রাম রাঘব রাম রাঘব রাম রাঘব রক্ষ মাম্। রামের পুজো অনেক আগে থেকে হয়ে এসেছে বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে পশ্চিমবঙ্গের কাটোয়া মহকুমায় প্রায় কুড়িটি রামের মূর্তি আছে।এছাড়া বাঁকুড়ায় রাম মন্দির পাওয়া যায়। রাঢ়বাংলায় রামকে নিয়ে অনেক মুদ্রা পাওয়া গিয়েছে। এমনকি কাজী নজরুল ইসলাম রামকে নিয়ে অনেক গান লিখেছেন। রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব, সারদা মা, রাণী রাসমণি, মুরারি গুপ্ত, চৈতন্যজীবনী লেখক দয়ানন্দ-সহ অনেকেই রঘুবীরের আরাধনা অর্থাৎ রামের পুজো করতেন।

বাংলার রাম কেমন, তা জানার আগে রামায়ণকে জানতে হয়।
রামায়ণ সাতটি খন্ডে বিভক্ত, ২৪,০০০ শ্লোক রয়েছে তাতে। রামায়ণ এক অতিকায় কাহিনী, ভারতের নানান ভাষায় রামায়ণ রচিত হয়েছে, অনুদিত হয়েছে; কাহিনীও বদলে গিয়েছে নিজের মতো করে। বাল্মীকির রামায়ণকে প্রণিধানযোগ্য ধরে বলি, সেখানে রাম পুরুষোত্তম রাম। সে একজন ক্ষত্রিয় রাজপুত্র, সে বীর। অনেক পরে এক-আধবার তাঁর উপর দেবত্ব আরোপ করা হয়। যদিও তিনি নিজে নিজেকে দশরথপুত্র বলেই পরিচয় দিতে পছন্দ করতেন। ঠিকই পড়ছেন, সত্যি কথা বলতে কী, রামচন্দ্রের উত্তর জীবন এবং খোদ বাল্মীকি রামায়ণের উত্তর কাণ্ড, এই দুটিই খুব সমস্যার সৃষ্টি করে৷ বিশেষত রামায়ণের লঙ্কাকাণ্ডের শেষে রাবণ-বধের পর রামচন্দ্রের জীবন নিয়ে ধোঁয়াশা আছে। তাই রাজা রামচন্দ্র কেমন তা নিয়ে কম বলাই শ্রেয়। সে আলোচনার জায়গায় এই লেখা নয়।

কৃত্তিবাসী রাম

ও হ্যাঁ, এ প্রসঙ্গে বলি বাল্মীকির রামায়ণে কিন্তু “জয় শ্রী রাম” নেই। তুলসী দাসের রামেও নেই। এই ধ্বনি আমদানি করেছেন তারা, যারা মানুষ খুন করে ধর্মের চাদরে ঢাকা দেন, এই ধ্বনি আমদানি করেছেন তারা যারা অন্য ধর্মের মহিলাদের ধর্ষণের হুমিক দেন। এইতো চলতি নবরাত্রির কথা, এক হিন্দু মহন্ত বললেন মুসলমান মহিলাদের ধর্ষণ করো আর জনতা হাততালি দিল! বলে উঠল জয় শ্রী রাম!

এই রাম কি সেই রাম? তবে কোন রাম বাঙালির…?

বাংলার রাম, বাঙালির রাম:
বাঙালির রাম গড়েছেন কৃত্তিবাস, তাঁর রাম পাঁচালি অর্থাৎ কৃত্তিবাসী রামায়ণ বা বাঙালির রামায়ণ অনুযায়ী, রাম এমন একজন ব্যক্তি, যিনি নারীদের সম্মান দেন। বাঙালির রাম আসলে ফুলিয়া বা নদিয়ার শ্রী রামচন্দ্র। তিনি কখনও তাঁর স্ত্রীকে অগ্নিপরীক্ষা দিতে বলেননি। যে রামের আজ চল হয়েছে, তাঁর সঙ্গে বাঙালি রামচন্দ্রের তুলনা করা যায় না। বাঙালির রাম মানেই নিঃস্বার্থ ভালবাসা। সীতাকে হারিয়ে রাম দিশেহারা, কেঁদে কেঁদে সবাইকে জিজ্ঞেস করছেন।
বিলাপ করেন রাম লক্ষ্মণের আগে।
ভুলিতে না পারি সীতা সদা মনে জাগে।।

