বিবিধ বিভাগে ফিরে যান

১৯৯৩ সালের ২১শে জুলাই কী ঘটেছিল? ইতিহাস লিপিবদ্ধ করেছিলেন মমতা

July 21, 2023 | 5 min read

নিউজ ডেস্ক, দৃষ্টিভঙ্গি: সর্বভারতীয় তৃণমূল কংগ্রেস প্রতি বছর ২১শে জুলাই শহীদ দিবস পালন করে। ১৯৯৩ সালের ২১শে জুলাই ১৩ জন যুব কংগ্রেস কর্মী পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারান কলকাতায়।

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তার লেখা ‘জীবন সংগ্রাম’ বইটিতে সবিস্তারে সেই দিনের ইতিহাসটি লিপিবদ্ধ করেছেন। আসুন ফিরে দেখি রক্তাক্ত সেই দিনটি, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখার মাধ্যমে।

কি হয়েছিল ২১ জুলাই? সবটাই বিস্তারিত বেরিয়েছে সংবাদপত্রে। পুনরাবৃত্তির চর্বিতচর্বণ হলেও রক্তাক্ত সেই ২১ জুলাই আজও আমার ‘স্বপ্নে নিবিড়, স্মরণে গভীর’। বেলা ১১-৩০ নাগাদ বাড়ি থেকে বেরিয়ে প্রথমেই গেলাম মেয়ো রোডের মোড়ে। তখনই সেখানে লক্ষাধিক মানুষ।

ছেলেরা অত্যন্ত উত্তেজিত, জানতে চাইলাম, ‘কি হয়েছে? ছেলেরা বলল, একটু আগেই পুলিশ নির্মম ভাবে কংগ্রেস নেতা পঙ্কজ ব্যানার্জিকে মেরে মাথা ফাটিয়ে দিয়েছে, তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ভাবলাম, এই উত্তেজনায় যে কোন মুহূর্তে বিস্ফোরণ হতে পারে। সামলানো দরকার। সবাইকে শান্ত হয়ে বসতে বললাম। একটা ম্যাটাডোরের ওপর পতাকা আর মাইক বেঁধে আমাদের সভা চলছিল। পুলিশকে অনুরোধ করলাম একটু সরে দাঁড়াতে যাতে মানুষ বসার জায়গা পায়. কেন জানি না, পুলিশ সেদিন প্রথম থেকেই একটু ভিন্ন মেজাজে ছিল, কিছুতেই আমার অনুরোধে কান দিল না। বিধায়ক শোভনদাকে বললাম, ‘আপনি শান্তিপূর্ণভাবে সভা চালিয়ে যান, আমি ব্রেবোর্ন রোড থেকে ঘুরে আসছি’।স্কুটারে চেপে চললাম ব্রেবোর্ন রোডের মঞ্চের দিকে।

রাইটার্সের প্রায় সামনে যখন এসে পড়েছি, দেখি, বিধায়ক সৌগত রায়ের নেতৃত্বে একদল সহকর্মী খুব উত্তেজিত অবস্থায় হেঁটে আসছেন। সৌগতদের কাছ থেকেই শুনলাম ইতিমধ্যেই ব্রেবোর্ন রোডে লক্ষাধিক মানুষ উপস্থিত। কিন্তু পুলিশ যথেচ্ছ লাঠি চালিয়েছে, স্টেজে উঠে আমাদের নেতাদেরও মারতে বাদ রাখেনি। আমাদের বক্তব্য যাতে সাধারণ মানুষের কাছে না পৌঁছায় সেইজন্য মাইকের তার পর্যন্ত কেটে দিয়েছে। 

মহাকরণের পাশ দিয়ে হেঁটে যখন ব্রেবোর্ন রোডে গিয়ে পৌঁছলাম, দেখলাম যতদূর চোখ যায় শুধু মানুষ আর মানুষ। পুলিশ একটা লরিও আসতে দিচ্ছে না।বিভিন্ন রাস্তায় কংগ্রেস কর্মীদের গতিরোধ করা হচ্ছে, কিন্তু জনতার ঢেউ এভাবে আটকানো যায় নাকি? আমাকে পৌঁছতে দেখেই মঞ্চের ঠিক উল্টোদিকের বাড়ির ছাদ থেকে সিপিএম ক্যাডাররা ইটবৃষ্টি শুরু করল।

