দেশ বিভাগে ফিরে যান

অভিন্ন দেওয়ানি বিধি নিয়ে শোরগোল গোটা দেশে – বস্তুটি আদতে কী?

June 30, 2023 | 4 min read

দেশের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে এখন অভিন্ন দেওয়ানি বিধি।

নিউজ ডেস্ক, দৃষ্টিভঙ্গি: দেশের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে এখন অভিন্ন দেওয়ানি বিধি। দেশজুড়ে চর্চাও চলছে এ নিয়ে।

কিন্তু আদতে জিনিসটি কী?

অভিন্ন দেওয়ানি বিধি অর্থাৎ ইউনিফর্ম সিভিল কোড হল দেশের সব সম্প্রদায়ের সকল নাগরিকদের জন্য এক ও অভিন্ন আইন বলবৎ করার উপায় বা প্রক্রিয়া। বিবাহ, বিবাহবিচ্ছেদ, উত্তরাধিকার, দত্তক ইত্যাদির মতো ব্যক্তিগত বিষয়ের ক্ষেত্রে সকল ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মানুষের জন্য একটিই আইন থাকবে গোটা দেশে, সকলকে তা মেনে চলতে হবে। নির্দেশমূলক নীতির অধীনে সংবিধানের ৪৪ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, নাগরিকদের জন্য একটি অভিন্ন দেওয়ানি বিধি তৈরির চেষ্টা করবে রাষ্ট্র। প্রসঙ্গত, ভারতের সংবিধানের ভিত্তি হল নির্দেশমূলক নীতি এবং মৌলিক অধিকার। ১৯৮০ সালে সুপ্রিম কোর্ট বলেছিল, মৌলিক অধিকার এবং নির্দেশমূলক নীতির মধ্যে ভারসাম্য রাখতে হবে। কোনও একটিকে প্রাধান্য দিলেই সংবিধানের ভরসাম্য নষ্ট হতে পারে। অনুচ্ছেদ ৪৪-এর নির্দেশ অন্যান্য নির্দেশমূলক নীতিগুলির তুলনায় দুর্বল।

দেশে কি অভিন্ন বিধি নেই? আলাদা আলাদা বিধি চলে?

দেওয়ানী কার্যবিধি, পণ্য বিক্রয় আইন, সম্পত্তি হস্তান্তর আইন, অংশীদারি আইন, চুক্তি আইন ইত্যাদি বিষয়ে একটি অভিন্ন বিধি রয়েছে দেশে। একাধিক রাজ্য আইনগুলিতে বিভিন্ন সংশোধনী এনেছে। ফলে আইনগুলির মধ্যে ফারাক রয়েছে। সংবিধান প্রণেতারা কিন্তু বিষয়টিকে ইউনিয়ন লিস্টে অন্তর্ভুক্ত করেননি। অর্থাৎ ব্যক্তিগত আইনের ক্ষেত্রে সংসদকে একচেটিয়া অধিকার দেওয়া হয়নি। আইনগুলিকে ব্যক্তিগত আইন হিসেবেই উল্লেখ করা হয়েছে কনকারেন্ট লিস্টে।

অভিন্ন দেওয়ানি বিধি, ধর্ম ও কিছু প্রশ্ন:

ভারতে আজও অনেকক্ষেত্রেই ব্রিটিশ আইন চালু রয়েছে। অদল, বদল এসেছে, ব্রিটিশ আমলের আইনের উপর সংশোধনী আনা হয়েছে। গোটা দেশের আইন ব্যবস্থাই ব্রিটিশ প্রভাবিত। ফরাসি এবং পর্তুগিজ প্রভাবও রয়েছে। কিন্তু গোটা দেশের কোনও ধর্মীয় সম্প্রদায়ের সকলে এক আইনের আওতায় নেই। সব হিন্দু বা মুসলমান বা খ্রিস্টানরা কিন্তু একটি আইনের আওতাধীন নয়।

২০১৯ সালের ৫ আগস্ট অবধি জম্মু ও কাশ্মীরের স্থানীয় হিন্দু আইনের বিধিগুলি, কেন্দ্রীয় আইনের থেকে আলাদা ছিল। ১৯৩৭ সালের শরীয়া আইন এখন বাতিল হয়েছে। কাশ্মীরের মুসলমানরা একটি প্রথাগত আইনের আওতায় আছেন। যা মুসলিম পার্সোনাল ল-এর থেকে অনেকটাই আলাদা।
মুসলমানদের বিবাহের আইনও স্থানভেদে আলাদা। উত্তর-পূর্বে ভারতে ২০০-রও বেশি উপজাতি রয়েছে। প্রত্যেকের নিজস্ব প্রথাগত আইন রয়েছে। নাগাল্যান্ড, মেঘালয়, মিজোরামের মতো রাজ্যে আইনগুলিকে বলবৎ করেছে খোদ সংবিধান। বৈচিত্রই গণতন্ত্রের প্রতীক। তা কখনই বৈষম্যের প্রতিভূ নয়।