সীতাকে হারিয়ে বনের লতা, পশুপাখিকে প্রশ্ন তিনি করেন, কেঁদে ভাসান- ‘সীতা বিনা আমি যেন মণিহারা ফণী’। একজন রাজ্যাহত রাজপুত্র সে, আদিবাসী-উপজাতি নিয়ে স্ত্রীকে উদ্ধার করতে যান। বাঙালি দেবী-দেবতার তিনটি প্রধান ধারা। বৈষ্ণব, শাক্ত এবং শৈব। তাই রাধাকৃষ্ণ, দুর্গা এবং কালীমন্দির ছড়িয়ে আছে সর্বত্র। বাঙালির সেরা পার্বণকে এককথায় বলা হয় দুর্গোৎসব, শারদীয়া অর্থাৎ অকালবোধন। কী আশ্চর্য, এই পুজো স্বয়ং রামচন্দ্র করেছিলেন।

বাঙালি রামকে চিনেছে কৃত্তিবাসী রামায়ণে। সে দেবতা নয়, মানুষ। রক্তমাংসের মানুষ, এক সর্বগুণসম্পন্ন রাজকুমার, পুরাণের আদর্শ নায়ক। সৎমার ষড়যন্ত্রে রামকে বনবাসে যেতে দেখে বাঙালি দুঃখ পায়, কুঁজি মন্থরার পরিণতি দেখে আনন্দ পেয়েছে। এক পুরুষের হাতে সূর্পনখার নাক-কান কাটা গেলেও বাঙালি বিচলিত হয়নি – ও যে রাক্ষসী, মানুষ তো নয়। প্রতিপদে চোখে পড়ে বাঙালির রাম অলৌকিক শক্তিধারী দেবতা নন; বরং মানবিক গুণে ভুলত্রুটি এবং বীরত্বের মিশেলে তৈরি গড়ে ওঠা আমাদের কাছের লোক। রামের দুঃখে, বাঙালি কাঁদে।

আবার সীতার অগ্নিপরীক্ষার সময়। বাঙালির সহানুভূতি সীতার দিকে। একইভাবে আমরা কষ্ট পাই প্রিয় নায়ককে রাজ্যের প্রতি দায়িত্ব এবং স্ত্রীর প্রতি ভালবাসায় দ্বিধাবিদীর্ণ হতে দেখে। রামের মধ্যে বাঙালি নিজের দুর্বলতা দেখে, মিল খোঁজ। এখানেই রাম আমাদের লোক। সাধারণ থেকে অসাধারণ হয়েছেন, কিন্তু অক্ষত থেকে গিয়েছে মানবিক সত্ত্বা। সে অনুতপ্ত হয়, বিরহে ভেঙে পড়ে, মুখ বুজে সহ্য করে। এতো আমাদেরই একজন।

বাঙালির রামচন্দ্র মহাকাব্যের নায়ক, কখনওই দেবতা নন। দেবতাকে পুজো করা যায়, ভালবাসা যায় না। দোষে গুণে মানুষ, আমাদের ভালবাসার পাত্র, হিন্দিবলয়ের ‘মর্য্যাদাপুরুষোত্তম’ নন। ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে, নববিবাহিত স্ত্রীকে নিয়ে চৌদ্দ বছরের জন্য ওঁকে বনবাসে যেতে হয়। কোথায় দেবত্ব? কোথায় ঐশ্বরিক মহিমা? তাই আমাদের রামমন্দির নেই, রামনবমী পালন হয় না। আমাদের রাজ্যে রামগড় নেই, রামলীলা ময়দানের রমরমা নেই। কিন্তু ছেলেমেয়েদের নামে রাম, সীতা, লক্ষ্মণ আছে। ভূতের ভয় পেলে বাঙালি রামনাম জপে; ছোট বাচ্চারা ‘ভূত আমার পুত, পেত্নি আমার ঝি, রামলক্ষ্মণ বুকে আছেন, করবি আমার কি?‘ আওড়ায়।

