বিবিধ বিভাগে ফিরে যান

জঙ্গলমহলে প্রাচীনকাল থেকেই চলে আসছে বড়াম ঠাকুরের পুজো

July 11, 2023 | 2 min read

জঙ্গলমহলে প্রাচীনকাল থেকেই চলে আসছে বড়াম ঠাকুরের পুজো

নিউজ ডেস্ক, দৃষ্টিভঙ্গি: মূলত আদিবাসী সম্প্রদায় ও নিম্নবর্গীয় মানুষজনের উপাস্য দেবী বড়াম। জঙ্গলমহলের কেঁওসা গ্রামের খুব প্রাচীন পুজো এটি। এই গ্রামের বকুল গাছের তলায় এই লৌকিক দেবীর অবস্থান। কোথাও আবার তিনি দেবী চণ্ডিকার অংশ হিসাবে পৌরাণিক দেবী হিসাবে পূজিতা। তবে কেবল ব্রাহ্মণ পুরোহিতের সাহায্যে তিনি সেখানে পূজিত হচ্ছেন। জানা গেছে, ‘আদিমাতা’কে পুজো করার নিয়ম ছিল আদিম নিষাদ জাতিগুলির মধ্যে। তারই রীতিতে চলে আসছে বড়াম ঠাকুরের পূজা। আদিমাতা ‘বুড়া মা’ নামেও পরিচিত।

বড়াম দেবীর পূর্ণাবয়ব মূর্তির সংখ্যা নেই বললেই চলে। অধিকাংশই তাঁর মুণ্ডমূর্তি পূজিত হয়। সেসব মূর্তির সিংহভাগই ঝামাপাথরে (ল্যাটেরাইট) খোদিত মূর্তি। কোথাও সিমেন্টের প্রলেপ দিয়ে বর্ণময় মূর্তি গড়তে দেখা যায়। কোথাও আবার কেবল সিঁদুরে ল্যাপা থাকে। যেখানে পাথরের মুণ্ড মূর্তি থাকে, সেখানে হলুদ ও কমলা রঙের প্রলেপ দিতে দেখা যায়। কোনও কোনও মূর্তিতে দেবীর ভ্রূ-যুগলের মাঝখানে একটি ‘তৃতীয় নয়ন’ আঁকা থাকতে দেখা যায়।

বেশিরভাগ অঞ্চলে বড়াম দেবী বছরে এক দিন পুজো করা হয়। কোথাও পৌষের সংক্রান্তি, আবার কোথাও বা ১ মাঘ বা ‘আইখান দিন’ -এ বড়াম ঠাকুরের বাৎসরিক পুজো হয়। সেসময় কোথাও কোথাও মেলার আয়োজন করেন পূজাব উদ্যোক্তারা। তবে মেদিনীপুর শহরে বড়াম দেবীর নিত্য দিন পূজা হয়।

বড়াম দেবীর থানে পোড়ামাটির হাতি এবং ঘোড়া ছলন হিসাবে উৎসর্গ করবার রীতি আছে। জঙ্গলমহল এলাকা সুদূর অতীতকাল থেকে বাঘ, বাঘরোল, হায়না, নেকড়ে ইত্যাদি হিংস্র পশুদের বিচরণ ভূমি। এইসকল শ্বাপদকুলের আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য গ্রামে গ্রামে বড়াম ঠাকুরের পূজার প্রচলন বলে মনে করা হয়।

প্রত্যন্ত গ্রাম এলাকার পূজায় দেবীর কাছে টেরাকোটা (পোড়ামাটির) হাতি, ঘোড়া ‘ছলন’ হিসাবে উৎসর্গ করার রীতি প্রচলিত আছে। লোকবিশ্বাস, এগুলি দেবীর বাহন। তিনি এগুলিতে চেপে গ্রাম এবং সন্নিহিত পাহাড়-জঙ্গল এলাকা পরিক্রমা করেন। হিংস্র জন্তু-জানোয়ার যাতে স্থানীয় মানুষজন এবং তাদের পোষ্য গবাদি পশুপাখির কোনও ক্ষতিসাধন করতে না পারে, তা সুনিশ্চিত করেন তিনি।

অনেক গ্রামেই দেবীর পূজায় পশু এবং পাখি বলির প্রচলন আছে। পশু হিসাবে ছাগল, ভেড়া, এমনকি মহিষও বলি দেওয়া হয়। প্রধানত ডিম পাড়েনি এ মন মুরগি নিবেদন করা হয়। কোথাও আবার কাটা পশুর ধড় থেকে ফিনকি দিয়ে বেরোনো রক্ত সরাসরি ছড়িয়ে দেওয়া হয় পাথরের খণ্ড বা বিগ্রহের উপর। কোথাও আবার দেখা গিয়েছে, কাটা মুণ্ডটি দেবীর বিগ্রহের সামনে রেখে, তার উপরে মাটির প্রদীপ এবং ধূপ জ্বেলে সাজিয়ে দেওয়া হয়। কোথাও বড়াম ঠাকুরের পূজা উপলক্ষ্যে নাচ-গানের আসর বসে। পুরুষেরা ধামসা, মাদল, বাঁশি আর কেঁদরিতে সুর তোলেন। হাতে হাত বেঁধে, কোমর দুলিয়ে নাচ আর মিষ্টি গান করেন রমণীরা।

ধাদিকা গ্রামে ভিন্ন রীতিতে পুজো করা হয় । এখানে বলির পর, পশুটির কাটা মুণ্ড থেকে এক খণ্ড মাংস কেটে নেওয়া হয়। সেটিও কাটতে হয় বলির অস্ত্র দিয়ে। তারপর মাংসখণ্ডটিকে পূজাস্থলিতেই আগুন জ্বেলে পোড়ান হয়। এবার একটি মাটির পাত্রে কিছুটা দেশি মদ ঢেলে পোড়ান মাংসখণ্ডটিকে শালপাতায় রেখে দেবীকে উৎসর্গ করা হয়। সেসময় বিকট শব্দে ঢাক-ঢোল, ধামসা-মাদল বাজানো হয়। দশ দিক মেতে ওঠে সেই শব্দে। উল্লাসে মেতে ওঠা জনমণ্ডলী সমস্বরে দেবীর জয়ধ্বনি করতে থাকেন।

দেবীর কাছে বলি দেওয়া মাংস সাধারণভাবে গ্রামবাসীদের মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হয় । কোথাও অন্য মাংসের সাথে বলির মাংসের খণ্ডটি মিশিয়ে ভক্তিভরে রান্না করে খাওয়া হয়। কোথাও গ্রামের পরিবারগুলি পরিমাণমতো চাল সাথে নিয়ে আসেন। সারি দিয়ে উনুন খোঁড়া হয়। যৌথভাবে ভাত ও মাংস রান্না করে উপস্থিত সকলে মিলে দেবীর প্রসাদ হিসাবে খেয়ে থাকেন।

TwitterFacebookWhatsAppEmailShare

#jangalmahal, #Baram Thakur

আরো দেখুন