মৌলিক অধিকারের প্রেক্ষিতে অভিন্ন দেওয়ানি:

সংবিধানের ২৫ নম্বর অনুচ্ছেদে ধর্মের মৌলিক অধিকারের কথা রয়েছে। অনুচ্ছেদ ২৬-এর খ অনুযায়ী, দেশের প্রতিটি ধর্মীয় সম্প্রদায়, তাদের ধর্মের নিজস্ব বিষয়গুলি পরিচালনা করতে পারে। অনুচ্ছেদ ২৯-এ স্বতন্ত্র সংস্কৃতি সংরক্ষণের অধিকার দেওয়া হয়েছে। অনুচ্ছেদ ২৬-এ দেওয়া অধিকার কিন্তু অন্যান্য মৌলিক অধিকারের অধীন নয়।

গণপরিষদে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি:

মৌলিক অধিকারের অধীনে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি রাখা হবে কি হবে না, তা নিয়ে গণপরিষদে মতবিরোধ দেখা দিয়েছিল। ভোটাভুটি হয়। ধর্মের স্বাধীনতার তুলনায়, অভিন্ন দেওয়ানী বিধি কম গুরুত্বপূর্ণ, ভোটভুটিতে এমনই ফল মিলেছিল। ৫ জন মতের পক্ষে ছিলেন, ৪ জন বিরুদ্ধাচরণ করেছিলেন। মুসলিম ব্যক্তিগত আইনকে অনুচ্ছেদ ৪৪-এর আওতা থেকে মুক্ত করার চেষ্টা করা হয়েছিল, যদিও তা ব্যর্থ হয়। ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে মানুষের ব্যক্তিগত আইনে হস্তক্ষেপ করা উচিত নয়। অভিন্ন ব্যক্তিগত আইন কখনও জারি করা যায় কিনা, তাই নিয়েও প্রশ্ন তোলা হয়েছিল।
কোনও সম্প্রদায়ের বিরোধিতা উপেক্ষা করে অভিন্ন দেওয়ানী বিধি প্রণয়ন করা মোটেই বুদ্ধিমানের কাজ হবে না, মনে করে পিছিয়ে আসা হয়।

হিন্দুদের জন্য অভিন্ন বিধি জারির বিরোধিতা করেছিলেন সর্দার প্যাটেল, পট্টাভি সীতারামাইয়া, এম এ আয়ঙ্গার, এমএম মালব্য এবং কৈলাশ নাথ কাটজুদের মতো নেতারা। ১৯৪৯ সালের ডিসেম্বরে হিন্দু বিধি বিল বিতর্কে ২৮ জনে মধ্যে ২৩ জনই বিরোধিতা করেছিলেন। ১৯৫১ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর, তৎকালীন রাষ্ট্রপতি রাজেন্দ্র প্রসাদ বিলটিকে সংসদে ফিরিয়ে দেওয়ার হুঁশিয়ারি দেন। বিআর আম্বেদকরকে শেষ পর্যন্ত পদত্যাগ করতে হয়েছিল। জওহরলাল নেহেরু বিধিটিকে তিনটি পৃথক আইনে ভেঙে ছিলেন। বেশ কয়েকটি বিধান শিথিলও করা হয়েছিল।

অভিন্ন দেওয়ানি বিধি ও ২১ তম আইন কমিশন:

