সিকিম-মণিপুরে মোদী জমানায় অসন্তোষের মেঘ ঘনীভূত হচ্ছে, জ্বলছে আগুন
নিউজ ডেস্ক, দৃষ্টিভঙ্গি: উত্তরপূর্ব ভারতের ৭টি রাজ্য অরুনাচলপ্রদেশ, অসম, মণিপুর, মেঘালয়, মিজোরাম, নাগাল্যান্ড, ত্রিপুরাকে ‘সেভেন সিস্টার’ বলা হয় এবং সিকিম বলা হয় ‘ব্রাদার’ অর্থাৎ ভাই। এই আটটি ছোট রাজ্য বরাবরই সংবেদনশীল। পাশাপাশি জাতীয় নিরাপত্তার ক্ষেত্রেও এই রাজ্যগুলির অবস্থান খুবই গুরতপূর্ণ। এই রাজ্যগুলির সঙ্গে জড়িত রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক সীমান্ত।
কেন্দ্রের সঙ্গে নানা সময় মতোবিরোধ তৈরি হয় এবং তা থেকে বিভিন্ন সময় এই রাজ্যগুলিতে আগুন জ্বলে। এই রাজ্যের মানুষদের একটা অভিযোগ, যা স্বাধীনতার এতো বছর পরেও প্রাসঙ্গিক। তারা মনে করেন, দেশের বাকি অংশের মানুষরা তাদের ভারতীয় বলেই মানতে চান না। আর এই জায়গা থেকেই অর্থাৎ ‘আইডেন্টিটি ক্রাইসিস’ থেকেই জন্ম নেয় বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনগুলি। সুযোগ নেয় বিদেশি শক্তিগুলি।
নরেন্দ্র মোদী প্রধানমন্ত্রীর চেয়ারে বসে উত্তর-পূর্ব সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘‘আগের সরকারের নীতি ছিল ‘লুক ইস্ট পলিসি’। আমার সরকারের নীতি হচ্ছে ‘অ্যাক্ট ইস্ট পলিসি’।’’ মোদীর এই নীতি আসলে যে উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলিকে পরস্পরের বিরুদ্ধে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে লিপ্ত করে দেওয়া, তা এখন জলের মতো স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। সম্প্রতি সিকিম, মণিপুর, মেঘালয়ের ঘটনা সেরকমটাই কিন্তু প্রমাণ করছে।
যেমন, দেশের রাজধানী নয়াদিল্লি থেকে অনেক দূরে, সিকিমের রাস্তায় কয়েক মাস ধরে জনগণের বিক্ষোভ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। জানুয়ারি মাসের ১৩ তারিখ সুপ্রিম কোর্টের দেওয়া একটি রায় সিকিমের মানুষের মনে জমে থাকা অসন্তোষের বারুদে স্ফুলিঙ্গের কাজ করেছে। দেশের শীর্ষ আদালত একটি পর্যবেক্ষণে বলে, সিকিমের নেপালিরা বিদেশি। লেপচা ও ভুটিয়াদের বাদ দিলে সিকিমে নেপালিরা সংখ্যাগুরু। সিকিম ভারতের সঙ্গে মিলে যায় ১৯৭৫ সালের ২৬ এপ্রিলে। তবে, সিকিমে সম্প্রতি করছাড় দেওয়ার ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, যেসব জাতি স্বাধীন সিকিমের বাসিন্দা ছিল একমাত্র তারাই এই ছাড় পাবে। অর্থাৎ, ‘ফরেন অরিজিন’ প্রশ্নে এই কড়াকড়ির কথা উঠেছে।
