বিবিধ বিভাগে ফিরে যান

বিমল কর – বাংলা সাহিত্যের গল্পের যাদুকর 

September 19, 2023 | 2 min read

বাংলা কথাসাহিত্যে বিমল কর এক বহুল আলোচিত ব্যক্তিত্ব। চল্লিশের শেষাশেষিতে তাঁর উত্থান ঘটলেও আসলে পঞ্চাশ দশকেই মোটামুটিভাবে প্রতিশ্রুতিশীল গল্পকার হিসেবে সমালোচকদের কাছ থেকে সমীহও স্বীকৃতি আদায় করে নিয়েছিলেন। আর এই দশকেই তিনি হয়ে উঠেছিলেন তরুণ গল্পকারদের পরীক্ষিত দিশারী, ছোটগল্প- নতুন রীতি আন্দোলনের তাত্ত্বিক অভিভাবক হিসেবে সম্পাদনা করেছিলেন বহুল আলোচিত গল্পসংকলন। 

নতুন চেতনা প্রবাহের গল্পমালার উদগাতা হিসেবে সেই সময় সাহিত্য জগতে যে আলোড়ন উঠেছিল, তার উচ্ছ্বাস এখনো বাংলা কথাসাহিত্যের জগতে মিলিয়ে যায়নি। প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে বারবার খেয়াল করে দেখা গেছে এই আন্দোলন এখন বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসকারদের একটি প্রিয় বিষয়। পঞ্চাশের দশকে তার এই আন্দোলন দুটি কারণে বিখ্যাত হয়ে আছে, প্রথমত: পূর্বজ অগ্রজ লেখকদের ঘটনা প্রধান কিংবা চরিত্র প্রধানের রীতি অগ্রাহ্য করে গল্পের ভেতরদেশে প্রবেশ করলেন আন্তবাস্তবতার রহস্যময় বেদনাময় পর্ব এবং তাঁর গল্পের নায়ক-নায়িকারা স্বাভাবিক আট দশটা বাঙালি মহিলাদের মত ব্যথা-বেদনার পথিক নন, আর পাশাপশি গল্পের নায়করা মনের মধ্যে ডুব দিয়ে তন্নতন্ন করে অনুসন্ধান চালাতে থাকে বেঁচে থাকা জীবনের আত্ম বিশ্লেষণে। 

এই কারণে তাঁর গল্পের বারবার অপরিহার্যভাবে উঠে আসে মৃত্যুর মতো অসামান্য রহস্যময় শক্তিশালী বস্তু। যার সামনে আমরা সবাই অসহায়। মৃত্যু তাঁর প্রায় গল্পে একটা বিরাট ভূমিকা না রেখে পারে না। আর একথা কেনা জানে মৃত্যু চেতনা একজন লেখকের সৃজনশীলতাকে অখ- সত্যের দিকে নিয়ে যায়। বলা বাহুল্য: শিল্পের মাহাত্মকে করে গভীর ও সৌন্দর্যম-িত। আর সেই কারণে তার গল্পের মধ্যে মধ্যে অযথা তথাকথিত বাস্তবতা খুঁজতে গেলে ব্যর্থ হওয়াটাই স্বাভাবিক। আর তাঁর গল্পের সর্বাঙ্গে জড়িয়ে থাকে এক ধরনের বিষন্নতাবোধ, যা অবশ্য অকারণ নয়। 

এর নায়ক নায়িকারা সামাজিক পরিবেশে এক ধরনের ব্যর্থ মানুষ। সামাজিক পরিবেশের মধ্যে ব্যর্থ হয়ে কিংবা তাল মেলাতে গিয়ে ব্যর্থ হয়ে শেষাবধি মৃত্যুকেই বেছে নেই। তাঁর প্রথম বহুল আলোচিত গল্প ‘আত্মজা’ গল্পে দেখা যায়, পিতা মেয়ের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে কাছাকাছি আসে, তাদের সম্পর্ক গাঢ় থেকে গাঢ়তর হতে থাকে। আর সেটাকে স্ত্রী যুথিকা সন্দেহের চোখে দেখতে শুরু করে। ফলশ্রুতিতে স্বামী হিমাংসু অর্থাৎ পুতুলের পিতা শেষাবধি আত্মহত্যা করে বসেন। বিমল কর তাঁর সাহিত্য জীবনের শুরুতে তাঁর অগ্রজ কথাসাহিত্যিক সুবোধ ঘোষের একান্ত অনুসারী ছিলেন। 

অবশ্য তার সমসাময়িক আরেক তরুণ কথাসাহিত্যিক সন্তোষ ঘোষ মনে করতেন বিমল কর সুবোধ ঘোষ ও মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মাঝামাঝি পর্যায়ে অবস্থান করছেন; পরে বিমল তাঁর এক লেখায় স্বয়ং স্বীকার করেছেন যে, তিনি এই দুই অমর গুণী শিল্পীর কোন কিছুই অনুসরণ করতে পারেননি। আসলে বিমল কর-এর কোন গল্পই করুণ সরল রেখায় পূর্ণ বলয়িত হয়নি। গল্পে তার ঘটনা কোন সময় সামান্য থাকলেও চিন্তাবোধ গল্পের ঘটনাকে করে তোলে অসামান্য। আর এখানেই বিমল করের উপার্জিত হয়েছে সাফল্যের স্বাতন্ত্র্যময়তা। বলা বাহুল্য তিনি আমাদের কালের শ্রেষ্ঠ কথাশিল্পীদের একজন।

বিমল করে জন্ম কলকাতায় নয়; আসানসোলে। এই জন্য তার গল্পে কলকাতার উপস্থিতি খুব কম এসেছে। কলেজ জীবন পৌঁছাবার আগ পর্যন্ত তাঁর কিশোরবেলা কেটেছে আসানসোলে, কালিপাহাড়ি, বরাকর ও কুলটি অঞ্চলে। পড়াশোনার জন্য চলে আসেন কলকাতায়। বিমল কর লেখক হবেন এই রকম বাসনা তার প্রথম জীবনে ছিল না। তবে খুব ভালো পাঠক ছিলেন। তার বিশাল পড়ালেখা ছিল সমকালীন দেশী-বিদেশীদের গল্প উপন্যাস। বলতে গেলে নাক ডুবিয়ে এই সমস্ত উপন্যাস পাঠে বিমল কর নিজেও বেশি উপকৃত হয়েছেন। আর তরুণরাই ছিল তার সার্বক্ষণিক বন্ধু। তবে এর পর নানা জায়গায় জীবিকার পথে পাড়ি দিয়ে বিখ্যাত দেশ পত্রিকার সহ-সম্পাদক হিসেবে চাকরির সুবাদে ‘দেশ’, ‘আনন্দবাজার’ পত্রিকায় আমৃত্যু নিয়মিতভাবে গল্প উপন্যাস লিখে গেছেন।

বাংলা কথাসাহিত্যে বিশেষ করে কয়েকজন গল্পকার আছেন, যাদের গল্পের বিষয়বস্তুর চেয়ে গল্পের ভাষা ও বর্ণনা ভঙ্গি নিয়ে বেশি আলোচনা হয়েছে। বিমল কর তাঁদের মধ্যে বোধকরি অন্যতম।

TwitterFacebookWhatsAppEmailShare

#bengali literature, #Bimal Kar

আরো দেখুন