পুলিশ সেদিকে ভ্রূক্ষেপ না করে, উল্টে আমাদের কর্মীদের দিকেই তেড়ে যাচ্ছিল লাঠি, টিয়ার গ্যাস নিয়ে। খালি গলায় মাইক ছাড়া কিছু বলতে চেয়েও বলতে পারলাম না।এরপই পুলিশ আবার উঠে এলো স্টেজে, রাইফেলের বাঁট দিয়ে আমার কোমরে আঘাত করল। ওদিকে আরেক দল পুলিশ ততক্ষণে মঞ্চ লক্ষ্য করে টিয়ার গ্যাসের শেল ছোড়া আরম্ভ করেছে। 

পুলিশের রুদ্রমূর্তি দেখে আমার সহকর্মীরা জোর করেই আমাকে মঞ্চ থেকে নামিয়ে নিয়ে এল. মঞ্চের নীচে এক জায়গায় তখন আমি কোনরকমে দাঁড়িয়ে আছি, কোমরে প্রচন্ড যন্ত্রনা হচ্ছে। কাউন্সিলার হৃদয়ানন্দ গুপ্ত চেষ্টা করছেন আমাকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য। সি সময় টিয়ার গ্যাসের দুটো জ্বলন্ত শেল এসে পড়ল আমার পায়ের সামনে। পুলিশ তখন গুলি চালানোর জন্য তৈরী। বন্দুকের নল আমার দিকেই তাকে করা, যেকোন সময়েই গুলি ছুটে আসতে পারে।

পুলিশকে বললাম, ঠিক আছে আমাকে মেরে যদি শান্তি পান তো মারুন কিন্তু নিরীহ মানুষের ওপর গুলি চালাবেন না। আমাদের ধারেকাছে কোনো ফোটোগ্রাফারকে ঘেঁষতে দেওয়াহচ্ছিলো না, যাতে ঘটনার কোনো ছবি পরদিন কাগজে না বেরোয়। বন্দুকের নল আমারই দিকে তাকে করা দেখে আমার ব্যাক্তিগত নিরাপত্তাকর্মী মাইতিবাবু তার সার্ভিস রিভলভর বারকরে চিৎকার করতে লাগলেন, ‘খুব বাড়াবাড়ি হচ্ছে, এবার আমিও কিন্তু বাধ্য হবো গুলি চালাতে।’

খুব আশ্চর্য লেগেছিলো সেদিন। এমনিতে আমি বেশিরভাগ সময় কোনো সিকিউরিটি নিই না। কিন্তু সেদিন সকাল থেকে স্পেশাল ব্রাঞ্চের ৫/৬ জনের একটা টিম, গাড়িতে আমার সঙ্গে নাথাকলেও পিছনের গাড়িতে ছিল। তাদের একজনের নাম ছিল মিঃ বিশ্বাস। দেখলাম, পুলিশের লাঠিতে তাঁর চশমা ভাঙলো। চোখ এবং কপালের কাছে কেটে গিয়ে দর দর করে রক্ত পড়ছেঅথচ তিনি নির্বিকার।ভাবতে পারেন, যাঁরা ছিলেন আমার নিরাপত্তার জন্য, তাঁদের নিজেদের নিরাপত্তাই বিঘ্নিত। ওদিকে ক্রমাগত টিয়ার গ্যাস চলছে। চারদিক ধোঁয়ায় ধোঁয়া, কিছু দেখাযাচ্ছে না। শরীরে প্রচন্ড যন্ত্রনা, চোখে অন্ধকার দেখছি, এই অবস্থায় কোনোরকমে এসে একটা ট্রাফিক স্ট্যান্ডের ওপর বসে পড়লাম। 

সিপিএম এর বেশ কিছু ক্যাডারদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল আমাদের পেটাবার জন্য। তাঁরাই তখন আমার চারপাশে ঘিরে থাকা আমার সহকর্মীদের মারতে শুরু করলেন। সৌগতদা আমার পাশেই বসেছিলেন, অমানুষিকভাবে ক্যাডাররাতাঁকে মারল। মার্ খেয়ে সৌগতদার কাঁধের হাড় ফুলে সেখানে কালশিটে পড়ে গিয়েছিলো। জনতা-পুলিশ তখন চলছে খণ্ডযুদ্ধ। তাঁর মধ্যেই আমরা কোনোরকমে একটা ছোট্ট জায়গায়বসে আছি। পুলিশ আবার তেড়ে এলো আমাদের মারতে। কয়েকজন মহিলা পুলিশ ছিলেন আমার সামনে, তাঁরা কিন্তু এবার বেঁকে বসলেন। রীতিমতো বিদ্রোহের সুরে তাঁরা আমাদেরমারতে অস্বীকার করলেন। 