বিশ্বের অধিকাংশ দেশই বিভিন্ন সম্প্রদায়ের বৈচিত্রকে স্বীকৃতি দিতে চায় এবং আইনে তার প্রতিফলন দেখা যায়। এই যুক্তিতেই ২১ তম আইন কমিশন জানিয়েছিল, অভিন্ন দেওয়ানি বিধি কাঙ্ক্ষিত নয়। তার প্রয়োজনও নেই। অভিন্ন দেওয়ানি বিধি বাস্তবসম্মত নয় এবং আইন প্রণয়ন কাম্য নয়। সুপ্রিমকোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি বলবীর সিংহ চৌহানের নেতৃত্বাধীন ২১ তম আইন কমিশনের মত ছিল, অভিন্ন দেওয়ানি বিধি চালু করে বিবাহ, বিবাহবিচ্ছেদ, উত্তরাধিকারের মতো পারিবারিক বিষয়ে হিন্দু, মুসলমান, শিখ, খ্রিষ্টান, পার্সি, জৈন সকলের একই আইন চালু করার প্রয়োজন নেই। পারিবারিক আইন সংস্কার প্রসঙ্গে কমিশনের বক্তব্য ছিল, সংঘাতের সমাধান ফারাক মেটানো নয়। বৈষম্য দূর করার সুপারিশ করেছিল ২১ তম আইন কমিশন। সুপারিশ ছিল, সব ধর্ম-সম্প্রদায়ের জন্য বিয়ের নথিভুক্তিকরণ বাধ্যতামূলক হোক। বিয়ের ন্যূনতম বয়স সকলের জন্য এক হোক। বিবাহবিচ্ছেদের কারণ হিসেবে, বৈবাহিক সম্পর্ক ভেঙে যাওয়া, দম্পতির মধ্যে পুনর্মিলনের সম্ভাবনা না থাকাকে চিহ্নিত করা হোক। ধর্ম বদলে দ্বিতীয় বা বহুবিবাহ করার সুযোগ দেওয়া বন্ধ করার সুপারিশ করেছিল কমিশন। যেকোনও লিঙ্গের মানুষই সন্তান দত্তক নিতে পারবেন, কোনও একা পুরুষ যাতে কন্যা সন্তানকে দত্তক নিতে পারে, তার আইনি বন্দোবস্ত করতেও বলেছিল কমিশন।

২২ তম আইন কমিশনের ভূমিকা, বিরোধী দল, বিভিন্ন ধর্মী সম্প্রদায়ের মত:

এখন ২২ তম আইন কমিশন নতুন করে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি চালু করার বিষয়টি খতিয়ে দেখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। মোদীও অভিন্ন দেওয়ানি বিধির পক্ষে সওয়াল করেছেন। বিরোধী দলগুলি ২০১৮ সালের ২১ তম আইন কমিশনের রিপোর্টকেই হাতিয়ার করছে। ফের কেন অভিন্ন দেওয়ানি বিধি নিয়ে আলোচনা চলছে, তার যৌক্তিকতা খুঁজে পাচ্ছেন না বিরোধীরা। অধিকাংশ বিরোধী দলের মত, ২১ তম আইন কমিশনের রিপোর্টের পরে নতুন করে ২২ তম আইন কমিশনের অভিন্ন দেওয়ানি বিধি নিয়ে পদক্ষেপ করার প্রয়োজন ছিল না। মোদী সরকার মূল্যবৃদ্ধি, বেকারত্ব থেকে নজর ঘোরাতেই কি বিধি চালুর বিষয়ে উঠে পড়ে লেগেছে, সে প্রশ্নও উঠছে। মুসলিমদের বহুবিবাহের সুযোগ বন্ধ করা হবে বলে প্রচার করছে বিজেপি। কিন্তু সে বিষয়টি এখন সুপ্রিম কোর্টে বিচারাধীন।

মুসলিম পার্সোনাল ল’ বোর্ড সিদ্ধান্ত নিয়েছে, অভিন্ন দেওয়ানি বিধি নিয়ে, তাঁদের মতামত আইন কমিশনের কাছে তাঁরা জানাবেন। যদিও তাঁরা ভাবছেন, তাঁদের আপত্তিকে আমল দেওয়া হবে না।

অভিন্ন দেওয়ানি বিধি নিয়ে শিখদের ভিন্ন মত রয়েছে। শিখদের আপত্তির কথা জানিয়ে শিরোমণি অকালি দলের নেতা দলজিৎ সিংহ চিমা বলেন, অভিন্ন বিধি দেশের সংখ্যালঘুদের স্বার্থে নয়। ২১ তম আইন কমিশন বলেছিল, সংখ্যালঘুদের নাগরিক অধিকারে হস্তক্ষেপ করা হবে। দেশে অস্থিরতা, উত্তেজনা বাড়বে। এর দরকার নেই। ন্যাশনাল কনফারেন্সের নেতা ফারুক আবদুল্লাও বলছেন অভিন্ন দেওয়ানি বিধির প্রয়োজন নেই। তৃণমূল ও কংগ্রেসও এর বিরুদ্ধে।

আসন্ন বাদল অধিবেশনে হয়ত সংসদে এই বিল পেশ হবে। এখন রাজনৈতিকভাবে ইউনিয়ন সিভিল কোডকে ব্যবহার করতে চাইছে বিজেপি সরকার। কারণ বিরোধীরা অভিন্ন দেওয়ানি বিধি নিয়ে সব্বাই এক মত নন। জোট ভাঙতেই হাতিয়ার ইউনিয়ন সিভিল কোড! মত রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের।

TwitterFacebookWhatsAppEmailShare

#Uniform Civil Code, #Uniform Civil Code Bill, #India

আরো দেখুন