এইখানেই ক্ষুব্ধ হয়েছে নেপালিরা। কেননা, নেপালি জনগোষ্ঠীর দাবি, তারা সিকিমের আদি বাসিন্দা। ফলে, করছাড় পাওয়ার ক্ষেত্রে তাদেরও অধিকার রয়েছে। যদিও করছাড়ের বিষয়টি এখন আর অগ্রাধিকার পাচ্ছে না। এখন বিষয়টি পুরোপুরি জাত্যভিমানের প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের পর্যবেক্ষণের জেরে নেপালিদের আবেগে আঘাত এসেছে বলেই দাবি সংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠীর।
আবার, ভারতের অনেক ছোট রাজ্যের তুলনায় মণিপুরের একটি আলাদা বৈশিষ্ট্য আছে। বিবিধ কারণে বার বার জাতীয় স্তরে খবরের শিরোনামে চলে আসার একটি ঐতিহ্য আছে এই রাজ্যের। সম্প্রতি মণিপুরের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ আবারও সেই একই বার্তা নিয়ে এল। ‘দেখামাত্র গুলির আদেশ’ দেওয়ার মতো পরিস্থিতি এ দেশে সহসা দেখা যায় না। কেন্দ্রীয় বাহিনী নামিয়ে আইনশৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার মতো ঘটনাও অন্যত্র সচরাচর ঘটে না। বুঝতে অসুবিধা নেই, প্রথমত, মণিপুরে যে সংঘর্ষ চলছে তা সামান্য নয়, সহজে সমাধানযোগ্য নয়। দ্বিতীয়ত, এই সমস্যা আকস্মিকভাবে তৈরি হয়নি, অনেক গভীরে শিকড় না থাকলে এত প্রবল ও রক্তাক্ত সংঘর্ষ ঘটতে পারত না। রাজ্য প্রশাসনের সঙ্গে কেন্দ্রকেও এর দায়িত্ব নিতে হবে। ঠিক সময়ে পদক্ষেপ করলে ঘটনা এমন ভয়াবহতায় পৌঁছত না।
সমস্যার শুরু মেইতেই জনগোষ্ঠীকে জনজাতি হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়ার বিষয়টিকে নিয়ে। মেইতেই সে রাজ্যের সংখ্যাগরিষ্ঠ গোষ্ঠী, প্রায় পঞ্চাশ শতাংশ মানুষ তার অন্তর্ভুক্ত। এত দিন কুকি ও নাগারা জনজাতি হিসাবে গণ্য হলেও মেইতেই-রা ছিল তার বাইরে। সাধারণ দৃষ্টিতে তাতে কোনও অসঙ্গতি ছিল না, কেননা আর্থসামাজিক ভাবে তারাই অনেক এগিয়ে, বাকিরা পিছিয়ে। কিন্তু তবু, সংরক্ষণের ক্ষেত্রে জনজাতি পরিচয়ের হাজারো সুবিধার পরিপ্রেক্ষিতে মেইতেই-রা এ নিয়ে দীর্ঘ কাল ধরে ক্ষুব্ধ। এত দিনে সেই ক্ষোভের ফল ফলল, জনজাতি মর্যাদা দেওয়া হল। স্বভাবতই বাকি জনগোষ্ঠীরা এতে প্রবল রুষ্ট। তাদের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে, এই পদক্ষেপের মাধ্যমে তাদের জন্য সংরক্ষিত জায়গাটিতে এ বার মেইতেই-রাও ভাগ বসাতে আসছে। জমি থেকে চাকরি, শিক্ষাসুযোগ থেকে পারিবারিক নিরাপত্তা, সব কিছুই সংরক্ষণের সঙ্গে যুক্ত। সুতরাং, মণিপুরি সমাজের এক বড় অংশ প্রবল বেঁকে বসেছে। কোনও মতেই মেইতেই-দের জনজাতি পরিচয়ের স্বীকৃতি সে রাজ্যে মানা হবে না, এই মর্মে। তার থেকেই অগ্নিকাণ্ড, হত্যালীলা। প্রায় শ’খানেক মানুষের প্রাণনাশ ও সহস্র মানুষকে বিপন্নতায় পর্যবসিত করে সে রাজ্যে নেমে এসেছে মাৎস্যন্যায়।