তাঁদের হুংকারে পুলিশ সাময়িকভাবে আমাদের কাছ থেকে সরে গিয়ে এগিয়ে গেলো হাওড়া ব্রিজের দিকে। বন্দুকের সামনে ব্রাবোর্ন রোডে সেদিন বুক পেতেদিয়েছি কিন্তু গুলি চালিয়ে সেখানে মানুষ খুন করতে দিইনি।খবর এল, স্ট্র্যান্ড রোডে জমায়েত অসংখ্য মানুষ-সভা চলছে।বৌবাজারেও সুদীপদা,বক্সী সভা চালিয়ে যাচ্ছে, সেখানেও প্রচুরমানুষ। ধর্মতলায়ও জমায়েত প্রচুর – সাধনদা,গফফরদা,গোপাল,উজ্জ্বল,নরেশ চাকীরা সেখানে সভা করছেন।

কিন্তু মেয়ো রোডের খবর মারাত্বক, পুলিশ গুলি চালিয়ে সেখানে কয়েকজনকে মেরে ফেলেছে। সঙ্গে সঙ্গে সিদ্বান্ত নিলাম, শরীরে যতই আঘাত থাকুক, যেভাবেই হোক আমাকে মেয়ো রোড পৌঁছতে হবে। মেয়ো রোডের খবরটা এখানে চাউর হয়ে গেলে জনতা স্বভাবতই উত্তেজিত হবে, পুলিশের গুলি চলবে, রক্তগঙ্গা বইবে। তার চেয়ে আমি চলে গেলে জনতা যদি চলে যায় তাহলে ‘স্বার্থপর দৈত্যদের’ হাত থেকে তাদের প্রাণটা অন্তত বাঁচবে। দাঁড়াতে পারছিলাম না কোমরের চোটের জন্য। 

কোনরকমে এক্তা গাড়িতে উঠলাম, সহকর্মীদের কোলে প্রায় শোয়া অবস্থাতেই আসছি। মেওো রোডের কাছে আসতেই দেখলাম একটা পুলিশের অ্যাম্বাসাডার। মেয়ো রোড তখন রণক্ষেত্র। প্রতি মিনিটে গুলি চলছে, টিয়ার গ্যাসের শেল ফাটছে। মানুষ কিন্তু পালিয়ে যায়নি। অনুরোধ করলাম আমাকে ওখানে নামানোর জন্য। কিন্তু পুলিশের গাড়িটা আমাদের অন্য কোথাও নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিল। আমার এক সহকর্মী গৌতম তখন বাধ্য হয়ে গাড়ির স্টিয়ারিং চেপে ধরে গাড়িটাকে থামাল। আর তখনই অন্য একটা পুলিশের গাড়ি, পিছন থেকে এসে এই গাড়িটাকে মারল ধাক্কা, প্রচন্ড ধাক্কা। আমাদের গাড়ির দরজাটা খুলে গেল সেই ধাক্কায়। ওই গাড়িটার দরজা খুলে এসে সোজা ধাক্কা মারল আমার এলিয়ে পড়া শরীরে। তারপর আর কিছু দেখতে পেলাম না, একটা অন্ধকার যেন চোখের সামনে নেমে এল।

জ্ঞান যখন এল, দেখলাম আমি হাসপাতালে। অক্সিজেন, স্যালাইন, ডাক্তার, সিস্টারদের ঘেরাটোপে বন্দি। জানতে পারিনি, কত রাউন্ড গুলি চলেছে, কত মানুষ মারা গেছে। পরে সহকর্মীদের কাছ থেকে ঘটনার যে বিবরণ পেয়েছি বীভৎসতায় তা তিয়েন-আন-মেন স্কোয়ারের গণহত্যারই অবিকল রূপ। পুলিশ-সি পি এম-র যৌথ সন্ত্রাস, লাঠি, বন্দুক, পাইপগান, এত দিয়ে নিরীহ মানুষদের ওপর এই অত্যাচার ক্ষমার অযোগ্য। আনুমানিক পুলিশ সেদিন ৫০০ রাউন্ড গুলি চালিয়েছিল। একদিকে সশস্ত্র রক্তলোলুপ পুলিশ অন্যদিকে আমাদের সহকর্মীরা গুলির সামনে অকুতোভয়ে বুক পেতে দিয়েছে, কিন্তু লড়ায়ের ময়দান ছেড়ে পালিয়ে যায়নি।