বাংলার মানব অবতার রাম

বাল্মিকী এবং কৃত্তিবাসী রামের ফারাক

বাল্মিকী রামায়ণ এবং কৃত্তিবাসী রামায়ণের মধ্যে পার্থক্যই রামকে ঘিরে, তলোয়ার দিয়ে শূদ্রক তপস্বী হত্যার গল্প গৌরবের সঙ্গে বাল্মিকী রামায়ণে আছে, কৃত্তিবাসী রামায়ণে নেই। কারণ, বঙ্গে ঐতিহাসিক কারণে জাতিভেদের তীব্রতা অনেক কম। হিন্দিবলয়ে একবিংশ শতাব্দীতেও জাতিনিগ্রহের খবর নিত্যদিন শোনা যায়। আরেকটা উদাহরণ দিই, সীতার পাতাল প্রবেশের পরে রামচন্দ্র কাঁদলেন। পৃথিবী দেবী তত ক্ষণে তাঁর দুখিনী কন্যাকে কোলের সিংহাসনে বসিয়ে অন্তর্হিত। রামচন্দ্র সীতার চুল টেনে পতাল প্রবেশ রোধের চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু রাবণবিজয়ী এই চেষ্টায় ব্যর্থ হন। কৃত্তিবাসের বর্ণনায়, “পাতালে যেতে রাম ধরেন তাঁর চুলে
হস্তে চুলমুঠা রৈল সীতা গেল তলে।”

বাল্মীকির রাম আবার তেজি, স্ত্রী উধাও হওয়ার পরে সে একটু ক্ষাত্রতেজ দেখিয়েছিলেন। তিনি পৃথিবীকে হুমকি দিলেন, “তুমি সীতাকে শীঘ্র ফিরিয়ে দাও। নইলে পর্বত আর অরণ্যসহ তোমাকে বিনষ্ট করব। দরকারে পৃথিবী জলময় হয়ে যাক!” কৃত্তিবাসী রাম নিরীহ, নিপাট বাঙালি সে স্ত্রীকে ফেরানোর চেষ্টা করেন মাত্র, আর পাঁচটা বাঙালির মতোই আর বাল্মীকির রাম পরাক্রমী।​

বঙ্গে রামযাত্রা হয় অল্পস্বল্প, কিন্তু তাতে অলৌকিক ক্ষমতাশালী বিষ্ণুর অন্যতম অবতার রামের চাইতেও ফুটে ওঠে দোষে গুণে ভরপুর ট্র্যাজিক নায়কের ছবি। রবীন্দ্রনাথের কলমেও– ‘হনুমানকে যত্ন করে খাওয়াই দুধে-ভাতে, লক্ষ্মণভাই যদি আমার থাকত সাথে সাথে’। কাছের মানুষ বলেই রামকে নিয়ে মস্করা করতে আমাদের বাধে না। সুকুমারের লক্ষণের শক্তিশেল পড়েননি? মাইকেল নায়ক রাবণ, ভিলেন রামচন্দ্র নিয়ে ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ লেখেন।

বাংলায় সব দেবতার স্তোত্র-পাঁচালি কিছু না কিছু একটা আছে, কিন্তু রামের স্তোত্র বাঙলায় নেই। এমনকি অষ্টোত্তরশতনামও নেই! একাদশীর দিনে রামকৃষ্ণ মিশনে গাওয়া হয়-
“শুদ্ধব্রহ্মপরাৎপর রাম,
কালাত্মকপরমেশ্বর রাম,
শেষতল্পসুখনিদ্রিত রাম,
ব্রহ্মাদ্যমর প্রার্থিত রাম”।
যা সংস্কৃতে লেখা, বিবেকানন্দের দাক্ষিণাত্য ভ্রমণের পর এটি বাংলায় এসেছে।

হিন্দিবলয়ের পেশিবহুল রাম
ছবি সৌজন্যে YouTube/Indian Monk

হিন্দি বলয়ের রাম কি বাল্মীকির রাম?