সমস্যাটি জটিল, এবং সমস্যার প্রতি প্রশাসনিক দৃষ্টিভঙ্গিও অক্ষমণীয় রকমের অতিসরল। জনজাতি মর্যাদা বস্তুটিকে সংরক্ষণ নীতির সঙ্গে যুক্ত ভাবে দেখা ছাড়া গত্যন্তর নেই, এ কথা যদি মেনে নেওয়া হয়, সে ক্ষেত্রে এই মর্যাদা কারা পাবেন আর কারা পাবেন না, তার সঙ্গে স্থানীয় ক্ষমতাবিন্যাসের একটা অঙ্গাঙ্গি যোগ থাকা জরুরি। অর্থাৎ, এই মর্যাদাভেদ কোনও শূন্য তলে দাঁড়িয়ে হতে পারে না, ঐতিহাসিক, ভৌগোলিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক প্রেক্ষিত বিচার করে তবেই কোনও গোষ্ঠীকে এই স্বীকৃতি দান করা যেতে পারে। যদি মেইতেই-দের এই স্বীকৃতি দেওয়া আবশ্যক হয়, সে ক্ষেত্রে অন্যান্য গোষ্ঠীর মতৈক্য তৈরি করার প্রয়াসটিও জরুরি ছিল। মতৈক্য সহজ না হতে পারে, কিন্তু তাই বলে মতৈক্য নির্মাণের অভিমুখেই না এগোনো কোনও সমাধান হতে পারে না। উপর থেকে চাপিয়ে দেওয়ার এই প্রশাসনিক প্রবণতার কারণেই এত বড় সংঘর্ষ পরিস্থিতি উদ্ভূত হল। উপরন্তু, কেন্দ্রীয় সরকার এখন যে ভাবে সঙ্কটের মোকাবিলা করছে তার মধ্যেও দমনের প্রবণতাই স্পষ্ট।
মণিপুরের এই আগুনের আঁচ পৌঁছেছে পড়শি রাজ্য মেঘালয়েও। গত ৪ মে (বৃহস্পতিবার) মেঘালয়ের রাজধানীতে কুকি ও মেইতেই জনগোষ্ঠীর সদস্যের মধ্যে সংঘর্ষ বাঁধে।
২০২০-২০২২ সালে অসম-মিজোরাম সীমান্ত, অসম-মেঘালয় সীমান্ত একাধিকবার রক্তাক্ত হয়েছিল। সেদিনগুলিতে বিবদমান দুই রাজ্যের মুখোমুখি সংঘর্ষ দেখে গোটা দেশ স্তম্ভিত হলেও মোদী-শাহ ছিলেন নীরব! উত্তর-পূর্বের এই রাজ্যেগুলিতে এনডিএ ক্ষমতায় রয়েছে। বিজেপি তাদের শরিকদের নিয়ে ‘নর্থ ইস্ট ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স’ (নেডা) গঠন করেছে। নেডা’র আহ্বায়ক হচ্ছেন অসমের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্তবিশ্ব শর্মা। অথচ সীমানা বিরোধ নিষ্পত্তির বদলে এখন রাজ্যে রাজ্যে সংঘর্ষ চলছে। এক রাজ্যের পুলিশের গুলিতে আরেক রাজ্যের পুলিশ কিংবা নিরীহ গ্রামবাসী নিহত হচ্ছেন। আবার কোথাও একটি জনজাতিকে আরেকটি জনজাতির বিরুদ্ধে লড়াই বাঁধিয়ে দেওয়া হচ্ছে, আবার কোথাও দুটি সম্প্রদায়ের মধ্যে বিরোধ বাঁধিয়ে দেওয়া হচ্ছে। ফলে মোদী জমানায় উত্তরপূর্ব ভারতের কোথাও আগুন ধিক-ধিক করে জ্বলছে আবার কোথাও দাউদাউ করে জ্বলছে। যুক্তরাষ্ট্রীয় গণতন্ত্রে এটাই কি কাম্য?