এসপ্ল্যানেড ইস্টে আমাদের একজন সহকর্মী মুরারি- মুরারি চক্রবর্তী, মঞ্চে দলের পতাকা বাঁধছিল। পুলিশের বন্দুকের নল তারই দিকে তাক করা। হাতে উত্তোলিত কংগ্রেসের পতাকা নিয়ে মুরারি সেদিন বলেছিল, “ মারো, মারো, তোমাদের বমদুক আছে তোমরা মারো, কিন্তু মমতাদির নেতৃত্বে আমাদের আন্দোলন এগিয়ে যাবেই। তোমরা আমাদের মেরে ফেলতে পারো, কিন্তু আন্দোলনকে শেষ করতে পারবে না।” এরপর পুলিশের গুলি ছুটে এল তার দিকে, ‘বন্দেমাতরম’ গাইতে গাইতে মুরারি নিজের মৃত্যুকে হাসিমুখে সেদিন বরণ করে নিয়েছিল।

পুলিশ আর সি পি এম-র ক্যাডাররা সেদিন নরখাদকের ভুমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিল। শান্তিপূর্ণ জমায়েতের ওপর বিনাকারণে ঘোড়সওয়ার পুলিশবাহিনী উথে এসেছিল। অসংখ্য মানুষ, জল জল বলে কাতরাচ্ছেন, অথচ জলে পরিবর্তে তাদের জুটেছে টিয়ারগ্যাসের শেল, লাঠি, গুলি, ধোঁয়া। আমি কৃতজ্ঞ ময়দানের ক্লাবগুলির কাছে। সে সময় তাঁরা আর্ত মানুষকে আশ্রয় দিয়েছেন, তৃষ্ণার্ত মানুষদের খাওয়ার জল দিয়েছেন, বিপণ্ণ মানুষজনের দিকে বাড়িয়ে দিয়েছেন তাঁদের সহযোগিতার হাত।

কলকাতার বুকে তখন চলছে ‘রক্তের হোলিখেলা’। নিহত, আহত মানুষের সংখ্যা উত্তরোত্তর বাড়ছে। আর কলকাতা পুলিশের বড়বাবু তার বাহিনীর এহেন কৃতিত্বে গর্বিত হয়ে লালবাজারে সাংবাদিকদের কাছে বলছেন ‘ওয়েল ডান’। আমাদের সহকর্মীরা এক এক করে আক্রান্ত মানুষদের হাসপাতালে পৌঁছে দিয়েছেন। শুধু কলকাতার হাসপাতালগুলোতেই ভর্তির সংখ্যা ছিল দুশোর উপর, আর জেলা হাসপাতালগুলোতে কত মানুষ যে ভর্তি হয়েছিলেন তার কোনো হিসেবে নেই। 

ধন্যবাদ জানাই যুব কংগ্রেসের সেইসব সংগ্রামী বন্ধুদের, শত বিপদের মধ্যেও যাঁরা নিহত অথবা আহত সহকর্মীদের ছেড়ে ওপালিয়ে যাননি। রক্তের দরকার- যুদ্ধক্ষেত্রের মতোই লাইন দিয়ে যুব কংগ্রেসের কর্মীরা রক্ত দিয়েছেন, সহকর্মীদের বাঁচানোর জন্য। অনেক যুব কংগ্রেস কর্মী রাতের পর রাত জেগে হাসপাতালে কাটিয়েছেন, আহত সহকর্মীদের শয্যার পাশে দাঁড়িয়ে বাড়িয়ে দিয়েছেন নির্ভরতার হাত, বন্ধুত্বের হাত, আশ্বাসের হাত। সেদিন অনেকগুলো মৃত্যু ঘটেছিলো ঘটনাস্থলেই। তিন, চার জন মারা গিয়েছিলেন হাসপাতালে। ১৩ জন শহীদ হলেন পুলিশের গুলিতে। 

কিন্তু এতবড়ো একটা ঘটনার পরেও নির্লজ্জ বামফ্রন্ট সরকারের বিবেকের দংশন হল না, হৃদয়ের অনুভূতি জাগলো না, মৌখিক শোকপ্রকাশটুকুও সরকারের পক্ষ থেকে অব্যক্তই থেকে গেল, বিচার-বিভাগীয় তদন্তের দাবীকেও নস্যাৎ করে দেওয়া হল বিনা আয়াসেই। ধন্য মার্ক্সবাদী সরকার! ধন্য আপনাদের বিবেক।

TwitterFacebookWhatsAppEmailShare

#Mamata Banerjee, #21st July

আরো দেখুন