না! কখনওই নয়। আমাদের রাম নীল ম্যাসেল-ম্যান নন।
রামানন্দ সাগরের রামায়ণ সিরিয়াল এবং বাবরি মসজিদ ধ্বংসের সময় রামের ধনুকধারী অবতারের উদয় হয়েছে। মোদীর হাত ধরে ছোট্ট রাম তাও বিজেপির সৃষ্টি।
আজকের ‘জয় শ্রীরাম’ রণ হুংকারে পরিণত হয়েছে। ভোট প্রচারে, গণহত্যায়, দাঙ্গায়, গণ পিটুনি দেওয়ায় সময় এর ব্যবহার করা হয়।
জেল থেকে বিজেপি নেতারা ছাড়া পেলে বা জামিন পেলে তাদের অভ্যর্থনা জানাতেও এর ব্যবহার হয়। মোদীর ভারতে জয় শ্রী রামের গোদা বাংলা হয় দেখ কেমন লাগে বা মরে যা জাতীয় কিছু। এটি আদ্যন্ত রাজনৈতিক শ্লোগান, এর সঙ্গে বাঙালির সংস্কৃতি বা ধর্মচর্চার বিশেষ যোগ নেই।
মন জপ নাম শ্রী রঘুপতি রাম
নব দুর্বাদল শ্যাম নয়নাভিরাম।।

সুরাসুর কিন্নর যোগী মুনি ঋষি নর
চরাচর যে নাম জপে অবিরাম।।

সজল জলদ নীল নবঘন কান্তি
নয়নে করুনা আননে প্রশান্তি।

নাম স্বরনে টুটে যায় শেকতাপ ভ্রান্তি
রুপ নেহারি মুরছিত কোটি কাম।।

কেবল মনে রাখবেন আমার-আপনার বাংলায় কাজী নজরুল ইসলাম এমন রামের ভজন লেখেন। যা হয়ত অন্য কোন রাজ্যে কল্পনারও অতীত। বিজেপির আমদানি করা কর্তৃত্ব স্থাপনকারী রামও বাঙালি কেন, ভারতেরও রাম নয়। মনে রাখতে হবে রাম লঙ্কা দখল করতে রাবণকে হত্যা করেননি, স্ত্রীকে উদ্ধার করতেই তাঁর লড়াই। অর্থাৎ সে আগ্রাসী নয়। রাবণ বধের পরে সে মন্দদরীর কাছে ক্ষমা চায়, রামশ্বরমে এসে ব্রাহ্মণ হত্যার প্রায়শ্চিত্ত করে। এগুলো তো কোনটাই আগ্রাসী নয়। রাম লড়েন বানর সেনা নিয়ে, (বা:+নর) বানর অর্থাৎ পশু নয়, আদিবাসী উপজাতিদের নিয়ে সে লড়াই করেছিল আর বিজেপি তো দলিত হত্যা করে রাজনৈতিক ফসল তোলে। আরও একটা জিনিস শুনলে চোখ কপালে উঠবে সীতার প্রিয় খাবার হরিণের মাংস, রামায়ণ একাধিকবার মাংস খাওয়ার উত্থাপন এসেছে, এমনকি বাল্মীকির আশ্রমেও মাংস রান্না হয়েছে, এসব জানলে বিজেপি না রামকেই এন আর সি করে দেয়!

আদপে রাম বিজেপির রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির হাতিয়ার মাত্র। আর রামের আবেগ নির্বাচনে জেতার যাদুকাঠি। এখন প্রশ্ন হল বাঙালি কি নিজেদের ঐতিহ্য লাটে তুলে দিয়ে হিন্দিবলয়ের আগ্রাসী রাজনীতির সূচক বিজেপি ও সঙ্ঘ পরিবারের রামকে আত্মস্থ করবেন? নাকি আমাদের কৃত্তিবাসী রামেই ভরসা রাখবেন? জবাব দেবে সময়।

TwitterFacebookWhatsAppEmailShare

#Ram Thakur, #Ram Navami 2023, #Ram Navami

আরো দেখুন